দিন রজনী কত অমৃতরস উথলি যায়
পরিচিত ধীর পায়ের চলনে নীলাদ্রির গুনগুনানিতে ছেদ পড়ে। শব্দটা যে ইতস্তত করেও শেষমেশ ওর পিঠ ঘেঁষে দাঁড়ালো,
“আস… আসবো?”
“এসেই তো পড়েছো।”
ঘার না ফিরিয়েই নির্বিকার জবাব দেয় নীলাদ্রি।
“দাদা”
আগন্তুকের স্বরটা কেমন যেন কাঁদো কাঁদো ঠেকলো। এবার খানিকটা বাধ্য হয়েই নীলাদ্রিকে মুখ ফেরাতে হলো।
দারোয়ানকে বলা আছে কাউকে ওপরের ঘরে আসতে না দিতে তবু এইসময়ে ছেলেটা চলে এলো দেখে একটু অবাক হলো নীলাদ্রি।
“নমস্কার” বলে ঠিক ঘরের মধ্যে পায়ে পায়ে অন্ধকার জায়গায়টায় এসে দাঁড়ায় ওর ছায়ামূর্তি। গলার স্বরটা নীলাদ্রির খুব চেনা, তবু এক অস্বস্তি গ্রাস করলো তাকে। অনেকদিন থেকেই চেনে ছেলেটাকে সে। গলায় এক অদ্ভুত মায়া আছে ওর। সবসময় যেন গুটিয়ে থাকে নিজের মধ্যে। কিন্তু আজকে যেন পরাজয়ের সুর শুনতে পাচ্ছে। নির্ঘাত টাকা চাইতে এসেছে। এসময়ে তো তার আসার কথা নয়। আসলে আজকেই এক সম্পাদকের আসার কথা। নতুন উপন্যাসটার জন্য একটা পাবলিশিং হাউজের সাথে কথা হয়েছে। নীলাদ্রির আগের দুটো বই বাজারে বেশ নাম করেছে। এই পাবলিসিং হাউজটার সাথে কাজ করতে পারলে লেখক হিসেবে ওর পরিচিতি অনেকটাই বেড়ে যাবে। আর আজকেই এভাবে অনিন্দ্যর আগমন নীলাদ্রির মোটেই ভালো লাগলো না।
নিজের বিরক্তিটা বেশ জিইয়ে রাখলো নীলাদ্রি। ছায়ামূর্তিটাকে উপেক্ষা করেই আবার গুনগুন করে উঠলো অসমাপ্ত গানের কলি।
আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে, দিন রজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে। পান করে রবি শশী অঞ্জলী ভরিয়া
“দাদা, কথা ছিল” অন্ধকার থেকেই অসহায় একটা গলা যেন কিছু বলতে চাইছে।
তাল কেটে গেলো আবার। উঠে গিয়ে একটা স্কচের বোতল থেকে খানিকটা সোনালী তরল ঢেলে নিলো কাঁচের গ্লাসে। তারপর ছায়ামূর্তির দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলো নীলাদ্রি। নীলাদ্রির ঠোঁটের কোনে অবহেলার হাসিটা চোখে পরলো না ছায়ামূর্তির। ড্রইং রুমে বেশি আলো পছন্দ নয় নীলাদ্রির আবার, তাই ঘরে দুটো মাত্র ডিমলাইট জ্বলছে দামি ল্যাম্পশেডে।
“অনিন্দ্য কী ব্যাপার? হঠাৎ আজকে এলে যে? তোমার তো পরের সপ্তাহে আসার কথা ছিল।” অস্বস্তিটা রেখেই নীলাদ্রি জিগ্যেস করলো কথাগুলো।
ছায়ামূর্তিটা তখনো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। বসতে বলার সৌজন্যটুকু দেখালো না নীলাদ্রি।
“কেন এসেছো আবার সেই টাকা চাইতে নাকি?
