তন্ময়কে দেখি না কত দিন।
শুনেছি ওর নাকি একটা মিষ্টি মেয়ে হয়েছে। বউটাও নাকি মাশআল্লাহ্। মাঝে মাঝে অনা ফোন দিলে এসবই বলে।
ভার্সিটিতে যাই না ৫ মাস হতে চললো। দিন গুলো এখন চার দেয়ালেই কেটে যায়। বারান্দায় চড়ুই পাখির বাসা আছে। তাদের কিচিমিচি আওয়াজে খুব একটা খারাপ লাগে না।
বাড়িতে বাবা মার মন সবসময়ই খারাপ থাকে আমায় নিয়ে। প্রায়ই ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে। তাই এখন ঢাকাতেই থাকি। দেশের বাড়ি গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে।
বৃষ্টির ফোঁটা মুখে পড়লো। ঘোরটা কেটে গেল। ইদানিং ঘোরে থাকাটা একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। চলন্ত বাসে রাতের আকাশে প্রকৃতিটা খুব সুন্দর।
কাল কলেজে রিউনিয়ন পার্টি। তন্ময়ও আসবে সেখানে। একটি বার ওকে দেখার জন্য এত দূরের পথ পাড়ি দেয়া।
গ্রামের বাতাসে একটা শান্তি থাকে।
রিক্সা একদম বাসায় গেটে নিয়ে নামিয়ে দিল। মা দাড়িয়ে, মায়ের ক্ষূধার্থ চোখ গুলো কথা বলছে। মেয়ে এত গুলো বছর পর দেখার ক্ষূধা। আমায় জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলো মা। ছোট ভাই দুইটা ব্যাগ গুলো বাড়িতে নিয়ে গেল। মা কাঁদচ্ছে। এখন আর কান্না আসে না আমার। মাকে কাঁদতে দিলাম।
“তুই ভালো আছিস তো মা?”
“ভালো আছি মা খুব ভালো আছি। আজ সারাদিন ঘুমাবো ডাকাডাকি করো না”
কিছু খেয়ে ঘুমানোর জন্য রুম আটকে দিলাম। কখন ঘুমিয়ে যাই মনে নেই। সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে ভাই দুইটার সাথে লুডু খেলাম। নতুন করে মেতে উঠছে ছেলে দুটো। দারুণ কাটলো সন্ধ্যাটা।
খেয়ে দেয়ে শুয়ে আছি। ঘুম আসছে না। পুরানো স্মতি গুলো তারা করে বেড়াচ্ছে। কত গুলো বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু মনে হচ্ছে এই তো সেই দিন….
“লাল বেনারসি শাড়ি পড়ে তন্ময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমি। তন্ময়ও বর সেঁজে এসেছিলো। ছোট একটা সংসার সাজানোর কত স্বপ্ন ভাসছিলো চোখে। ইচ্ছে ছিলো দুজন দুজনকে দেখে কবুল বলবো।
দুজন দুজনের সামনে বসে আছি। হঠাৎ করে সব কিছু ঘোলা হতে শুরু করলো। আস্তে আস্তে তন্ময়ের মুখটা অন্ধকার হয়ে যায়। সেন্সলেস হয়ে পরি আমি। সবাই মিলে হসপিটালে নিয়ে গেল। ডাক্তার বললো আমার নাকি এপেন্ডিসাইটিসেরর প্রব্লেম। যত তাড়াতাড়ি হয় অপারেশন করাতে হবে। তবে ভবিষ্যৎতে মা হওয়ার চান্স খুব কম। বাবা বললো” গাছ তো আগে বাঁচাতে হবে! আপনি করুন অপারেশন ”
হসপিটালে থাকাকালীন একটি বারও তন্ময় আমায় দেখতে যায় নি। সুস্থ হয়ে বাসায় আসলাম। ছোট ভাইটা এসে বললো “আপু জানিস! তন্ময় ভাইয়া বিয়ে করছে ”
কথাটা বিশ্বাস হলো না। তন্ময়কে হাজারটা কল করি ওর রিসিভ করলো না। মাও বললো কথা সত্য।
সেই দিন চিৎকার করে কান্না করে ছিলাম। পাড়ায় মানুষ এক হয়ে গেছিলো কান্না শব্দ শুনে। চিৎকারে অপারেশনে আবার সমস্যা দেখা দিতে শুরু করলো। মা বাবা কে আর জানাই নি।
সারারাত তন্ময় আর আমায় বিয়ে পর প্ল্যানিং এর কনভারশেনস গুলো পড়ে কেটে যেত। দুই রাত তিন রাত পাড় হয়ে যেত ঘুম আসতো না। মা নিজে স্লিপিং পিল দিয়ে যেত। সবটা এক সাথে খেয়ে পরে থাকতাম।
সুন্দর চেহারা দিন দিন ফ্যাকাসে হতে থাকে। এসব দেখে বাবা মাকে বকতো। আমার খারাপ লাগতো। ডিসিশন নিলাম ঢাকা চলে যাবো। বাবাকে বলে ঢাকার প্রাইভেট ভার্সিটিতে এডমিশন নিয়ে চলে গেলাম। এরপর আর কখনো বাড়ী আসি নি।”
ফরজের আজান পড়েছে। উঠে নামাজ পড়ে গোসল করলাম। আজ নিজেই সবার জন্য রান্না করলাম। হয়তো এই দিন গুলো আমার বা মা বাবা কারো জীবনেই আসবে না। ছোট ভাই গুলোকে নিজ হাতে খায়িয়ে দিলাম।
মার একটা কালো বেগুনি শাড়ি আছে। ছোট বেলা থেকে শাড়িটা আমার খুব প্রিয়। সেটা পড়ে নিলাম। সাথে হিজাবও।
রিউনিয়ন মানেই সব বন্ধু গুলো এক হওয়া। সবাই এসেছে। সাথে যার যার স্ত্রী, স্বামী। তন্ময় মনে হয় এখনো আসে নি। সব সময় লেট লতিফ ছেলেটা। হঠাৎ করে সেই চির চেনা সুর। তন্ময় পিছ থেকে ডাকলো।
“আমায় খুঁজছিলে ঐশি!”
“নাহ। তেমন কিছু না”
“মিট মাই ওয়াইফ”
পরিচয় হলো তন্ময়ের ওয়াইফের সাথে। ওর মেয়েটাকে কোলে নিয়ে কেন জানি অনেক আপন আপন মনে হচ্ছিলো।হয়তো সব ঠিক থাকলে এই মেয়েটা আমায় মা বলে ডাকতো! ব্যাগ থেকে কিটক্যাট চকলেট বের করে দিলাম। ওর জন্য কিনে আনছিলাম। তন্ময় আবার ডাকলো আমায়।
“ঐশি! ”
“বলো”
“বিয়ে করো নি আর?”
“নাহ”
“চুড়ি গুলো আমি কিনে দিয়েছিলাম তাই না?”
“হুম”
“আর আয়না চিরুনীটা!”
“আছে”
“ব্যবহার করো না?”
“নাহ ”
“কেন?”
“বাসায় ফিরার পর যখন জানতে পারি তুমি বিয়ে করেছো! সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম। চিৎকার করায় অপারেশনে কাটা অংশে টান পড়ে। যেটা ক্রমশ ক্ষতির দিকে এগুতে থাকে। ঢাকায় আসার পর আমি অসুস্থ হয়ে যাই। ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি বলেন ” আমার প্রথম অপারেশন থেকে ইনফেকশন হয়ে গেছে। যা রক্তে মিশে গেছে। এবং তারপর ব্লাড ক্যান্সার। থার্ড স্টেপে এখন আমি।।
আর তো মাত্র ৯০ দিনের অতিথি আমি! হঠাৎ করে কি যেন একটা রোগ আমার শরীরে বাসা বাধলো। দেখতে দেখতে তোমার প্রিয় চুল গুলো পড়ে গেল। এখন আয়নার সামনে নিজেকে দেখলে খুব বেশি ভয় করে। তাই ব্যবহার করা হয় না।।
“ক্যান্সার!”
একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম
“হুম ক্যান্সার। তোমার মনটা খারাপ করে দিলাম না! আসি আমি। ভালো থেকো। ”
চলে আসলাম। মৃত্যুর আগে তন্ময়কে একটি বার দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। তাই এত দূর পাড়ি দিয়ে এখানে আসা। আর কিছু না।
তন্ময় ঐশির চলে যাওয়া দেখছে। ঐশিকে কিছু কথা বলার ছিলো। ও যখন হসপিটালে ছিলো। বিয়ে না করার জন্য বাবার পা ধরে বলেছিলো বিয়ে করবো না। সেই গল্পটা যে ঐশির জানা হলো না।
এক জীবনে সব জানা হয় না ! থাক না কিছু অজানা ধরা ছোয়ার বাহিরে। ঐশি ৯০ দিন পর হয়তো মুক্তি পেয়ে যাবে। তন্ময়েরা হয়তো জীবন লাঁশ হয়ে ঘুরে বেড়াবে বছরের পর বছর। আপন মানুষ গুলোর লাঁশ কাধে নেয়া সহজ না। একদমই না।
“আর তো মাত্র ৯০ দিন”