আমি তখন ক্লাস সেভেনে যখন দুধ চা টা মোটামুটি ভাবে বানানো শিখছি। আসলে বাসায় আমিই একমাত্র যে চায়ের উপর বলতে গেলে এডিক্টেড। কিন্তু আম্মু কখোনোই চা খেতে দিতে চাইতো না। কিন্তু শিতের সময় সবাই কমবেশি চা খেতো। তো শিতের শুরুতেই আব্বুকে জ্বালিয়ে মারতাম চা এবং দুধ এনে দেওয়ার জন্য। আব্বুও যেহেতু শিতের সময় চা খেতো তাই আমার নাম করে এনেই দিতো।
আমি ছিলাম প্রচন্ড অলস। একগ্লাস পানি পর্যন্ত আম্মু না দিয়ে গেলে খেতাম না। সে আমি তৃষ্ণায় মরেই যাই নাকেনো। কিন্তু চা বানানোর ক্ষেত্রে উল্টোটা হলো। আমি চায়ের প্রতি এতই এডিক্টেড যে আম্মু বানিয়ে না দিলে নিজেই বানাতাম। আর আম্মু এটা খেয়াল করে আমার উপর নিন্জা টেকনিক খাটানো শুরু করলো। আমি যখনই চা বানাতে যাইএকে একে সবাই এসে বলে তাদের জন্যও বানাতে। আর আমিও মোটামুটি ভাবে প্রতিদিনই সবার জন্য চা বানাতে থাকলাম। তো আমরা বান্ধবীরা মিলে প্রায়ই রহিম ভাইয়ের টং দোকানে চা খেতে যেতাম। আমাদের গার্লস্ স্কুলের পাশেই ছিলো রহিম ভাইয়ের দোকান। আর আমাদের স্কুল মোটামোটি দুপুর টাইমে শেষ হতো।
তখন কেউ ওর দোকানে চা খেতে আসতো না। তো ওর চা খেয়ে মনে হতো আমার চায়ে কেনো এত টেস্ট হয়না। আমি যখনই রহিম ভাইয়ের কাছে ওর চা বানানোর টেকনিক জানতে চাইতাম ও এড়িয়ে যেতো। আর কি করার প্রতিদিন ওর চা খেয়ে নিজের বানানো চা স্বাদহীন লাগতো। ধীরে ধীরে চা বানাতে আলসেমী চলে আসলো। আমি প্রথমে চা বানিয়ে পরে সেটা কাপে ঢেলে দুধ মেশাতাম। একদিন চা বানাতে গিয়ে আলসেমীতে ধরলো। চায়ের পানি হালকা গরম হলে চা পাতি দুধ চিনি একবারে দিয়ে দিলাম। অসাবধানতায় চা পাতি আগের তুলনায় বেশি পড়ে গেছিলো। আর ওদিকে আমার প্রিয় টিভি শো ও শুরু। চুলার আঁচ কমিয়ে চা ঢাকা দিয়ে চলে গেলাম টিভি দেখতে। প্রায় ১০মিনিট পর যখন শো তে বিরতি দিলো।
টাটা টি এর এ্যাড দেখে চায়ের কথা মনে পরলো আমার। দৌড়ে গিয়ে চুলা বন্ধ করলাম। চায়ের পানি একটু কমে গেছে। চায়ে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথে টের পেলাম রহিম ভাইয়ের চায়ের রহস্য। অদ্ভুদ ভাবে আমার চায়ের টেস্ট টাই বেশি ছিলো। আমার চায়ের উন্নতি হতে থাকলো। আব্বু আম্মু আপু সবাই আমার চায়ের ফ্যান হয়ে গেলো। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে হলো আরেক বিপত্তি। বাসায় যেই আসে আম্মু আমাকে দিয়ে চা বানায়। আর আমার হাতের চা খেতে তারা প্রায় প্রতিদিনই বাসায় আসতে লাগলো। আমিও সবকিছু ফেলে সারাদিন চা বানাতে লাগলাম। আব্বু আম্মু ও বিরক্ত হচ্ছিলো। প্রতিদিন এতো মেহমান আসা দেখে। একদিন আপুকে দেখতে আসলো। সেদিন ও আম্মু আমাকেই চা করতে বললো। আপু আম্মুর মতো সুন্দরী হলেও আমি আব্বুর গায়ের রং পেয়েছি। অর্থাৎ শ্যামলা।
আমি চা করে নিয়ে গেলাম। আপুকে ওনাদের পছন্দ হয়েছে খুব। হবে নাই বা কেনো আপু রুপে গুনে সবদিক থেকেই পারফেক্ট। যেখানে আমি শুধু চা বানানো ছাড়া কিছুই পারিনা। সেখানে ও বলতে গেলে সবই পারে। তো চা নিয়ে আমি যখন ওনাদের সামনে গেলাম। আম্মু আমার বিষয়ে কিছু বলার বাহানা পেয়ে গেলেন। চা টা যে আমিই বানিয়েছি আর এই চায়ের কদর কতখানি তাও বললেন। ওনারা চা খেয়ে যা বললেন তা শোনার জন্য আম্মু আব্বু আপু আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। উনারা প্রথমে আপুর কাছে জানতে চাইলেন এরকম ভাবে চা বানাতে পারে কিনা।
আপু বলল সে পারেনা। কারণ রহিম ভাইয়ের মতো আমিও ব্যাপারটা সিক্রেট রেখেছিলাম। আপুর মুখে না শুনে তারা বললেন তারা আপুকে নয় আমাকে বাড়ির বউকরতদ চায়। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। আব্বু আম্মু ও হকচকিয়ে গেলেন আপু তো শকড্ আর রাগে ফুসছে। এক কাপ চায়ের কাছে ও হেরে গেলো। এতো রিতীমতো ওর অপমান। আমি মনে মনে বলছি আরো বলো চা বানাতে। কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে আমি বললাম, আব্বু আমাকে একটা দোকান খুলে দাও তো। এমন পরিস্থিতীতে আমার মুখে এই কথা শুনে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে পরলো। আব্বু রাগী দৃষ্টিতে বলল, কেন?
আরে আমি তো কিছুই পারিনা। না ঘরের কোনো কাজ না পড়া লেখায় ভালো। শুধু পারি চা বানাতে। আর চা এতই ভালো বানাই যে সবকিছু এর নিচেই চাপা পড়ে গেলো। তাই ভাবছিলাম এতো দামি চা ফ্রি ফ্রি মানুষদের না খাইয়ে দোকান খুলি। এক কাপ চা অনলি একহাজার টাকা। তুমি এই আংকেলরা সবাই আমার থেকে চা কিনে খাবা। আর কয়দিনে আমি বড়োলোক। তখন আর এই বই ফই এর মুখ ও দেখা লাগবে না। আমার দোকানের নাম হবে তৃপ্তি বিবির চা ঘর।
ঐ যে কোথায় যেনো আছে না করিমন বিবির ফেমাস পিঠা ঘর অনেকটা ঐ রকম।
কথা শেষ করে তাকিয়ে দেখি সবাই আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন পর পাত্র পক্ষরা বিদায় নিলো। আব্বু ছাফ জানিয়ে দিলো এখন আমার বিয়ে দেবেন না। আর আপুর বিয়েও ওখানে দেবেন না। ওনারা যেতেই আমি আবার দোকান খুলে দেওয়ার কথা বলতেই আব্বু দাঁত কিড়মিড় করে বলে দিলেন এই বাড়িতে চা নিষিদ্ধ। কিন্তু কিছুদিন পরেই আমার চায়ের টানে আব্বু নিজের সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলেন। তবে আপু আর কোনোদিন চা ছুয়ে ও দেখেনি। কিন্তু এতে একটা লাভ হয়েছে। এখন বাড়িতে কেউ আসলে আম্মু আমাকে আর চা বানাতে বলে না।