উফ্! পলাশ,পলাশ,পলাশ। আজ যে আমার কী আনন্দ হচ্ছে, সে তোমাকে কি করে বোঝাই?একা একা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এই পঁয়ষট্টি বছর বয়সেও যেন মনে হচ্ছে আনন্দে চীৎকার করে গান গেয়ে উঠি।বৃদ্ধাশ্রমের এই ছোট্ট ঘরটা আমার মনে হচ্ছে স্বর্গ।
তুমি, তোমার বৃদ্ধাশ্রমের অন্য বন্ধুদের সাথে এসেছিলে, আমাদের এখানে।হাতে ছিল তোমার নানা রঙের আবীর। আজ যে দোল।তুমি বোধহয় জানতেনা যে,তোমার পাশের বৃদ্ধাশ্রমেই রয়েছে তোমারই প্রথম পক্ষের স্ত্রী, নিবেদিতা। জানলে নিশ্চয়ই আসতে না, বলো?আমার মাথায় আশীর্বাদস্বরূপ আবীর দিলে।নানা রঙে রাঙানো আমার মুখ দেখে তুমি চিনতে পারনি।কিন্তু তোমার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখটা কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত করে দিয়েছিল তোমার নিবেদিতাকে।তোমার নিবেদিতা!!হা,হা,হা,কিজানি আজ আমাকে তোমার আদৌ মনে আছে কিনা?
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলাম আমি।রূপের ভাঁড়ারেও ছিল বেশ টান।কিন্তু মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছি, তখন বাবা মাকে তো দায়মুক্ত হতেই হবে।বিয়ে মেয়েরা করে না,মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়।আমার জীবনেও তার ব্যতীক্রম হয়নি।বেশ কিছু পাত্রপক্ষ আমায় দেখতে এসেছিল। কারোরই আমাকে মনে ধরেনি।অবশেষে এক অতি সহৃদয় ব্যক্তির মতোই তুমি আমার পাশে দাঁড়ালে।বিয়ে হল আমার ধনী পরিবারে।কনকাঞ্জলী দেবার আগে মা কানে কানে বলে দিলেন, “সবসময় সাজগোজ করে থাকবি,তাহলে স্বামীর মন পাবি।”মায়ের কথামত দেবতার দেবদাসীর ভূমিকা পালন করতে থাকলাম তোমার বাড়িতে।ঠিক একবছর ভেসেছিলাম আমরা প্রেমের জোয়ারে।কিন্তু তারপর?
ভগবান যাকে মারেন, সব দিক থেকে মারেন,আমি একথাটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। রূপহীনা, স্বল্পশিক্ষিতা আমি আবার সন্তানধারণেও অক্ষম সেটা বুঝতে পারলাম।তুমি যখন জানতে পারলে আমার অক্ষমতার কথা, তখন কেমন যেন আমার থেকে দূরে সরে যেতে থাকলে।যতদিন যেতে লাগল,তুমি আমার সাথে বাড়ির কাজের লোকের মত ব্যবহার করতে আরম্ভ করলে।একদিন তো কদর্য ভাষায় বলেই বসলে,” সকালবেলায় বন্ধ্যানারীর মুখ দেখলে সারাদিন খারাপ যায়।” খুব কষ্ট পেতাম যখন তুমি আমাকে বলতে আমি বড়ো সেকেলে,একঘেয়ে। বুঝতে পারিনি যে, তোমার চোখে তখন রঙ লেগেছে। কলেজের এক ছাত্রীর প্রেমে তুমি হাবুডুবু খাচ্ছ।তখন বুঝলাম, যখন তুমি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে।আমার সতীন নিয়ে ঘরে ঢুকলে।মাথা নিচু করে বাবারবাড়ি ফিরে গেলাম।
কত ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছিলে, আমাকে খোরপোষের টাকা যাতে না দিতে হয়।আমাকে কিছু টাকা দেবে বলে ডেকে পাঠিয়েছিলে। পরিবর্তে কি একটা কাগজে সই করালে,পরে বুঝেছিলাম সেটা ছিল মিউচুয়াল ডিভোর্সের কাগজ।
বাবা মা যতদিন ছিলেন আমাকে টানলেন,ভাইয়ের সংসারে হয়ে গেলাম বোঝা।আমার আশ্রয় হল বৃদ্ধাশ্রম।
পরে জেনেছিলাম, তুমি পুত্রসন্তানের পিতা হয়েছ।তারপর কি এমন হল বলতো, যে দুই স্ত্রীর স্বামীর, পুত্রসন্তানের পিতার ঠিকানাও হল বৃদ্ধাশ্রম? নিশ্চয়ই তোমার দ্বিতীয়া স্ত্রী আর নেই। তিনি থাকলে, তোমার কখনওই এমন পরিণতি হতনা।কিন্তু তুমি কষ্ট পেয়ো না।আমি তো আছি। আজ তুমি আমার মাথায় আবীর দিলে,সেই রঙ আমার রঙহীন মনকে রাঙিয়ে দিয়েছে নতুন করে।জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমরা।তবু তোমাকে নিয়ে আবার ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করছে খুব । তুমি কি আমাকে ফিরিয়ে দেবে?ফিরিয়ে দিলে দিও,তবু আমি আগামীকাল তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াব,শেষ ভিক্ষার আশায়।একটাই সান্ত্বনা, এবার থেকে দিনে একবার হলেও তোমায় দেখতে পাব।আমার মত অভাগিনীর কাছে তাই বা কম কি,বলো?