‘আমরা যেটা করছি সেটা পাপ নয় তো?’, শ্রীময়ী জানতে চাইল।
‘পাপ! এটাকে যদি তুমি পাপ বলো, তবে একটা অসহায় মানুষকে, মানুষ কি বলছি, প্রাণীকে একলা ফেলে চলে যাওয়াটা পাপ নয়? কাউকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে আমি তো মারিনি বলাটা পাপ নয়?’
সুখেনবাবুর কথার কোন উত্তর নেই শ্রীময়ীর কাছে।
‘এই বয়সে এসে আর নতুন করে কিছু ভাবতে যেওনা শ্রীময়ী। আমরা পাখির বাবা-মা আর আমরা ওর ভালো ছাড়া খারাপ চাইতে পারবো না কোনোদিন। তাই বিশ্বাস করো ওর মৃত্যু কামনা করাই এখন ওর জন্য সবচেয়ে মঙ্গল’, একটানা বলে গেলেন সুখেন।
শ্রীময়ী অনেক ক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর চোখ মুছতে মুছতে বললো, ‘আমি রান্না ঘরে যাচ্ছি ভাত ছাপাতে। ঘরে তেমন কিছুই নেই, পারলে কিছু বাজার এনে দিও।’
মাথার মধ্যে ভন ভন করতে থাকা একগাদা চিন্তা আর হাতের মধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া মাঝবয়সী নাইলনের ব্যাগটা নিয়ে সুখেন বাবু বাজারের পথে এগোলেন।
গতমাসে সুখেনবাবু আটষট্টিতে পা রেখেছেন। এক সরকারি দপ্তরের গ্রুপ ডি স্টাফ থেকে অবসর নিয়েছেন কয়েক বছর আগে। কিন্তু জীবনে তার অবসর জোটেনি । একমাত্র মেয়ের জন্য অন্তহীন দুশ্চিন্তা তার পিছু ছাড়েনি আজও। কালো ফ্রেমের চশমার নিচের কাঁচ মোটা হতে থেকেছে সময়ের সাথে সাথে। এখন তারও মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে। শ্রীময়ীর সঙ্গে তার সংসারের বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই। বিয়ের এক বছর পর যখন শ্রীময়ী অন্তঃসত্ত্বা হলো, ওরা দুজনেই মন প্রাণ দিয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলো যেন ঘর আলো করে একটা কন্যাসন্তান আসে। ঈশ্বর ওদের এই মনোবাঞ্ছা থেকে বঞ্চিত করেন নি কিন্তু ওরা বঞ্চিত হয়েছিল অন্য জায়গায়। জন্মাবার পরই জানা যায় পাখিকে ঈশ্বর বিশেষভাবে তৈরি করেছেন। তাই চিকিৎসকদের কাছ থেকে নাইন্টি পার্সেন্ট শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতার সার্টিফিকেট নিয়ে পাখি বাড়ি এসেছিল।
তারপর অনেক চেষ্টা করেও পাখির শারীরিক কোনো উন্নতি ঘটানো যায়নি। তাই শ্রীময়ী আর সুখেনবাবু ওকে আঁকড়ে ধরে পরম যত্নে বড় করেছেন। ওর জন্য কোনদিন এতটুকু দুঃখ প্রকাশ করেননি ওরা। তারপর ধীরে ধীরে পাখি বড় হল,ওর মুখে আওয়াজ ফুটল। কিন্তু সে আওয়াজ পাখিদের ডাকের মতোই, মানুষের মতো শব্দ শোনা গেল না।
— কাল একবার কনকপুর যাবে তুমি?
— কেনো, ওই তান্ত্রিক এর কাছে যেতে বলছ?
— হ্যাঁ, ওঁর তাবিজে কোন কাজ হলোনা তো। তাই বলছিলাম…
— কি হবে বলোতো গিয়ে? সেবার যখন গিয়ে বললাম, ‘একটা মানুষকে মারতে হবে’ তিনি একটুও চমকান নি। তারপর যখন বললাম, ‘নিজের মেয়েকে মারবো ব’লে একটা তাবিজ বানিয়ে দিন’। ক্ষেপে গিয়ে বললো, ‘তুই পাগল হয়েছিস নাকি?’ তারপর তো হাজার টাকার বিনিময়ে ওই তাবিজ বানিয়ে দিলো। কোন্ বিশ্বাসে যাই বলো তো আবার?
— তাহলে কি হবে এবার, কিছু তো একটা করতেই হবে। সময় যে খুব কম…
শ্রীময়ীর একটা কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে গত বছর। এখন কোনমতে একটা দিয়েই টিকিয়ে রেখেছেন নিজেকে। সুখেনবাবু দু’বছর আগে মুখোমুখি হয়েছেন একটা স্ট্রোকের। আর দ্বিতীয়টা কবে হানা দেয় সেই ভয়ে এখন দিন কাটে। ওরা দুজনেই বুঝেছে ওদের মেয়াদ এখন শেষের দিকে, কিন্তু পাখিকে একা ফেলে রেখে ওরা চলে যাবে কিভাবে! সেই যন্ত্রণা এখন কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে প্রতিটা মুহূর্ত। আত্মীয় বলতে তেমন কেউ নেই আর থাকলেও কেউ কি শ্রীময়ীর মত যত্ন নেবে ওর! তাই ওদের এখন দিনরাত একটাই কাজ- পাখির মৃত্যু কামনা। কারণ ওদের চলে যাওয়ার পর পাখির কষ্টের কথা ভাবলে অস্থির হয়ে ওঠে ওদের সমস্ত পৃথিবী।
আজ সকাল দশটা নাগাদ সুখেনবাবু বাইরে থেকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পাখি এখনো ওঠেনি?’
শ্রীময়ী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘আর বোধহয় উঠবে না। কাল তোমার দেওয়া ঘুমের ওষুধের সবকটা বড়ি আমি ওকে খাইয়ে দিয়েছি। ভাবতে পারছো আমি নিজের হাতে নিজের মেয়েকে মেরে ফেলেছি।
— শ্রীময়ী…
এত নিষ্ঠুর হতে পারলাম কি করে গো আমি!
— নিষ্ঠুর না শ্রীময়ী, তুমি জানো না তুমি কত ভালো কাজ করেছো। আজ আমাদের কিছু হয়ে গেলে ওর কি পরিণতি হতে পারতো তুমি ভেবে দেখেছো?
— ভেবে দেখেছি কিন্তু আজ আর কিছু ভাবতে পারছিনা।
— কেন শ্রীময়ী কেন? তুমি একবার মনে করে দেখো, ছোটবেলা থেকে আজ অব্দি ওর গায়ে এতোটুকু আঁচ লাগতে দিইনি আমরা। যেভাবেই হোক ওর ভালো করার চেষ্টা করেছি সবসময়।আর আজ যেটা করা হলো সেটাও তো ওর ভালোর জন্যই। তবে তুমি কেন নিজেকে দোষারোপ করছো!
— আমি জানিনা, কিচ্ছু জানি না।
— তোমার মনে আছে, ডাক্তার বলেছিলেন দ্বিতীয় সন্তানের এরকম হওয়ার কোন চান্স নেই তবুও আমরা দ্বিতীয় সন্তানের চেষ্টা করিনি। কারণ আমরা পাখিকে ভালোবেসেছি, ভয় পেয়েছি ওর ভালোবাসায় যেন ভাগ না বসে।
হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে একটা গোঙানির শব্দে ওরা ছুটে গিয়ে দেখল, পাখি বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। যেন মনে হচ্ছে পাখি সবটা বুঝতে পেরেছে আর তাই ওর চোখে মুখে একটা বিদ্রোহের আগুন… আমি বাঁচতে চাই আমায় মেরে ফেলো না।
সুখেনবাবু বারান্দায় বসে বসে ভাবছেন কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছেন না ঘুমের ওষুধগুলো কেন কাজ করলো না। তিনি শ্রীময়ীকে ডেকে বললেন, ‘তুমি ঠিকঠাক খাইয়েছিলেতো ওষুধগুলো?’
শ্রীময়ীর কাছে কোন উত্তর ছিল না। তবে ওর চোখ ভরে উঠেছিল জলে। সুখেনবাবু সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরে না না সন্দেহ নয়, শুধু হিসেবটা কিছুতেই মিলছেনা। আর তাছাড়া আমি নিজে যা করতে পারবো না, তা নিয়ে সন্দেহ করি কি ক’রে বলতো!
— সেই।
— তুমি তো জানো, এই বৃদ্ধ বয়সে গায়ের জোর নেই আমার, শুধু মনটাকে জোর দিয়ে রেখেছি এখনো। মনে পড়ে সেইবার যখন ওর মুখে বালিশ চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, তুমি জানো আমার নিজের দম বন্ধ হয়ে আসছিল? তাইতো পারিনি সেদিন ওর দম বন্ধ করতে।
— হুম, জানি। আর তারপর বাকি রাতটা কিভাবে কেটেছে তাও আমার মনে আছে।
— তবে তুমি বলো,আমি কি করে…?
–আমি আর কি বলবো,আমি কি নিজেও পেরেছিলাম ওকে ছাদ থেকে ঠেলে নিচে ফেলতে! ওই মুহূর্তে আমার শরীরের সমস্ত শক্তি যেন হারিয়ে গিয়েছিলো। পাখি কে ঠেলা তো দূরের কথা আমি নিজে এক পাও নড়তে পারি নি।
— আর তারপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে।
— কেন জানো, কারণ তখন আমি পাখির থেতলে যাওয়া রক্তাক্ত চেহারাটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম।
— সবই বুঝি আমি শ্রীময়ী, কিন্তু কি করি বলতে পারো! যখন ভাবি আমরা ছাড়া ওর জীবনটা কতটা অসহায় হয়ে উঠতে পারে, ভয়ে যেন কুঁকড়ে যাই।
— আচ্ছা, পাখি কি সব বুঝতে পারে?
— কি জানি! কিন্তু যদি বোঝে, তাহলে ও কতটা ঘেন্না করবে আমাদের, ভাবলেই ভয় করে।
— তাহলে এখন উপায়…
— উপায়, উপায় একটা আছে শ্রীময়ী, কিন্তু তুমি কি পারবে?
— নিশ্চয়ই পারবো, পারতে যে হবেই।
— দেখো শ্রীময়ী, এই জীবনের প্রতি আর কোন টান অনুভব করি না। এত কষ্ট করে বেঁচে থাকার চেয়ে মরণ ঢের ভালো।
— হঠাৎ এসব বলছো যে!
শ্রীময়ী কিছুই বুঝতে পারলো না।
— বলছি কারণ আমি এবার একটু অন্যরকম একটা কথা বলতে যাচ্ছি তোমায়।
— কি কথা গো?
— চোখের সামনে এখন একটাই পথ দেখতে পাচ্ছি আমি…
— কি পথ বলো আমায়
— তবে শোনো, আমাদের তিনজনেরই রাতের খাবারে যদি তুমি বিষ মিশিয়ে দাও, তাহলেই সব শেষ।
শ্রীময়ী যেন কিছুটা শক্ত হয়ে উঠলো। সুখেন জানতে চাইলো, ‘তুমি কি পারবে এমনটা করতে?’
শ্রীময়ীর চোখ ছল ছল করে উঠলো। বললো, ‘পারবো,পারবো খুব পারবো। আমিতো এমনই একটা পথের খোঁজে ছিলাম।
— শ্রীময়ী…
— হ্যাঁ গো, পাখির মৃত্যু না দেখেও মরতে পারছি না, আবার ওর মৃত্যুর পর বাঁচবো কিভাবে সেটাও ভাবতে পারছি না। তাই এটাই হবে সবচেয়ে ভালো পথ। তুমি একদম ঠিক ভেবেছো।
— সেই ভালো,তোমারও যখন মত রয়েছে, তবে তাই হোক।
সুখেনবাবু আর শ্রীময়ীর সংসার যতটা পুরনো হয়েছে তার দ্বিগুণ পুরনো তাদের এই বাড়ি। পোড়ো বাড়ি বললেও ভুল হবে না। তিনটে জীব, তবে আওয়াজ কারোরই তেমন পাওয়া যায় না। আর জীবন সামলে এ বাড়ি সামলানো তাদের সাধ্যের বাইরে। তাই ঘরের আগোছালো অবস্থা যেন ওদের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। একটা মাঝারি মাপের ঘর, তার মধ্যে একটা বিছানা আর কিছু আসবাবপত্র যেন কেউ জোর করে ভরে দিয়েছে। এভাবেই চলছিলো এই সংসার। কালকের বিষময় রাতের পর আজকের ভোর যেন বেশ থমথমে আর শান্ত। অন্যদিনের মত কোনো নাক ডাকার শব্দ নেই, শুধু ওই স্যাঁতস্যাঁতে বিছানাটায় তিনটে লাশ যেন নিজেদেরকে জাপটে ধরে শুয়ে আছে।
যেন মৃত্যুর পরও কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না। একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা যেন কোন স্থিরচিত্রের ছায়াছবি চালিয়েছে গোপনে। তারপর হঠাৎ এই নিস্তব্ধতা ছেড়ে, আটকে যাওয়া নিঃশ্বাস ফিরিয়ে নিয়ে উঠে বসলো পাখি। জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকলো। তারপর একটু সামলে নিয়ে এদিক ওদিক চেয়ে দেখলো সুখেনবাবু, শ্রীময়ী দুজনেই ঘুমোচ্ছে। পাখি ওর স্বল্প ক্ষমতা দিয়ে ওদের বুকের উপর হাত নেড়ে ডাকার চেষ্টা করলো, কিন্তু ওরা জাগলো না। পাখি ওর আশেপাশের জিনিসপত্র মাটিতে ফেলেও যখন ওদের জাগাতে পারলো না, চিৎকার করার চেষ্টা করলো কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হলো। তারপর দেখলো সুখেনবাবু আর শ্রীময়ীর মুখ দিয়ে ফেনার মতো কিছু বেরিয়েছে। পাখি কিছু বুঝলো না। অনেক কষ্টে বিছানা থেকে নিচে নেমে দরজার দিকে গেলো।
কাল রাতে দরজা বন্ধ করতে বোধহয় ভুলে গেছে কেউ তাই খোলা দরজা দিয়ে পাখি চিৎকার করতে করতে রাস্তায় নেমে পড়লো। অপুষ্ট হাত পা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে পাখি এগিয়ে চললো রাস্তায়। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে অনবরত। রাস্তায় যাকেই দেখছে অদ্ভুত গলার শব্দে যেন কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু আশেপাশের লোকেরা কিছু বুঝতে পারছে না। বরং ওর এরকম আচরণে দেখে সবার যেন খানিকটা মনোরঞ্জন হচ্ছে। সবাই হাসছে…পাখি কাঁদছে…ছোট ছোট বাচ্চারা কেউ ঢিল ছুড়ছে কিছু জন আবার ওর পোশাক ধরে টানছে। পাখি তবু এগিয়ে যাচ্ছে।
ওর চোখ দিয়ে গড়াতে থাকা জল কেউ দেখতে পাচ্ছে না। তারপর রাস্তায় মাঝের একটা বাম্পারে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল পাখি। রাস্তার মানুষগুলো ওকে ঘিরে ধরলো। কারো হাতে ছোট লাঠি, কারো হাতে ঢিল। পাখি খানিক প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা। সবাই ওকে আরো ঘিরে ধরতে লাগলো। ভিড় আরো গাঢ়ো হতে শুরু করলো। মাটিতে শুয়ে থাকা পাখি আকাশের দিকে চেয়ে শুধু গোঙাতে থাকলো আর বাড়তে থাকা ভিড় ক্রমে ক্রমে ওর আকাশ ছোট করতে লাগলো। তারপর আলো কমতে কমতে যখন পাখির চোখে শুধু অন্ধকার, সুখেন বাবু চোখ খুললেন। প্রচন্ড জোরে নিঃশ্বাস পরছে, একটুও যেন নড়তে পারছেন না। তারপর হাত নেড়ে দেখলেন পাশে পাখি শুয়ে রয়েছে আর তার পাশে শ্রীময়ী। এতক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুখেনবাবু, বুঝলেন এতক্ষণ তিনি যা দেখেছেন সব স্বপ্ন। স্বপ্ন নয় দুঃস্বপ্ন ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন।
বারান্দার আরাম কেদারায় বসে সুখেন বাবু যেন কোন গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন। শ্রীময়ী পাশে এসে অনেকবার ডাকার পর গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেই সুখেন বাবুর খেয়াল হলো। তিনি শ্রীময়ীর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে বললেন,‘একটু বসো’। শ্রীময়ী ভাবলো হয়তো আজ আবার নতুন কোন উপায় এর কথা বলবেন সুখেনবাবু। কিন্তু হলো তার ঠিক উল্টোটা। সুখেনবাবু বললেন, ‘জানো শ্রীময়ী, কাল দোকান থেকে বিষ না আনতে পারাটা বোধহয় ঈশ্বরের কোন ইঙ্গিত ছিল। না’হলে হয়তো আজকের সকালটা…
সুখেনবাবুকে থামিয়ে দিয়ে শ্রীময়ী বললো, ‘কেন, কি হয়েছে?’ সুখেনবাবু তার স্বপ্নের কথা বললেন শ্রীময়ীকে। শ্রীময়ীর চোখ ভিজে গেল স্বপ্নের আঁচে। সুখেনবাবু বললেন, ‘আমরা হয়তো ভুল পথে হাঁটছিলাম। একবারও ভাবি নি ঈশ্বর যখন ওকে এভাবে পাঠিয়েছেন, তবে আমরা কে ওকে ঈশ্বরের কাছে পাঠাবার! তিনি নিশ্চয়ই পথ বার করবেন। আমরা বৃথাই এতো ভাবছি, যা আছে কপালে তাই হবে। আমরা যতদিন থাকবো, পাখিকেও বাঁচিয়ে রাখবো, ভরিয়ে রাখবো ভালোবাসা দিয়ে। নিজেদের মৃত্যুর কথা মনে এলেও ওর মৃত্যুর কথা ভাববো না কোনদিন। হয়তো ঈশ্বরেরও তাই ইচ্ছে, তাই হয়তো এমন স্বপ্ন দেখলাম। শ্রীময়ীর শুকোতে থাকা চোখ যেন আবার ভিজে উঠলো। বললো, ‘আমরা তো কখনো ভাবিনি এভাবে! সত্যিই তো জন্ম দেওয়ার অধিকার আছে ব’লে কি মৃত্যু দেওয়ার অধিকারও আমাদের থাকে!
ওরা একে অপরের চোখের জল মুছিয়ে দিলো অনেক দিন পর। যেন অনেকটা হালকা লাগছে আজ ওদের দুজনের। আবার জীবনে ফিরে যাওয়ার ডাক এসেছে ওদের। শ্রীময়ী বললো, ‘আজ খুব ভালো লাগছে জানো, ঠিক সেই দিনটার মত যেদিন পাখি প্রথম এসেছিল আমাদের…
শ্রীময়ী কথাটা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল। তারপর বারান্দার দেয়ালে ঝুলন্ত ক্যালেন্ডারটার দিকে তাকিয়ে কি সব দেখে বললো, ‘শুনছো, আজ তো মেয়েটার জন্মদিন! এত কিছুর মধ্যে ভুলে গিয়েছিলাম। সুখেনবাবুর মুখে যেন খুশির রেখা ফুটে উঠলো। শ্রীময়ী বললো, ‘আজ একটু পায়েস রেঁধে খাওয়াবো মেয়েটাকে। তুমি সব কিছু এনে দেবে আমায়? সুখেনবাবু সম্মতির ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘শুধু পায়েস কেন, আজ আমি ওর প্রিয় মাছ আনবো বাজার থেকে’। এই বলে সুখেনবাবু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর ঘরে গিয়ে পাখিকে ঘুমোতে দেখে একা একা বললেন, ‘ঘুমো মা তুই, আজ একটু ঘুমো। কাল থেকে আবার তোর ডাকে আমি আগের মত ঘুম থেকে জাগবো’।
সুখেনবাবু বাজারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে বারান্দায় কিছু হিসেব নিকেশ করছিলেন। তারপর দরজার বাইরে পা রাখতেই শ্রীময়ীর চিৎকারে আবার ঘরে ফিরে এলেন। ঘরে ঢুকেই দেখলেন শ্রীময়ী পাগলের মতো পাখিকে নাড়তে নাড়তে ডাকছে। তিনি শ্রীময়ীর কাছে কারণ জানতে চাইলে শ্রীময়ী বললো, ‘দেখো না ওকে কত করে ডাকছি তবু কিছুতেই উঠছে না, এতোটুকু নড়ছেনা পর্যন্ত। সুখেনবাবু ডাকলেন, ‘পাখি উঠে পড় মা, বাবা ডাকছে, পাখি, ও পাখি…’
পাখি কোনো সাড়া দিলো না। ওর নাকের নিচে হাত রেখে যেন আঁতকে উঠলেন সুখেনবাবু। নিঃশ্বাস পড়ছে না, হাতের নাড়ি ছুঁয়ে দেখলেন চলছে না। কি করবেন কিছু বুঝতে পারছেন না সুখেনবাবু। শ্রীময়ী তখনো কাঁদতে কাঁদতে ডেকে চলেছে পাখিকে। কিন্তু পাখি নিরুত্তর। সুখেনবাবু একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছেন পাখির মুখের দিকে। তিনি দেখলেন পাখির দু’চোখ দিয়ে নেমে যাওয়া জলের ধারা শুকিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। সুখেনবাবু বুঝলেন পাখি সব বুঝতো, তাই এই দাগ রয়ে গেছে। পাখি সব বুঝতো, তাই বাবা-মা কে দোষী করবে না ব’লে একাই এই কঠিন পথ অতিক্রম করল। সুখেন বাবু এও বুঝলেন, তার আর কোনো সকাল পাখির ডাকে শুরু হবে না।