ভেবেছিলাম ইভেন্টে আর গল্প লিখবো না l কিন্তু এমন একটা বিষয় নিয়ে ইভেন্ট l বিবর্ণ হোলি l মনে পড়ে গেলো বহু পুরোনো কথা l যা এতদিন সযত্নে মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম আমি আর আমার স্ত্রী l
আজ থেকে আটত্রিশ বছর আগের কথা l বাতাসে বসন্তের ছোঁয়া l মানুষের মনের রঙিন উৎসবের হাতছানি বসন্ত উৎসব , দোল এগিয়ে আসছে l দোলের আগের দিন ন্যাড়া পোড়া l যাকে বলে চাঁচর l কিন্তু আমাদের বাড়িতে আজ সবাই উদগ্রীব !
আমাদের দুজনের জীবনের প্রথম সন্তান আসতে চলেছে l স্ত্রী সকালেই নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছে l ডাক্তার জানিয়েছে , আজ রাত্রেই সিজার করবে l কেননা সময় হয়ে গেছে , তবু কোন প্রসব যন্ত্রণা উঠছে না l
এদিকে কাল সকালেই দোল l রঙের জন্যে আসা যাওয়ার অসুবিধে l সেইমতো সন্ধ্যের সময় আমরা হাজির হয়ে গেছি নার্সিং হোমে l মা বললো l ” কাল দোল পূর্ণিমা l পূর্ণিমা রাত আটটা থেকে পড়ে যাবে l খুব ভালো দিনেই আমাদের বংশধর আসছে “l
এবার শুরু হয়ে গেলো কি নাম রাখা হবে এই নিয়ে l স্ত্রী বেডে শুয়ে শুয়ে শুনছে l বোন বলে উঠলো l
” বসন্তে জন্ম , তাই বাসন্তী নাম রাখা হোক l ”
মা বলে l ” কেন পূর্ণিমা নামটা কি খারাপ ? আজ পূর্ণিমা l ”
বাবা হেসে বললো l ” ছেলে হলে নাম রাখবো l মুরারি , কৃষ্ণের আরেক নাম l ” বুঝলাম স্ত্রীর নাম গুলো পছন্দ হচ্ছে না l
এ সময় , ডাক্তার বাবু এলেন l ওকে আরেকবার চেক আপের জন্যে ওটিতে নিয়ে গেলো l কয়েক মিনিট বাদেই বেরিয়ে এসে আমাকে ডাকলো l দেখলাম ডাক্তারের মুখে গভীর চিন্তা l
“এখুনি সিজার করছি l পেটের মধ্যে জলটা ভেঙে গেছে l ” উনি ওটিতে ঢুকে গেলেন l আমাদের সবার মুখে চিন্তার ছাপ পড়ে গেলো l এখনও পর্যন্ত ব্যাথা ওঠেনি l এদিকে জলl তার মানে বেবি হাঁফিয়ে যাবে ! অবশ্য এসব ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা কম l
সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে l আকাশে গোল পূর্ণিমার চাঁদ l দূরে কাঁসর ঘন্টার শব্দে ন্যাড়া জ্বালানো হচ্ছে ..l আমি পায়চারি করতে করতে ঘামছি l
অবশেষে উদ্বেগের অবসান ঘটলো l নার্স এসে খবর দিলো মেয়ে হয়েছে l আমাদের সবার মুখে হাসি ফুটলো l
আমি জিজ্ঞেস করলাম l ” পেসেন্ট কেমন আছে ? ”
” ভালো l একটু বাদেই আপনাদের বেবি দেখাবো l ”
ভাই আমার সঙ্গে হ্যন্ডশেক করে বললো l ” আমি কাকু হলাম l আর তুই বাবা l ” ওর কথা শুনে মনে কিরকম একটা গর্বিত অনুভূতি হলো l ..বাবা….বাপি… l কয়েক মাস বাদেই আধো আধো স্বরে একটা ছোট্ট মেয়ে আমাকে এই সব নাম ধরে ডাকবে l কত আবদার করবে …কোলে চড়বে l
মেয়ের মুখ দেখলাম l মায়ের মতো সুন্দরী হয়েছে l বউ এখনো কিছুটা ক্লোরোফর্মের ঘোরে l আমরা এবার বাড়ি ফিরলাম l বাড়িতে ফিরেই মা বললো” কাল সকালেই পাড়াতে কয়েকটা বাড়ি মিষ্টি দিয়ে আসবো l ”
আমি বললাম l ” আমি ভোরেই নার্সিং হোমে যাবো l ” কেননা বাচ্চার জন্যে ছেঁড়া শাড়ির প্রয়োজন l
মা বললো l ” তুই ছেঁড়া পাঞ্জাবি পরে যাস l কারণ ফেরার সময় অনেকে গায়ে রং দেবে l ”
বাবা বললো l ” দুিনের মধ্যে হিজড়ের আগমন ঘটবেl ” গল্প করতে করতে রাত হয়ে গেলো l
ভোর রাত্রে টেলিফোনের এক টানা কর্কশ শব্দ l ঘর ছেড়ে বেরিয়ে খাবার টেবিলের পাশে রাখা ফোনের রিসিভারটা তুললাম l
নার্সিং হোম থেকে আসা ডাক্তার বি কে গুপ্তার কণ্ঠ ভেসে এলো l ” মিঃ চ্যাটার্জি …সরি , বেবিটাকে বাঁচাতে পারলাম না l একটু আগেই মারা গেলো l গভীর রাত থেকে শ্বাস কষ্ট শুরু হয় l নার্সের ফোন পেয়ে ছুটে আসি l চাইল্ড স্পেশালিস্ট ডাঃ নন্দীকেও ডেকে আনি l কিন্তু সাকসেস ফুল হলো না l ”
আমার কানে যেন কেউ গরম শিসের তরল পদার্থ ঢেলে দিলো l এতো আনন্দ , এতো স্বপ্ন এক নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে গেলো l আমি ভেবে পাচ্ছি না , এই মুহূর্তে স্ত্রীর মানসিক অবস্থা কি রকম ! এতো দিন যাকে পেট ধারণ করেছিল l সুমধুর স্বপ্নে মশগুল থাকতাম আমরা l কত গল্প হতো আমাদের l ছোট ছোট পা দিয়ে লাথি ছুঁড়তো বাচ্চা l আর বৌ হেসে আমাকে বলতো l ” দেখো , কি বদমাইশি করছে , বেরোবার জন্যে l ” তার ওপর এতো কষ্ট সহ্য করে সিজারিয়ান l এখন জেনে গেছে তার ফুটফুটে মেয়েটা এক রাত না কাটিয়েই মাকে ছেড়ে চলে গেলো l মা হয়ে যাকে কোলে পর্যন্ত একটু নিতে পারলো না সে l
বাড়ির লোকেরাও স্তম্ভিত ! সকাল বেলা সাইকেল নিয়ে চললাম নার্সিং হোমের দিকে l ফাগ আবিরের মাঝখান দিয়ে রং মাখতে মাখতে আমার মৃতা মেয়ে আর তার অভাগিনী মায়ের কাছে l
নার্সিং হোমে এসে প্রথম চোখা চোখি হলো স্ত্রীর সঙ্গে l আমার দিকে তাকালো l যেন যুদ্ধে হারা পরাজিত সৈনিক l দু চোখে নয়নের মণি হারানো কাতর যন্ত্রণা l পাশের বেডের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে l যেখানে মায়ের পাশে নবশিশু আনন্দে ঘুমোচ্ছে l
এখনও ওকে নার্সিং হোম আরও কয়েকদিন থাকতে হবে l এই সব দৃশ্য ওর মনকে আরও দুঃখ দেবে ! আমার কথামতো , ডাক্তার নির্দেশ দিলো স্ত্রীকে অন্য বেডে ট্রান্সফার করে দিতে l
সেদিন থেকেই এতো বছরের মধ্যে একদিনও রং খেলিনি l হোলি আজও আমাদের দুজনের কাছে বিবর্ণ l দিনটা এলেই …সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েটার মুখটা মনের মধ্যে ভেসে ওঠে l
কিছু দৃশ্য ইচ্ছে করলেও ভোলা যায় না l আজও দোলের দিন এলে আমাদের মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায় ll
( সমাপ্ত )