উফফ্ সেই টাকা আর টাকা। আচ্ছা অনিন্দ্য তোমরা এই লো ক্লাস মেন্টালিটি থেকে কবে বেরোবে বলোতো? তোমরা কী শুধুই টাকা চেনো? আর কিছু কথা নেই? আজকে পেমেন্ট হবেনা। তাছাড়া আগের উপন্যাসের দ্বিতীয় সংস্করণ সব বিক্রি হয়নি। হলেই পেমেন্ট করবো।” কথাগুলো বলে সোনালী তরলে চুমুক দিলো নীলাদ্রি।
“ও দাদা এমন বলবেন না। নতুন উপন্যাসটা পড়েছিলেন? আজ আমি টাকা নিতে আসিনি, আপনাকে দিতে এসেছি কিছু। জানেন আমার না শেষ কেমোটা” কথা শেষের আগেই নীলাদ্রি বাধা দিলো।
“আহ অনিন্দ্য ভ্যানভ্যান করো না তো। যাও এখন। একজন আসার কথা আছে। পরে এসো।” সোনালী তরল তখন আরও দুটো পেগ নেমেছে নীলাদ্রির গলায়।
“কে আসবে নীলাদ্রিদা? নতুন সম্পাদক? ইচ্ছে-পূরণের অভিক সরকার?” আচমকা গলার স্বরে এক অদ্ভুত পরিবর্তন এলো অনিন্দ্যর।
“এই এই, তুমি জানলে কী করে?” অন্ধকারেই খানিকটা ছায়ামূর্তিটাকে আরও ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো নীলাদ্রি।
“যাইহোক জেনেই যখন গেছো তখন বুঝতেই পারছো এই মিটিংটা কত ইম্পর্ট্যান্ট আমার কাছে। অতএব এখন তুমি এসো।”
“জানেন নীলাদ্রিদা, একটা গল্প বলবো বলে এলাম আজকে। অবশ্য এই গল্পটা আপনিই শুরু করেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই টুকটাক লিখতাম। একবার পাড়ার অনুষ্ঠানে একটা নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম। বাবার সে’কী আনন্দ। একদম ফার্স্ট রো’তে বসে নাটক দেখেছিল। বাবা ভেবেছিল একদিন আমার লেখা বেরোবে ছাপার অক্ষরে। তারপর যে-দিন বইমেলায় এসে “ঝরা পাতার কান্না” উপন্যাসটা কিনে বাড়ি ফিরলো আমি বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারিনি। আসলে উপন্যাসটা প্রথম বাবাকেই পড়ে শোনাই আমি। তারপর যখন দেখলো ওটা ছাপা হয়েছে আর তাতে আমার নয় অন্য একটা নাম, আপনার নাম, বাবা খুব হতাশ হয়েছিল। আরও বেশি হতাশ হয়েছিল আমার কাপুরুষতায় বোধহয়।
আমার লেখা গল্পগুলো আমার খুব প্রিয় সন্তানের মতো ছিল। মাত্র কিছু টাকার বিনিময়ে তাদের আপনার কাছে বিক্রি করেছি তাই বোধহয় শাস্তি আমার অবশ্যম্ভাবী। আপনাকে পাঠানো নতুন উপন্যাসটা হয়তো পুরোটা পড়ে দেখেননি। আপনি শুধু শুরু আর ক্লাইম্যাক্সটা পড়েই রেখে দেন সেটা জানি তাই এবার মাঝের দুটো পর্ব আমি পাঠাইনি। শুভেচ্ছা রইলো আপনাকে। যে খেলাটা শুরু করেছিলেন এবার শেষ আপনিই করবেন। আজ তো আপনি মস্ত লেখক। সম্পাদককে দেওয়ার আগে উপন্যাসটা লিখুন তবে।”
“না, অনিন্দ্য এটা তুমি করতে পারোনা। কী ছিলে তুমি? সামান্য ম্যাগাজিনে টুকটাক গল্প লিখতে। এই আমি, নীলাদ্রি সান্যাল তোমার গল্প পৌঁছে দিয়েছি সবার কাছে। মার্কেটিং বলেও একটা কিছু আছে। না হলে তো হাজার লেখক রোজ গল্প লিখছে। কটা লেখা পৌঁছাতে পারে সঠিক জায়গায়। আর তার বিনিময়ে মোটা টাকা পাচ্ছো তুমি। তুমি আমার সাথে এই বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারোনা কিছুতেই।” উত্তেজিত নীলাদ্রি ছায়ামূর্তি লক্ষ্য করে এগিয়ে এলো অন্ধকারের দিকে।
হঠাৎ নীলাদ্রি দেখলো সারা ঘরে হাজার আলোর ঝলকানি। সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দ্য। কিন্তু একী? এ কাকে দেখছে সে? চোখের তলায় গভীর কালি। জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে আসা একটা ছায়ামূর্তি যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চুল উঠে প্রায় টাক পরে গেছে। শুধু অম্লান আছে ঠোঁটের কোনের হাসিটা। ঠিক যেমনটা প্রথম দেখেছিল একটা বইমেলায়। নীলাদ্রি বরাবরই বইমেলায় যেত। প্রথম প্রথম আসতো বাবার হাত ধরে। গল্প শোনার অভ্যেস বাবার থেকেই পেয়েছিল, কিন্তু নীলাদ্রির দাদা বড়ো হয়ে লেখালেখির জগতে বেশ নাম করেছিল। নীলাদ্রিও চেয়েছিল নিজে গল্প লিখতে। টুকটাক শুরুও করেছিল। কিন্তু তেমন হালে পানি পায়নি কোনোদিন। তাই ওর চোখ বরাবর শিকারের প্রতি ছিল। এমন একজনকে খুঁজছিল যে তার উদ্দেশ্য সফল করতে পারবে। তাকে এনে দেবে খ্যাতির শিরোপা।
তখন অনিন্দ্য সদ্য কলেজ পাশ করা এক যুবক। লেখার মধ্যে আগুন। ওর লেখা পড়েই একদিন বইমেলায় এসে পরিচয় করেছিল নিজেই নীলাদ্রি। ছাইচাপা পরশপাথর চিনতে ভুল করেনি নীলাদ্রি। কিছুদিন পরেই অনিন্দ্য আত্মসমর্পণ করে। কেমোথেরাপির খরচে যে অনেক টাকা লাগে। কবিতা লিখে নার্সিংহোমের খরচ ওঠেনা এটা বুঝেছিল অনিন্দ্য। বাড়ির একমাত্র সন্তান তাই চিকিৎসাটা না করালে আরও দুটো প্রাণ শেষ হয়ে যাবে।
মূহুর্তে হাসির শব্দে ভরে গেলো নীলাদ্রির ড্রইংরুম। সহ্য হচ্ছেনা আর এই হাসির শব্দ। “থামো অনিন্দ্য থামো।” চিৎকার করে উঠলো নীলাদ্রি। চারিদিকে আবার আলো নিভে আসছে। কখনো অনেক বড়ো হচ্ছে আবার কখনো যেন ধীরেধীরে বিন্দুতে গিয়ে মিশছে অনিন্দ্য। টাল সামলাতে পারছে না নীলাদ্রি। ধপ করে চেয়ারের ওপর বসে পরলো।
“এক লেখকের মৃত্যু সেইদিন হয়েছিল নীলাদ্রি’দা যেদিন আপনার হাতে আমার উপন্যাসের পান্ডুলিপি তুলে দিই। আজ শেষ কেমোটা আর নিতে পারলাম না। আজ আপনার কাছে আর ঋণ রইলো না কিছুই। আজ আমি টাকা চাইতে আসিনি। শুধু চেয়েছিলাম আমার অসমাপ্ত উপন্যাসটার গল্প বলতে। কিন্তু থাক, কিছু কাজ অসমাপ্ত থেকে যাওয়াটাই তার প্রাপ্তি বোধহয়। আমি চলি।”
“অনিন্দ্য শোনো, শোনো যেওনা এভাবে।” নীলাদ্রির হাতের গ্লাস মেঝেতে পরে গেলো শব্দ করে। নীলাদ্রি উদভ্রান্তের মতো ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। কিন্তু কেউ নেই কোথাও। তবে কে এসেছিল? আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলোনা নীলাদ্রি। মাথা ঘুরে বারান্দায় পরে গেলো।
সেদিন সম্পাদক অভিক সরকার এসেছিলেন। ততক্ষণে নীলাদ্রি আর নেই। নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার সময়টুকুও পাওয়া যায়নি। ডাক্তার বলেছিল হার্ট আ্যটাক। সেদিন নীলাদ্রি’র পান্ডুলিপিটা না পেলেও পরে অবশ্য একটা বেনামী পান্ডুলিপি জমা পরে অভিক সরকারের অফিসে।গল্পের নাম “লেখকের মৃত্যু”। লেখকের নাম ছিলনা তাতে। নতুন লেখক হয়তো। নামীদামী লেখকের গল্প থেকে বেরিয়ে সম্পাদক অভিক সরকার এই প্রথম অচেনা লেখকের গল্পে হাত দিয়েছিল। আসলে গল্পটা পড়েই খুব ভালো লেগেছিল ওনার। এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল গল্পটার। প্রথম গল্পই হিট। তৃতীয় সংস্করণও বিক্রি হয়ে গেছে হুড়মুড়িয়ে। বইমেলায় গেলে অবশ্যই সংগ্রহ করবেন কিন্তু। অনিন্দ্যরা আজও আছে, অসমাপ্ত ইতিহাসের পাতায়। লেখকের মৃত্যু ঘটে, থেকে যায় তাদের সৃষ্টি চিরকাল….
সমাপ্ত