নিজের মনেই দুলে চলেছে পিয়া । বসে থাকলেই পিয়া দোলে সারাক্ষণ আগুপিছু । পিয়া কথা বলতে পারে না। শুধু কথা নয়, পিয়া নিজে নিজে কিছুই করতে পারে না । চান ,খাওয়া থেকে শুরু করে বাথরুমের সব কাজই ওকে করিয়ে দিতে হয় । খিদে, ঘুম কোন কিছুরই প্রকাশ নেই । শুধু যেটা খেতে ভালোবাসে, সেটা মাঝে মাঝে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় …ক্ষনিকের খুশিতে ঝলমল করে ওঠে ওর মুখ, হাততালি দিয়ে ওঠে একগাল সরল ,নরম হাসিতে মুখটা ভরে যায় । অথচ, পিয়া কিন্তু এমনটা ছিল না । জন্মগতভাবে পিয়া অ্যাবনরমাল নয় । ছোটবেলায় বেশ কথা বলতো কত দস্যিপনাও করেছে । তবে স্কুলে ভর্তি হবার আগে থেকেই ও এরকম হয়ে যায় । সঠিক কারণটা কারও জানা নেই। পড়শীরা বলে থাকে, ছোটবেলার দুষ্টুমির কারণে পিয়ার মা নাকি একবার রেগে গিয়ে এমন ভাবে তার গলা টিপে ধরে যে তার চিৎকারে পাড়াপড়শীরা এসে মায়ের রোষ থেকে মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় । কারো কারো সন্দেহ যে ওইটুকু মেয়ের ওপর মাঝে মধ্যে মায়ের ওইরকম পাশবিক অত্যাচার পিয়ার অ্যাবনরমালিটির কারণ ।
পিয়ার একটা বোন আছে, রিয়া । রিয়া দিদির দেখভাল করে। স্নেহময় বাবু ছোটবেলা থেকে মেয়ে রিয়াকে পড়াশোনা শিখিয়ে শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। পড়াশোনা করার কোনও চেষ্টা বা ইচ্ছে ছিল না তার । কোনরকমে ক্লাস টেন অবধি টেনে লেখাপড়ায় জলাঞ্জলি দিয়ে সে স্কুল জীবনের সমাপ্তি ঘটায় । এরপর তাকে আর কোনদিনও কেউ স্কুল-কলেজের চৌহদ্দি অবধি নিয়ে যেতে পারেনি । রিয়া চলে তার নিজের মেজাজে । ইচ্ছে হলে রাঁধে, বাড়ে, ঘরকন্না করে… ইচ্ছে না হলে চিঁড়ে, মুড়ি খেয়ে ও খাইয়েই দিন কাটায় । সকাল থেকে শুরু হয় তার পাড়া বেড়ানো পাড়ার পান বিড়িওয়ালা, রিক্সাওয়ালা বা কোনও মুদিখানার চটুল দোকানী, তাদের সাথেই ওর যত ভাবসাব । তারপর আছে টিভিতে একের পর এক হিন্দি ,বাংলা সিরিয়াল সব শেষ করে ইচ্ছে হলে সে দিদিকে চান খাওয়া করায়, নয়তো অনিচ্ছাভরেই ফেলে রাখে ।
আজ দুটো ভাত, আলু সেদ্ধ আর ডাল রেঁধেছে রিয়া । সারাদিন পাড়া বেরিয়ে এটুকুর বেশি আর হয় না… গজগজ করতে করতে দিদিকে টেবিলে নিয়ে বসায় খাওয়ানোর জন্য ” হাড়মাস কালি করে দিলো আমার, নিজেও মরে না আর আমার হাড়ও জুড়োয় না , কত দিন যে এভাবে টানব” বলতে বলতে এক থাবড়া ভাত, আলু সেদ্ধ চটকে দিদির মুখে ঢোকায় । “উফ কতক্ষণ ধরে আর মুখেরটা নিয়ে জাবর কাটবি খা তাড়াতাড়ি , গিলে উদ্ধার কর” বলে মুখের খাবারটা শেষ হতে না হতেই আরেকটা গ্রাস দিদির মুখে ঠুসে দেয় । দম বন্ধ হয়ে আসে পিয়ার কাশির দমকে চোখ ঠিকরে বেরোয় দুম দুম করে পিঠে দু এক ঘা দিয়ে রিয়া পাগলের মতো চেঁচাতে থাকে….
