অপরিণত প্রেম অপরিণত ভালোবাসা

অপরিণত প্রেম অপরিণত ভালোবাসা

সকালে উঠতে বেশ একটু বেলা হয়ে গিয়েছিলো। চোখ মেলে কঙ্কনাকে বিছানায় পেলো না তুষার। একটা মিষ্টি অনুভূতির আবেশে কেমন জানি ঘোর লেগেছিলো। ঠোঁটের উপর হালকা হাসিটা অজান্তেই খেলা করছিলো।

আস্তে আস্তে উঠে বসে ডাকলো, “মিতা”, তুষার ছাড়া কঙ্কনাকে শুধু বোধয় ওর মা বাবাই ডাকতো এই নামে।
কোনো সাড়া না পেয়ে এবার একটু গলা চড়িয়ে ডাকলো ও, “অ্যাই মিতা, কোথায় গেলি?”

এবারও কোনো সাড়া নেই।
তুষার বিছানা ছেড়ে উঠলো, অনেক ডাকাডাকি করলো, ” অ্যাই মিতা, কি শয়তানি হচ্ছে, একটু পরেই তো চলে যেতে হবে।”

কিন্তু এঘর ওঘর কোথাও পাওয়া গেলো না কঙ্কনাকে।

এমন কি, ও যে ছিল তার যেন কোনো চিহ্নই নেই।

দিশাহারা তুষার ওকে ফোন করলো, কিন্তু একি, নম্বর সুইচড অফ।

শুধু বাইরে যাওয়ার দরজাটা হাওয়ায় খোলাবন্ধ হচ্ছিল।

চোদ্দ বছর বয়সের নিষ্পাপ ভালোবাসাটা পরিণতি পায় নি। গম্ভীর প্রকৃতির ছেলেটাকে কোনোদিন বলারই সাহস হয় নি কঙ্কনার। তারপর সময়ের টানে নিজের জীবনে এগিয়ে গেছে। প্রেম এসেছে জীবনে আরো, কিন্তু ভালোবাসা না বোধয়, তা রয়ে গেছে ওদের ছোট শহরের ওই গলিগুলোয়। মাঝেমাঝে যখনি গেছে নিজের শহরে ওর অজান্তেই ও খুঁজেছে তুষারকে।

তাই যখন তুষারের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এলো, কয়েকটা মুহূর্ত যেন থেমে গিয়েছিলো। যেন কেউ রিওয়াইন্ড করে পনেরো বছর আগের দৃশ্য চালিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু কঙ্কনা স্মার্ট মেয়ে, কর্পোরেট বাতাবরণে ঘষামাজা, আবেগ সংবরণ করতে জানতো। জিগ্যেস করেছিল সাধারনভাবে তুষার তাকে কিভাবে চেনে। তুষার একটু রাগের সাথে বলেছিলো শহরের নাম টা।

মনে মনে মুচকি হেসে কঙ্কণা জানায় ওর মনে পড়েছে ওরা একসাথে পড়তো। তুষারও বিদ্রুপ করে “ওহ, আই আমি গ্ল্যাড ইউ রিমেম্বার মি।”

সেই শুরু, তারপর টেক্সট মেসেজ থেকে ভিডিও কলে যোগাযোগের সূত্রে কাছাকাছি আসতে থাকে ওরা।

দুজনেরই বিবাহিত জীবনে অভাব কিছু ছিল না। দুজন দুজনের সুখী সংসারে মগ্ন ছিল। তাও ঝড় উঠল।

কোনো এক মুহূর্তে কঙ্কণা স্বীকার করে ফেলেছিল তুষারের প্রতি তার ভালোবাসার কথা।
ছোটবেলার সেই দুটো বেণী বাঁধা ফ্রক পরা সাধাসিধা মেয়েটা আজ সুপ্রতিষ্ঠীত, আপন গৌরবে হয়তো কিছুটা উদ্ধত।

কিন্তু তুষারের সাহচর্যে ওর মধ্যে কিশোরীর অনাবিল সরলতা আবার যেন ফিরে আসে। ওর উচ্ছল আবেগপূর্ণ কথাবার্তায় তুষার নিজের মাটির টান অনুভব করতো। দেশ থেকে বহুদূরে বসে তুষারও কঙ্কনার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল হয়তো।

যতই চেষ্টা করুক, পরিণত বয়সও অপরিণত ভালোবাসার আকর্ষণ আটকাতে পারে নি।

দু চারটে কথায়বার্তায় তা গড়িয়েছিল অবশ্যম্ভাবি শারীরিক মোহতে। কঙ্কনা বলেছিলো, “আমি চাই না তোর মোহ কাটুক। ছেলেরা শুধু এটুকুই চায়, এরপর হয়তো আর তোর আমাকে ভালোলাগবে না।” কিন্তু ওর বারবার অনুরোধে অবশেষে নিজেকে উন্মুক্ত করেছিল কঙ্কনা ভিডিও কলে।

এরপর হঠাৎ, কিছুটা পরিস্থিতির চাপেই বোধয় যোগাযোগ কম হয়ে এসেছিল তুষারের দিক থেকে। যতই নিজেকে আধুনিকতার মোড়কে জড়াক না কেন কঙ্কনার ভিতরের নারীসত্বা আঘাত পেয়েছিল তাতে।

সর্বোপরি, মনপ্রাণ সোঁপেছিলো ও তুষারের কাছে, তাই তার এই অবহেলা দুঃখ দিতো কঙ্কনাকে। কখনো ঝগড়া করতো, কখনো অভিমান।

তুষার কিন্তু কোনোদিনই মোহ কাটাতে পারেনি, বরং বারবার ফিরে এসেছে ও কঙ্কনার কাছে। মোহ যে কবে গভীর ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে বোঝেনি সেও। যতই নির্লিপ্ত হোক ওর ব্যবহার, ও কোনোদিনই কঙ্কনার ডাক উপেক্ষা করতে পারেনি।

কিন্তু সেকথা মুখ ফুটে বলা হয়ে ওঠেনি ওকে। ওর নির্লিপ্ততা অভিমানী মেয়ের সত্ত্বাকে নাড়া দিয়েছিলো, কঙ্কনা নিজের অনুভূতিগুলো মনের গভীরে চাপা দেয়।

বছর কাটে, অবশেষে আসে সেই বহুআকাঙ্খিত দিন, তুষার দেশে ফেরে। দেখা করে ওরা ওদেরই সেই ছোট শহরে।
বহুদিনের ছাইচাপা আগুনে উত্তাল ভালোবাসার আঁচ লাগে।

কিন্তু অভিমানী মেয়েটা বোধয় সেটাকে অন্যকিছু ভেবেছিলো।
রাজি হয় তুষারের সাথে ওর নতুন ফ্ল্যাটে যেতে, কোনো উচ্চবাচ্চ না করেই।

সমর্পন করে দিয়েছিলো নিজেকে তুষারের কাছে। তুষারও ডুবে গিয়েছিলো ভালোবাসার সমুদ্রে, নিজেকে উজাড় করে ভালোবেসেছিলো প্রেয়সীকে, সারাদিন, সারারাত। আঁকড়ে জড়িয়ে রেখেছিলো কঙ্কনাকে সারাটাক্ষন।

কিন্তু অভিমান বড় খারাপ। কঙ্কনা ঠিক করেছিল ওর অনুভূতিগুলোর প্রকাশ হতে দেবে না।

সকাল হতেই, তুষার যখন গভীর ঘুমে, কঙ্কনা বেরিয়ে যায়। না জানি কতক্ষন ঘুমন্ত তুষারের মুখের দিকে তাকিয়েছিলো হয়তো সতৃষ্ণ নয়নে।

নিজের শহর ছাড়ার আগে ছোট টিলাটার উপর গিয়েছিল কঙ্কনা শেষবারের মতো সূর্যাস্ত দেখতে। ঠিক করেছিল আর কোনোদিন ফিরবে না এই শহরে।

ডুবন্ত সূর্যের নরম আলোয় ওর গাল বেয়ে নেমে আসা অশ্রুধারা চিকচিক করছিলো।
ওর জন্য তুষার শুধু একটা মানুষ নয় যার প্রতি কখনো দুর্বলতা ছিল, তুষার ওর সবটা জুড়ে থাকা ওর ছোটবেলা। ও তো চায়নি শুধু শরীরীখেলা, চেয়েছিলো সারাজীবন সকালে ঘুম থেকে উঠে তুষারের চেহারা দেখতে, চেয়েছিলো ওর প্রিয় খাবার রান্না করে প্রতিদিন দিনের শেষে ওর জন্য অপেক্ষা করতে, চেয়েছিলো ওদের ভালোবাসার জন্ম দিতে।
ভাগ্য তাদের সে সুযোগ না দিলেও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ তো থাকতেই পারত ওরা।

কিন্তু তুষারের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু যদি শুধু ওর শরীরটাই হয় তাহলে তাই হোক, শরীরের খিদে মিটিয়েই শেষ হোক এই সম্পর্ক।

সূর্য ডুবে গেছিলো। চোখের জলটুকু মুছে ফিরে দাঁড়ালো কঙ্কনা।

কিন্তু একী, তুষার পিছনে কখন এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে দেখেই চোখের জল আবার বাঁধ ভাঙার উপক্রম করছিলো।
কাঁপা কাঁপা গলায় জিগ্যেস করলো, “তুই এখানে?”

তুষারের চোখে ছলছল ওর ভালোবাসা তখনও দেখতে পায়নি কঙ্কনা যখন মুখে জোর করে হাসি টেনে এনে তুষার পাল্টা প্রশ্ন করে, “কি ভেবেছিলি, তোকে খুঁজে পাবো না?”

অপলক দৃষ্টিতে তুষার ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় কঙ্কনা।
চোখের জল চেপে অসংলগ্নভাবে বলতে চেষ্টা করে, “জাস্ট এ বিট নস্টালজিক ইউ নো”

কথা শেষ করতে পারেনা, তার আগেই তুষার ওর ঠোঁট চেপে ধরে নিজের ঠোঁট দিয়ে।

নিজেদের অজান্তেই দুজনের চোখের আগল খুলে গিয়েছিলো। এতদিনের সব ঔদাসীন্য অভিমান ঝরে পড়েছিল অঝোরধারে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত