ছায়াযুদ্ধ

ছায়াযুদ্ধ

“তোমাকে বহুবার বলেছি পিয়াল, তোমার মা ভীষণ ই অন্তর্মুখী মানুষ।”- বাবার গলায় স্পষ্ট বিরক্তি। পিয়ালের চোখ জলে ভরে এলো। উনিশ কুড়ি বছরের মেয়েরা খুব অল্পেই কষ্ট পায়।

বাবা লক্ষ্য করলেন এবং প্রতিবারের মতো এবারও আচমকা কথা বলার বিষয় বদলালেন। ” তুমি কি আমার বাইকের চাবি নিয়েছো?” পিয়াল পকেট থেকে চাবি বার করে দিলো। বললো, “পার্ক করতে গিয়ে ডান দিকের আয়না টা ভেঙে ফেলেছি।” “বেশ করেছো, একটা আয়না কিনে এন, লাগাতে শিখিয়ে দেব।”

পিয়াল বললো না যে, কাল ও বাইক নিয়ে এলোপাথাড়ি ঘুরে বেরিয়েছে। খুব চেয়েছে একটা ধাক্কা লাগুক। হাত পা ভাঙুক। তাহলে অন্তত মা কাঁদবে।

পিয়ালের মা অদ্ভুত মানুষ। কোনো কিছুতেই উত্তেজিত হন না। রাগেন না, কাঁদেন না বা জোরে হেসে ওঠেন না। তাঁর অভিব্যক্তি সীমিত এবং কোনোরকম অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ প্রায় করেননা বললেই চলে। মায়ের এই বীতস্পৃহা পিয়াল কে পাগল করে দেয়। সম্ভবত, মা ওকে ভালোবাসেন না।

আরো যখন ছোট ছিল, পিয়াল প্রানপনে চেষ্টা করত মাকে উচ্ছসিত করে তোলার মতো কিছু একটা করতে। ক্লাস সিক্স এ অঙ্কে 100 পেল, মা শুনে শুধু বললেন, বাহঃ। বারো বছর বয়সে সুইমার হলো, মা বললেন, বেশ তো, খুব ভালো। পনের বছর এ টেবল টেনিস এ স্টেট চ্যাম্পিয়ন। মা রাতে পিজা আনলেন, উচ্ছসিত প্রশংসা , আবেগে ভেসে যাওয়া ইত্যাদি হলো না।

সেই টুর্নামেন্ট এর রানার্স আপ ছিল সৌমিলি। ওদের বাড়ি মস্ত করে পার্টি হলো, পিয়াল গেল, খেলো, জিতে গিয়েও মনে হলো যেন হেরে গেছে। সৌমিলি কে যখন ওর আত্মীয় স্বজন সুন্দর সুন্দর গিফ্ট এ ভরিয়ে দিচ্ছিলো, চ্যাম্পিয়ন পিয়াল তখন এককোনে বসে গেম খেলছে।

সেদিনের পর পিয়াল আর মা কে খুশি করার চেষ্টা করেনি। দুঃখ দিতে চেয়েছে। ইলেভেন এর অঙ্কে 35। মা বললেন, ” তোর কি অংক বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? সন্ধেবেলা গুলো আমার কাছে আয়, অনেকদিন অভ্যাস নেই, তবু দেখি যদি সাহায্য করতে পারি।” ক্লাসমেট বিদিশা 55 পেয়েও গালে পাঁচ আঙুলের দাগ নিয়ে স্কুলে এলো। পিয়াল রাগে দুঃখে জ্বলে গেল, একটা চড় খাবার যোগ্যতা ও কি তার নেই?

কলেজ শুরু হলো। একদিন দেবায়ন কে বাড়ি নিয়ে এলো পিয়াল। এবার মা বিরক্ত হবেন ঠিক। কিন্তু আশ্চর্য, এবিষয়ে বাড়িতে কেউ কোনো কথা ই বললো না। যেন দেবায়ন ছেলে বন্ধু নয়, সৌমিলি, বিপাশা, তিস্তার মতো সাধারণ কেউ।

কলেজ ফেস্টে ছোট্ট একটা জামা পড়লো পিয়াল। বেরোনোর আগে মায়ের আশপাশ দিয়ে অনেকবার ঘোরাঘুরি করলো, যদি একটা ধমক জুটে যায়। মা দেখলেন, এবং বললেন, “বাইকে যেওনা, ঠান্ডা লেগে যাবে”। ফলত, পিয়াল বাইক নিলো, রাগ করে এলোপাথাড়ি ঘুরলো এবং আয়না ভাঙলো। শেষমেশ মা ভালোবাসেনা জাতীয় অভিযোগ করে বাবার ধমক খেলো।

নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে দুচোখ ছাপিয়ে জল এলো পিয়াল এর। যাকে মা ভালোবাসেনা, তার বেঁচে থেকে কি লাভ। হয়তো সে মারা গেলেও ওই ভদ্রমহিলা কেবল “খুব দুঃখের খবর” বলে চুপ করে যাবেন। পিয়াল কিছুতেই কলেজ শেষ করবেনা। কোনো বখাটে ছেলের সাথে পালিয়ে যাবে। মাকে জব্দ করবে।কিন্তু সেখানেও সমস্যা। স্টেট টেবল টেনিস চ্যাম্পিয়ন, ডিস্ট্রিক্ট লেভেল সুইমার, কনফিডেন্ট বুলেট রাইডার পিয়াল সেনের দিকে বখাটে ছেলেরা তাকাতেই সাহস পায়না, নিয়ে পালানো তো অনেক দূরে কথা। এসব এলোমেলো ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে।

এরপরেও সব কিছু আগের মতোই চলেছিল। পিয়াল কলেজের পড়া ও শেষ করেছিল। আর শেষ করেই মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে পালানোর জন্য NDA র ফর্ম ভরে বসেছিল। যথা সময়ে লিখিত পরীক্ষার আমন্ত্রণ এলো, পিয়াল চুপচাপ পরীক্ষা দিয়ে এলো, কেউ জানতেও পারলো না। সেই পরীক্ষায় পিয়াল সেন সসম্মানে উত্তীর্ণ। এবার আসল পরীক্ষা শুরু। শরীর ও মনকে সহ্যের শেষ সীমা অব্দি নিয়ে যাবার লড়াই শিখতে দেরাদুন যেতে হবে।

সেই চিঠি খাবার টেবল এ পড়ে, পিয়ালের একুশ বছরের জীবনে প্রথম বার খাবার টেবিলে এ কেউ কথা বলছে না। বাবা স্তব্ধতা ভাঙলেন, “তুই একবার আমাদের জানাতে তো পারতিস। তোর কোনো কিছুতেই সাহায্য বই বাধার সৃষ্টি তো কখনো করিনি মা।” মা কিছুই বললেন না, ” আর একটু চিকেন গরম করি” বলে উঠে চলে গেলেন।

একরাশ অকারণ অভিমান বুকে নিয়ে ঘর ছাড়লো পিয়াল। মায়ের সাথে সম্পর্ক এখানেই শেষ করতে চায় সে।

এরপরের দিনগুলো তে সে আর মানুষ থাকলো না। অমানুষিক শ্রম আর কঠিন নিয়মের চাপে সব অভিমান মনের কোন অতলে চাপা পড়ে গেল। বাবার সাথে কথা হতো সময় সময়, মার কথা সে জিজ্ঞাসা করেনি একবার ও। গভীর দুঃস্বপ্নের রাতের মতো ট্রেনিং যেদিন শেষ হলো, পিয়ালের মায়ের কথা মনে পড়লো। কাল সকালে সম্ভবত ভদ্রমহিলা আসবেন বাবার সাথে। পরশু passing out parade।

সুখের বিষয়, ভদ্রমহিলা সেদিন এলেন না, কারণ সেই অফিস। দেখা হলো, পরের দিন।parade এর পর।

ওজন কমে প্রায় অর্ধেক, চোখের কোলে কালি, মুখে উজ্জ্বল হাসি। ছোট মেয়ের চঞ্চলতায় প্রায় উড়ে এলেন পিয়ালের কাছে। লেফটেন্যান্ট পিয়াল সেন এর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন একটা চকোলেট, গালে গভীর চুম্বন। পিয়াল ডাকলো, মা।

মা কাঁদলেন।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত