ঘড়িতে ৮ টা ৫০ হয়ে গেছে , আজ মনে হয় দুটোই মিস করলো- ভাবতে ভাবতে লিফটের দরজার সামনে এসে দেখলো নিচ থেকে দরজাটা ঠিকঠাক বন্ধ হয়নি । এই এক বিরক্তকর ব্যাপার এই সময়ে ! অগত্যা ধুমাধুম আওয়াজ করে নিচে নামতে থাকলো তিতির । নামার পথেই শুনতে পেলো কোনো এক ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসছে ” আ চল কে তুঝে ম্যা লেকে চালু এক আইসে গগন কে তালে “,দাদানের গলার সেই গান , দাঁড়িয়ে যে দু মিনিট শুনবে তারও উপায় নেই। টোটো ধরে যখন স্টেশনে পৌছালো ততক্ষনে লেডিস স্পেশাল আগরপাড়া পৌঁছে গিয়ে থাকবে হয়তো ! তাও নির্দিষ্ট জায়গায় একবার না গিয়ে থাকতে পারলো না সে – না কেউ নেই, মুখটা তেঁতো হয়ে গেলো তিতিরের । তাঁর কি আর ওতো সময় আছে তিতিরের জন্য অপেক্ষা করার ! আবার গোটা একটা সপ্তাহের অপেক্ষা!
সেই ক্লাস ইলেভেন থেকে চলছে এই সাপ্তাহিক দেখা সাক্ষাৎের ব্যাপারটা । মাধ্যমিকের পর তিতির বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে ভর্তি হয় বেলঘরিয়া মহাকালী বিদ্যালয়ে । সেদিন ছিল একাদশ শ্রেণীর কেমেস্ট্রি পরীক্ষার দিন,এই লেডিস স্পেশালই ভরসা ছিল সেদিন । দৌড়ে ট্রেনে উঠতে গিয়ে একবার যেন মনে হলো কেউ পড়ে গেলো , ঘুরে দেখার সময় ছিল না তিতিরের। ট্রেনে উঠে খেয়াল পড়লো একজন পড়ে গেছে স্টেশনে । জানলা দিয়ে তাকাতেই অবাক – আরে এতো সেই মুখ সেই চোখ সেই একই চেহারা । পা দুটো দুলে গেলো ,নামবার চেষ্টা করাটাও বিফলে গেলো কারণ ট্রেনটা ততক্ষনে ছেড়ে গেছে প্লাটফর্মটি , সাথে সেই মুখটিও ।সারাদিন খুব মানসিক চাপে কাটলো তিতিরের । পরীক্ষাটাও মনমতো হলোনা ।পরের দিনও একই সময়ে একই জায়গায় তিতিরের চোঁখদুটি খুঁজতে থাকলো কালকের সেই মানুষটিকে ।এই একই টানে কেটে গেলো পরপর দু-তিনটে দিন ।আশাহত হতে হতে মানুষের আশাটাও যেন মরে যায় ,তিতিরের ক্ষেত্রেও তাই হলে বেমালুম ভুলে গেলো ।
পরের মঙ্গলবার পরীক্ষা শেষ , জমিয়ে আড্ডা মারার দিন ছিল সোহিনীর বাড়িতে। বেশ সেজেগুজেই চলছিল মনখুশ করতে , লেডিস স্পেশাল ঢুকতেই লাফ দিয়ে উঠতেই খেয়াল হলো ভদ্রলোক নেমে গেলেন ।
কিংকর্ত্বব্যবিমূড় হয়ে নামতেও ভুলে গেলো যেন তিতির । আফসোস মাঝে মাঝে অনেককিছু মাথায় খেলিয়ে দিয়ে যায় ।হটাৎ খেয়াল হলো আজ মঙ্গলবার,আগের দিন মঙ্গলবারই ছিল।তাহলে হয়তো এই দিনটাতেই উনি আসেন সুতরাং পরের সপ্তাহ অবধি অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার রইলো না ।পরের মঙ্গলবার ট্রেন না ধরে দাঁড়িয়ে গেলো তিতির ,না আজ নেই তো ! তাহলে ? আশাহত হয়ে স্টেশনেই একটা সিট্ খুঁজে নিয়ে কানে হেডফোন দিয়ে বসে পড়লো , আর তাতে হয়ে চলেছে “যদি তারে নাই চিনি গো সেকি আমায় নেবে চিনে!” হটাৎ চোখের সামনে “দিদিভাই ধুঁপ নিবি? মাত্র দশ টাকা, নে না দুটো ! একটু ভাত খাই আজ ।”
মাত্র তিনমাস হয়েছিল তিতিরের দাদান তিতিরকে ছেড়ে চলে গেছে । একদম অবিকল তিতিরের দাদাই, সে স্বপ্নে রোজ আসলেও এই প্রথম এইভাবে একই রূপে ওর সামনে- চমকে গেছে তিতির ।আপনি কোথায় থাকেন জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারলো নৈহাটিতে উনি একা থাকেন ,জীবিকা বলতে প্রতিদিন সকালে লেডিস স্পেশাল ধরে ধুঁপ বিক্রি করা আর এক একটা স্টেশনে একেকদিন নেমে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করা। মঙ্গলবার করে খড়দাতে নামার দিন ওনার ।
যদিও একাদশ শ্রেণীতে হাত খরচটা বেড়ে চল্লিশ টাকা হয়েছে তাও অকারণে কুড়ি টাকা বেরিয়ে গেলে দিনের শেষে হিসেবে মেলাটা কঠিন হয়ে যাবে । কিন্তু সময় অল্প যা ডিসিশন নেওয়ার নিয়ে নিতে হবে, চটপট ভাবলো যাতায়াত টা না হয় হেঁটে সারা যাবে কিন্তু মা ! চিন্তার মাঝেই আবার বললেন “নিবি নাকি একটা? দারুন গন্ধ!” কথার ধরনও তো পুরো দাদান ! ব্যাগ থেকে দুটো দশ টাকা বের করে দুটো ধুঁপ কিনে নিল । মাকে বলতে হবে এই মাস থেকে মাসকাবাড়ি ধুঁপকাঠির দায়িত্বটা তিতিরের । সেই থেকে তিন বছর ধরে এই ব্যবস্থা ।
স্টেশনে ঢোকার মুখে প্রতি মঙ্গলবার দেখা করে তিতির ওনার সাথে , একটা সপ্তাহ না দেখলে ছটফটানি আসে উভয় পক্ষেই । আজ অনেকটাই লেট হয়ে গেছে পরের ট্রেনও চলে গেছে । উনিও চলে গেছেন হয়তো ,কলেজে খুব একটা তাড়াও নেই তাই হেডফোনটা বের করে বসে পড়লো । কিছুটা আশাযে ছিল না সেটা বলা তিতিরের মনের পক্ষেও সম্ভব নয় ।পরের ট্রেন এনাউন্স করে এসে বেরিয়েও গেলো , তিতির নড়লো না ।কানে বেজে চলেছে “সুরাজ কি পেহেলি কিরণ সে আশাকে সাভেরা জাগে,চন্দনকি কিরণ সে ধুল কার ঘনঘোর অন্ধেরা ভাগে ” হটাৎ “দিদিভাই বসে আছিস কলেজ যাবি না ?আমি ভাবলাম চলে গেছিস! শরীরটা ভালো নেই রে ভাই, তাই নেমে বসে জিরিয়ে নিলাম খানিক ! চোঁখ ভরে জল আসছিলো তিতিরের মনে হচ্ছিলো উঠে জড়িয়ে ধরে বলে –
ভাগ্গিস ট্রেনটা ধরিনি বসে আছি, এই তো তুমি এলে !
দাদান ও দাদান
তোমায় যে খুব মিস করি আমিও তো আসি তুমি আসবে বলে
হেডফোনে বেজে চলেছে
“আ চল কে তুঝে ম্যা লেকে চালু এক আইসে গগন কে তালে “