-“প্রতিবারের মতো এবারও বইমেলায় কবিতার নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। সেজন্য অগ্ৰিম শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।”
-“ধন্যবাদ। প্লিজ বি সিটেড।”
-“থ্যাঙ্ক ইউ। এবারেও কি তোর লেখার বিষয়বস্তু সেই একঘেয়ে ব্যর্থ প্রেম?”
-“প্রেম কখনও ব্যর্থ হয় না।”
-“কীভাবে?”
-“আগে বল তোর কাছে ব্যর্থতা মানে কি?”
-“ব্যর্থতা হলো চেষ্টা করেও কোনো কিছু অর্জন করতে না পারা। অপ্রাপ্তি।”
-“ধুর! অতো গভীর বিশ্লেষণ বাপু আমার আসে না। ওটা তোর মত কি কিছু খ্যাতনামা কবি এবং তাদের অন্ধ ভক্তদের জন্য তোলা থাক।”
-“তাহলে প্রেম বলতে তুই কি বুঝিস?”
-“আমার কাছে প্রেম হল চির বসন্তের মত। রঙিন তার রূপ, রস, গন্ধ। চির যৌবনা সে। মানুষগুলো বুড়িয়ে গেলেও যে সম্পর্ক কখনও বুড়োবে না তাই হলো প্রণয়ের।”
-“আমার লেখায় কি কখনও এটার বিরোধিতা করেছি। কোনোদিন কি বলেছি, প্রেম গ্ৰীষ্মের দাবদাহে গাঁয়ের উন্মুক্ত মেঠো পথের মত ফুটিফাটা? কিংবা সম্পর্কগুলো কোনো অশীতিপর বৃদ্ধার ন্যায় বলিরেখাময়?”
-“না, তা বলিসনি। কিন্তু যে ছেড়ে চলে গেছে কিংবা যাকে কখনও পাবোনা তাকে নিয়ে দুদিন বিলাপ করা যায়। কিন্তু সেটা দিয়ে ভালোবাসাকে ডিফাইন করা যায় না। যারা করে তারা দুঃখ বিলাসী ছাড়া আর কিছু নয়।”
-“আচ্ছা, এই ‘দুঃখ বিলাসীতা’ বলতে তুই কি বুঝিস?”
-“যারা জীবনের সকল আনন্দ ভুলে কষ্টগুলোকে নিয়ে হাহুতাশ করে..”
-“ভুল। হাহুতাশে কখনও বিলাস আসে না।”
-“আচ্ছা। লেটস ব্যাক টু দ্যা পয়েন্ট।”
-“হ্যাঁ। দেখ কিছু পাবার আশায় তো আমরা ভালোবাসি না। ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ রিলেশনশিপগুলো হল ব্যবসার মতো। প্রয়োজনে প্রিয়জন, ফুরোলে পর জন। ভালবাসা হল একটা অনুভূতি, মনের খোরাক। যা আদি, অকৃত্রিম। তাই মানুষগুলো পাল্টে গেলেও অনুভূতিরা একই থাকে। আর ওটুকুই প্রেরণা।”
-“বুঝলাম, প্রেম তোর কাছে একটা ইন্সপিরেশন। -“অবশ্যই।”
-“কিন্তু অতীত নিয়ে পড়ে থেকে এভাবে কষ্ট পাওয়া কেন?”
-“কে বলেছে আমি কষ্ট পাই?”
-“কষ্ট না পেলে কষ্টের অতীত নিয়ে পড়ে থাকিস কেন?”
-“তুই যাকে কষ্ট বলছিস, আমি তাকে শিক্ষা বলি। অতীত নিজেকে চিনতে শেখায়।”
-“কিন্তু অতীত ভুলে জীবনটা নতুনভাবে তো শুরু করতে পারিস। অন্য কারো সাথে, তার মতো করে অন্যরকম ভাবে।”
-“কার সাথে?”
-“কেন, তোর অগণিত মহিলা ভক্তদের মধ্যে থেকেই কাউকে বেছে নে।”
-“কথাটি আমার বন্ধু হিসাবে ঠাট্টা করে বললে ঠিক আছে। কিন্তু এতে বাস্তবতার অভাব প্রকট।”
-“ঠাট্টা তো করিনি। কিন্তু ভুলটাই কি বললাম?”
-“সফল হোক বা ব্যর্থ, প্রথম প্রেম আমাদের হৃদয়ের গন্তব্যের সন্ধান দেয়। চিনতে শেখায় মনের গভীরতা, সর্বোপরি নিজেকে। নতুন সম্পর্কের সূচনায় আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যারা আমার লেখা পড়ে আমায় বাহবা দেয়, তারা কি কেউ আমার মনের মানুষ হয়ে উঠতে পারবে? সম্ভবত না। কারণ, ওরা আমার লেখায় বিনোদন খোঁজে, যন্ত্রণা খোঁড়ে না। ওরা আমার গভীরতা বুঝবে কী করে? শিকড় বিহীন মানুষকে রূপকথার গল্প শোনাতে নেই।”
-“বুঝলাম। আচ্ছা পাহাড় ভালোবাসিস নাকি সমুদ্র?”
-“সমুদ্র। কারণ, দীগন্ত চিরে ফেনিল জলরাশির অবিরত আসা যাওয়া আমায় অনুপ্রেরণা জোগায়। সমুদ্রের মধ্যে সবসময় একটা প্রাণের স্পন্দন বিরাজ করে।
সেখানে পাহাড় বড় বেশি গম্ভীর। যেন এক ধ্যনমগ্ন সন্ন্যাসী।”
সাহিত্য পত্রিকার রিপোর্টার দিতি সেনের সাথে বিখ্যাত সাহিত্যিক নির্ঝর সন্যালের কথপোকথন এগিয়ে চলে। দেড় ঘন্টা পর ইন্টারভিউ পর্ব সমাপ্ত হলে নির্ঝর বলে ওঠেন, “পত্রিকাতেও কি ইন্টারভিউটা ‘তুই’ সম্বোধনে ছাপা হবে?”
-“পাগল! তাহলে তোর গুনমুগ্ধ ভক্তরা আমায় আর আস্ত রাখবে না। ওরা তো আর জানে না যে ওদের প্রিয় কবি নির্ঝর সান্যাল এই অধম রিপোর্টারের বাল্যবন্ধু।” মৃদু হাসিতে জবাব দেন দিতি, “আজ উঠি তাহলে? তুই তো এখন যাবি না।”
-“না রে। একজন প্রকাশকের সাথে মিটিং ফিক্সড হয়েছে। একটু পরেই আসবেন।”
-“ওকে। চল, আসলাম তবে। বাই।”
-“হুম, বাই।”
দু’কদম এগিয়ে ঘুরে দাঁড়ান দিতি সেন, “ও হ্যাঁ, তোকে তো বলাই হয় নি। আই অ্যাম গেটিং ম্যারেড, আসছে ফাল্গুনে।”
-“ওয়াও! হোয়্যাট আ গুড নিউজ! কীভাবে? লাভ অর অ্যারেঞ্জড?”
-“অববিয়েসলি লাভ। পরে সব বলবো। বিয়েতে আসতে হবে কিন্তু! কাকিমাকেও আনবি।”
-“আচ্ছা বেশ।”
-“চল আর দাঁড়াতে পারছি না, কাটলাম। বাই।”
কফিশপের ধুসর কাচের দরজা পেরিয়ে এগিয়ে যান দিতি সেন। পুরু চশমার কাচ ভেদ করে নিজের প্রথম প্রেম তথা কাব্যের অনুপ্রেরণা, ছোটবেলার বান্ধবীর ক্রমশ মিলিয়ে যাওয়া ধূসর শরীরটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন সাহিত্যিক নির্ঝর সান্যাল। এক তরফা ভালোবাসাটা চিরকাল অব্যক্তই ছিল, তবে কখনও মরেনি।
(সমাপ্ত)