সময়ের দংশন

সময়ের দংশন

বাবা আজির উদ্দিন এবং মা মইরম একমাত্র ছেলে সুফিয়ানকে প্রচণ্ড আদর করে। সুফিয়ান জমি-জমা দেখা-শুনা করে। লাঙ্গল দিয়ে নিজ হাতে জমি চাষ করে। হালের জোড়া বলদকে পানি খাবার দেয়া থেকে শুরু করে গোয়ালে ঢুকানো, বের করা সব করে। হঠাৎ একদিন গোয়াল থেকে সে গরু বের করে না। লাঙ্গল কাঁধে নিয়ে জমিতে যায় না। মুখ গোমড়া করে ঘরে শুয়ে থাকে। বাবা বুঝতে পারে না সুফিয়ান এমন করছে কেন? জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে, সুফিয়ানকে নতুন ফুল প্যান্ট বানিয়ে না দিলে সে আর কোন কাজ করবে না। অগত্যা সুফিয়ানকে বাজারে দর্জির কাছে নিয়ে যায়। প্যান্টের মাপ নিয়ে কাপড় কেনার পর বাধে আর এক সমস্যা। যে দর্জি মাপ নিয়েছে, সে দর্জির কাছে সুফিয়ান প্যান্ট বানাবে না। সুফিয়ান কার কাছে যেন জেনেছে, ওই দর্জি প্যান্টের পকেট বড় করে না। তাই সুফিয়ান ওই দর্জিকে প্যান্ট সেলাই করতে দেবে না। শেষে পকেট লম্বা ও বড় করার শর্তে ওই দর্জিকেই প্যান্ট সেলাই করতে দেওয়া হয়।

সুফিয়ান মহাখুশি। মনোযোগ দিয়ে কাজ কর্ম করে। বাবার মাথায় ঢোকে না, প্যান্টের পকেট বড় করতে হবে কেন? কিন্তু কয়েক দিন পরেই বুঝতে পারে, বড় পকেট হলে চাল চুরি করতে সুবিধে হয়। সুফিয়ান বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে চাল চুরি করে বিক্রি করে। আর সেই চাল বিক্রির টাকায় চুপি চুপি সে তুলা লাগানো বিড়ি কিনে খায়। এতে ক্ষেপে যায় আজির উদ্দিন।
একই গ্রামের চঞ্চল মেয়ে ঝর্না। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝর্নার মতো উচ্ছল ঝর্না বানু। শুধু নিজের বাড়ি নয়, পুরো মহল্লা তার দস্যিপনায় মাতোয়ারা। মা’র বকা থোড়াই কেয়ার করে সে। তার ছোট বোন স্বর্ণা বানু তার দস্যিপনার প্রধান সেনাপতি। মা বলে, বড় হইছিস, কদিন বাদে বিয়ে হবে। রান্না শিখবি কবে। বিয়ে তো আর রাজার বাড়িতে হবে না। ঘর লেপা টুকিটাকি কাজ না জানলে সংসার করবি কীভাবে? এসব কথা ঝর্ণা বানু’র মাথায় ঢোকে না। তাই তার উপর মা চরম বিরক্ত। মহল্লার সুফিয়ান ঝর্ণার সাথে ভাব ভালোবাসা করতে চায়। ঝর্ণা সেটা ভালোভাবে বোঝে। স্বর্ণা বানুকে সে কথা ঝর্ণা বানু মাঝে মাঝেই বলে। কিন্তু সুফিয়ানের কাছে তা পরিষ্কার করে না। সুফিয়ান একটা ধোঁয়াশার মধ্যেই থেকে যায়। নানান উছিলায় সুফিয়ান তার মনের ভাব ঝর্ণার কাছে প্রকাশ করতেই থাকে। ঝর্ণা বানু সেটা শুনেও না শোনার ভান করে মজা উপভোগ করে। খুব ভোরে উঠে সুফিয়ান লাঙল জোয়াল নিয়ে মাঠে যায়। ঝুমুরি ছাগল বাঁধতে যায় মাঠে। দেখে সুফিয়ান মনের আনন্দে গান গেয়ে জমি চাষ করছে। সুফিয়ান মনের সুখে গেয়ে চলেছে- ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে…। সুফিয়ানকে ক্ষেপানোর জন্য ঝর্ণা বলে-সুফিয়ান, তুই নাকি তুলা ওয়ালা বিড়ি খাইস! ঝর্ণার কথায় সুফিয়ান ক্ষেপে যায়। হাল দাড় করিয়ে ঝর্ণার পেছনে ধাওয়া করে। দূর থেকে দেখে সুফিয়ানের বাবা রেগে যায়। তাই মনে মনে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকে সুফিয়ান। বিকেলে ঝর্ণা সেজে গুজে স্বর্ণাসহ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। সুফিয়ান একটি পলিব্যাগে রং গুলিয়ে ঝর্ণার গায়ের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে মারে। গায়ে লেগে পলি ব্যাগটি ফেটে গেলে ঝর্ণার কাপড়-চোপড় বিচ্ছিরি হয়ে যায়। ঝর্ণাও রাগে ফেঁটে পড়ে। খুঁজতে থাকে উপযুক্ত সুযোগ।