__ “মর, মর…. তুই কি আমায় খেতে জন্মেছিস? আমি মরলে তোর শান্তি , না রে ?
পিয়া কাঁদতে জানেনা… পিয়া দুঃখ প্রকাশ করতে জানে না । মরা ছাগলের মত শূন্য চাহনি নিয়ে একদৃষ্টে বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে ….কে জানে, ওর অবোধ্য দুটো চোখ কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা অবহেলা পড়তে পারে কিনা… মাথাটা দুদিকে দুলিয়ে বোঝাতে চায় অপ্রকাশিত কষ্টটা , তারপর যথাসাধ্য তাড়াতাড়ি গিলে নিতে চেষ্টা করে মুখের গ্রাস টা ।
যতদিন বাবা স্নেহময়বাবু বেঁচে ছিলেন , ততদিন নিজে হাতেই মেয়ের দেখভাল করেছেন । দুহাতে কুটোটি নাড়ে নি রিয়া । আজ যত জ্বালা যন্ত্রণা, আক্রোশ জমা হয় রিয়ার চোখে স্বর্গীয় বাবার ওপর , মায়ের ওপর , নিজের ভাগ্যের ওপর…. গোটা দুনিয়ার ওপর ।
রিয়া আজ মায়ের লাল শাড়িটায় সেজেছে । যত্ন করে চুল বেঁধে , লাল টিপ পড়ে চটিতে পা গলায় । আজ দুলু তার পানের দোকানটা বন্ধুর হাতে দু এক ঘন্টার জন্য ছেড়ে রেখে ওর সাথে দেখা করবে কথা দিয়েছে । দুলু ওর বয়ফ্রেন্ড…. এবছর ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে একটা পাথর বসানো পেতলের আংটি আর গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করেছে । বিনিময়ে রিয়ার যৌবনোদ্যত দেহটার প্রতি কামুক দৃষ্টি তার । ঘরে তার বাঁজা বউ…. সন্তানের অভাবে সুখ-শান্তির অভাব । তাই বাইরে ভদ্র ঘরের মেয়ে রিয়ার সাথে ফষ্টিনষ্টি করে সে সাময়িক সুখের সন্ধান পায় ।
দিদিকে হল ঘরে বসিয়ে রেখে বাইরে থেকে দরজা টেনে দেয় রিয়া তারপর দুলুর খোঁজে পান বিড়ি দোকানটার দিকেই এগোয় …
__ বাঃ লাল শাড়িতে কি সুন্দর লাগছে গো তোমায়… বলি , একটু কাছে এসো…
__ যাহ , রাস্তায় সবার সামনে এসব হয় নাকি ? চলো না ,একটা খাবার দোকানে বসি…
__ কোন দোকানে যাবো….. বন্ধুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এক ঘন্টা বসিয়ে রেখে এসেছি… তাছাড়া, সেখানেও তো লোকজনের ভিড় ….তোমায় একা পাই কি করে বলতো?
__ তাহলে আর কি ? পাশের ঐ মাঠটায় চলো, প্রতিবারের মত….
__ না ,বলি কি, তোমাদের বাড়িটা তো ফাঁকা… তোমার ওই পাগলি দিদি টাই শুধু আছে চলো না, ওখানে বসেই আজ একটু গল্পগুজব করি…
রিয়ার মনোমত হয় দুলুর প্রস্তাবটা সাথে করে নিয়ে যায় সে তার বাড়িতে।
দুলু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে রিয়ার পাশে। এক হাত দিয়ে তাকে কাছে টেনে নেয়। ধীরে ধীরে ঠোঁটটা নামিয়ে নিয়ে আসে রিয়ার রাঙানো ঠোঁটের ওপর ঠোঁট ও হাত ছুঁয়ে যায় তার শরীরের বিভাজনগুলোকে কানে, গলায় , ঘাড়ে শরীরে মৃদু কম্পন অনুভব করে রিয়া। পরম আবেশে চোখ বুজে দুলুর তপ্ত শরীরের চাপে নিজেকে সঁপে দেয়। ধীরে ধীরে শাড়ির দিকে হাত বাড়ায় দুলু এক ঝটকায় সেটা খুলে রিয়াকে জাপ্টে ধরে সে রিয়া নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে দুলুর আগ্রাসী ক্ষুধার কাছে ।
ই ইই ই ই…..
বিকট এক চিৎকারে হতচকিত হয়ে ওঠে ভালোবাসা রত রিয়া ও দুলু । পিয়া দুহাত মাথার ওপর তুলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে একনাগাড়ে চিৎকার করে চলেছে আর তার সাথে তার পা দুটিকে মাটিতে প্রাণপণে আঘাত করে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে । ছিটকে উঠে যায় দুলু । স্বাভাবিকভাবেই বিরক্তি ভাব তার মুখে চোখে । ঘটনার আকস্মিকতায় রিয়াও হতভম্ব …. দুঃখ, হতাশা ও না পাওয়ার ব্যর্থতায় চরম নৈরাশ্য তার মুখমন্ডলে । রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে যায় সে । পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে দিদির মুখ । পিয়ার মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোতে থাকে…. হাতের কাছের কুশনটার সদ্ব্যবহার করে রিয়া… শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দিদির মুখটাকে চেপে দেয় আর পাগলের মত চিৎকার করে বলতে থাকে,
__ মর মর, আজ তুই মরেই যা তোর জন্য আমার জীবনে সুখ নেই আমি কিছুই পাবো না তুই বাঁচলে
ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসে পিয়ার শরীরটা ….চোখ দুটো যেন ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায় বাঁচার জন্য শেষবারের মতো লড়াই করতে করতে একসময় অবসন্ন হয়ে ঢলে পড়ে….
পিয়ার খোলা দুটি চোখে বোনকে বাঁচানোর আকুতি, বোনের ভুল পথে যাওয়ার ইচ্ছাকে বাঁধা দেওয়ার প্রবল চেষ্টা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে বোবা নির্বাক দৃষ্টিতে পরিণত হয় হয়ত অসহ্য শারীরিক কষ্টে , হয়তো বা বোনকে পথভ্রষ্ট হওয়ার থেকে বাঁচাতে না পারার জন্য নিজের প্রতি অপরিসীম ধিক্কারে তার ভাষাশূণ্য চোখ থেকে দু ফোঁটা জল যেন আপনিই গড়িয়ে পড়ে, তার প্রাণহীন দেহটার শুকনো দুগাল বেয়ে ।