একদিন সুফিয়ান তার গরুর গোসল করাচ্ছে। কয়েকটি গরুর গোসল করিয়ে বেঁধে রেখেছে। আর একটির গোসল করাচ্ছে। ওই পথ দিয়েই এমন সময় ঝর্ণা যাচ্ছিল। সুফিয়ানের গরুকে গোসল করানো দেখে দাঁড়ায়। তারপর রাস্তা থেকে দু’হাত ভরে বালু তুলে গরুর গায়ে ছিটাতে থাকে। তারপর পালিয়ে যায়।

এভাবে শোধ আর প্রতিশোধের কারবার করতে করতেই অনেক সময় গড়িয়ে যায়। সুফিয়ান খুব করে ধরে ঝর্ণাকে। আজ ঝর্ণাকে বলতেই হবে হ্যাঁ বা না কিছু একটা। ঝর্ণাও মনে হয় এই দিনের অপেক্ষায় ছিল। সে মনে মনে দারুণ পুলকিত হয়ে ওঠে। এইভাবে শক্ত করে ধরিস নি কেন সুফিয়ান- ঝর্ণা মনে মনে বলে। তবুও সে বলে, না, আজ নয়, কালকে বিকেলে চিকলীর পাড়ে যখন গরু নিয়ে ফিরবে, তখন জানাবে। প্রথমে মন খারাপ হলেও পরে খুশিই হয়েছে সুফিয়ান। এতদিন যখন অপেক্ষা করতে পেরেছে, মাত্র একটা দিন অপেক্ষা করতে পারবে না? পারবে।

রাত আসে। দু’জনেই অপেক্ষা করে ভোরের। একটা কাঙ্খিত ভোর। কিন্তু আজ ভোর হতে এত দেরি হচ্ছে কেন? বিছানায় শুয়ে শুয়ে বিরক্তি আসে সুফিয়ানের। ঝর্ণা বানুর চোখেও ঘুম নেই। সে সিদ্ধান্ত নেয়, নাহ, বিকেল পর্যন্ত সে আর অপেক্ষা করতেই পারবে না। সকাল হলেই সুফিয়ানকে সে তার ভালোবাসার কথা বলবে। বলবে, সুফিয়ানকে সে বহুদিন থেকেই ভালোবাসে। শুধু প্রকাশ করে নি। গোপনে গোপনে তার কথা শুনে, মজা নিয়েছে। কিন্তু মানুষ যা চায়, সেভাবেই কি সব কিছু হয়? হয় না। আর তাই তো হঠাৎ-ই সেই রাতে গ্রামে দানবের দল- পাক হানাদার রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করে। পুড়িয়ে দেয় অনেক ঘরবাড়ি। ধর্ষিত হয় অনেকে। ঝর্ণার ছোট বোন শিরির লাশ পাওয়া যায় পাশের বাঁশ ঝাড়ে। নদীর ধারে পড়ে থাকতে দেখা যায় সুফিয়ানের মতো অনেক যুবকের রক্ত মাখা নিথর দেহ। চেনার উপায় নেই। কোনটা কা’র লাশ। অর্ধেক পোড়া শরীর নিয়ে ঝর্ণা বানু বোবা হয়ে চেয়ে থাকে রক্তমাখা নিথর দেহগুলোর মুখের দিকে। এর মাঝে কোনটা তাঁর সুফিয়ান!

সময় গড়িয়ে যায় ঝর্ণা বানু এখন বিশাল এক মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের রাঁধুনি। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। একদলের খাওয়া শেষ হলে আরেক দল আসে। সে দলের শেষ হলে আসে আরেক দল। কোনো কোনো দলের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় খাবার। সব রান্না হয় ঝর্ণা বানুর হাতে। এখন সে নিজেও মাঝে মাঝে ভাবে, যে ঝর্ণা রান্নার কথা শুনলে ঘর বাড়ি তছনছ করতে চাইত বিরক্তিতে, আজ তার হাতেই হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার খাবার রান্না হয়! চুলার পিঠে বসে জ্বলজ্বলে আগুনের লেলিহান শিখার মাঝে ঝর্ণা দেখে নিজের ফেলে আসা জীবন। আজ সে রান্না প্রতিদিনের চেয়ে আরও একটু বেশি করেছে। নতুন আরেকটা দল এখানে খাবে আজ। কমাণ্ডার বলেছে।

মুক্তিযোদ্ধারা যখন খেতে বসে, তখন ঝর্ণা আড়াল থেকে তাদের খাওয়া দেখে। আর শ্রদ্ধায় ভক্তিতে যেন নুয়ে পড়ে। এই টেকসই রঙের মানুষগুলোর জীবনের জন্য ভয় নেই। এরা নিশ্চিত জানে, মৃত্যু অবধারিত। যে কোনো সময় একটা গুলির নিশানা হতে পারে তারা। যে কোনো সময় দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে পারে কোনো বোমার বিস্ফোরণে। তবু হাসি মুখে লড়ছে তারা। আজো সে দেখছে অপলক চোখে। কিন্তু কোঁকড়া চুলের এই মানুষটা কে? তার কাঁধ এতো চওড়া কেন? এই রকম চওড়া কাঁধ ছিলো সুফিয়ানের।পরিশ্রমী সুফিয়ান। হাতের পেশি ছিল লোহার মতো টনটনে।মানুষটার মুখ খুব দেখতে ইচ্ছে করে ঝর্ণার। কিন্তু মানষটা তো মুখ ঘুরাচ্ছে না। মাথা নুয়ে খেয়েই যাচ্ছে। মনে হয় কতদিন এমন খাবার খায় নি। ভেতরে ভেতরে আরও অস্থির হয়ে ওঠে ঝর্ণা। তখুনি মানুষটা খেকিয়ে ওঠে। গলায় ভাত ঠেকেছে। ঝর্ণা দ্রুত এক গ্লাস পানি নিয়ে মানুষটার সামনে ধরে। মানুষটা মুখ না তুলেই সামনে কারো বাড়িয়ে দেয়া হাত থেকে পানির গ্লাস নেয়। ঢকঢক করে চোখ বন্ধ করে খেতে থাকে। শেষ ঢোকটা গিলতে গিয়ে মানুষটা আস্তে আস্তে মুখ তোলে একটু চোখ মেলে তাকায়। তখন ঝর্ণাও দেখতে পায় মানুষটার মুখ।

কেউ আর কারো চোখ থেকে চোখ সরাতে পারে না।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত