জানো, অামারো ইচ্ছে হয় তোমার মত করে গুছিয়ে কথা বলতে।কিন্তু পারিনা।অার পারবই বা কি করে অামি যে বোবা।কথাই বলতে পারিনা।”
সুমন ছেলেটা বোবা।তার অাবেগ অনুভূতিসব বোবা।তা নাহলে এতদিনে নিশির অাচরণ দেখে মনের কথা বুঝে ফেলার কথা।এমন বোবা ছেলের প্রেমে নিশি কখন যে পড়ে গেল ভেবে কুল পাইনা।অাসলেই মায়া বড্ড অদ্ভুদ জিনিস।কখন কার জন্য কোথায় মায়া জন্মে যায় তার হিসেব নেই।ওই মায়ায় হচ্ছে প্রেমের প্রথম ধাপ।একসময় মোহ কাটে কিন্তু মায়া জিনিসটা সারাজীবনেও কাটেনা।
অল্প বয়সে হারিয়েছিল সুমন তার মাকে।বাবা যেন থেকেও নেই।সুমনের মা মরার পর অারেকটা বিয়ে করে দিব্যি সংসার সামলে নিচ্ছেন এখন।বোবা ছেলে সুমনের একটুও খোঁজ নেয়না তিনি।ত্রিভুবনে সুমনের কষ্ট দেখার মত কেবল একজনি অাছে সেটা ওর ছোট কাকা।কাকার সহযোগিতা পেয়ে কোনরকমে জেএসসি দিতে পেরেছিল।তারপর অার সম্ভব হয়নি।ভয়ানক সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারায় তার কাকা।তখনি সুমনের মাথায় অাকাশ ভাঙ্গে।
সার্থপর কাকিমা নিজের তিন সন্তানকে দেখভাল করতে ব্যস্ত।পরের ছেলেকে দেখার সময় তার নাই।একদিনের ঘটনা সুমনের সাথে অার্যের খুব ঝগড়া লেগেছিল।অার্য তার কাকিমার মেঝ ছেলে।প্রায় সমবয়সী ওরা।সুমন স্বভাবতই শান্ত ও ধীর প্রকৃতির একটা ছেলে।সহজে রেগে যায় না।ইনিয়ে- বিনিয়ে মিথ্যেও বলতে পারেনা।সুমন বুঝতে পারছিল তার মাকে নিয়েই বিশ্রী গালমন্দ করছিল অার্য।তখনি একটা থাপ্পর কষে দিয়েছিল তার মুখে।অার্য ঘটনা একটু লম্বা করে বলে তার মাকে।মাও অাদরের ছেলের কথা না শুনে পারেনা।রেগে গিয়ে ভীষন মারধোর করে সুমনকে।অার বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে যেতে বলে।সুমন কোন শব্দই শুনতে পাইনা।অথচ অধরের উঠানামা দেখেই বুঝে নিতে পারে তাকে নিয়ে কি বলা হচ্ছে।
সুমন অতি শীঘ্রই বেড়িয়ে পড়ে অজানা গন্তব্যে।জীবনের প্রতি অার কোন মায়া নেই তার, নেই কোন পিছুটান।কিছু অসম প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকে।এ মুহুর্তে সে যদি মরেও যায় তাহলে একফোটা চোখের জল ঝরানোর মতো কেউ নেই।যেখানে চোখের জল দেখে কেউ মুছে দিতে এগিয়ে অাসেনা সেখানে জল ঝরানো তো দূরের কথা।বোবা সুমনের ইচ্ছে করে হাজারটা অভিযোগ কোন সাদা পাতায় পরপর লিখে দিয়ে কোথাও হারিয়ে যেতে।ঠিক সেটাই হয়েছিল।
হঠাৎ পিছন থেকে গাড়ি এসে ধাক্কা মারে সুমনকে।রাস্তার উপর ছিটকে পড়ে যায় সুমন।সঙ্গে সঙ্গে প্রাইভেট কার থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে অাসে এক মধ্যবয়স্কা মহিলা।তারপর ভদ্রমহিলা তার ড্রাইভারকে দিয়ে সুমনকে গাড়িতে নিয়ে বসাল।সুমনের অবস্হা তেমন ঘোরতর নয়।শুধু পায়ে একটু ছোঁট পেয়েছে।গাড়িতেই ফার্স্টএইড ছিল ওইটা দেয় সুমনকে।
খানিকক্ষণ পর ভদ্রমহিলা সুমনকে নাম জিজ্ঞেস করে।কিন্তু সুমন কিছু না বলে চুপ করে থাকে।ভদ্রমহিলা অাবার একই প্রশ্ন করে সুমনকে।সুমন এবার ঈশারা করে বলল সে কানে শুনেনা, কথাও বলতে পারেনা।ভদ্রমহিলা একটু যেন ধড়াস হলেন।তারপর ভদ্রমহিলা অাবার ঈশারায় জিজ্ঞেস করলেন- তোমার বাড়ি কোথায়?? সুমন নিজের গ্রামের নামটা ইশারাতে বলতে পারেনি।কিন্তু খাতা কলম থাকলে ঠিকই লিখে দিত।ভদ্রমহিলা হতাশ হলেন কারন গাড়িতে কোন খাতা কলম নেই।
সুমন বলল- অামি বাড়ি ফিরবনা কিছুতেই।বাড়িতে অামার অাপন কেউ নেই।অাপনি অামাকে একটা কাজ দেন।অামি ওটা করেই চলব।
অাসলেই সুমন অাজ বাড়ি ফিরবে বলে ঘর থেকে বেড়োয়নি।তার ইচ্ছে ছিল মরবে নাহয় অন্য কোথাও গিয়ে নতুন জীবন শুরু করবে।যেহেতু মরতে পারেনি তাই নতুন জীবন শুরু করতে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।সুমন মনে মনে ভাবল নিশ্চয় তার জন্য অাগামীতে বিরাট কিছু অপেক্ষা করছে।
ভদ্রমহিলার কোথায় যেন একটু সন্দেহ হল সুমনের ব্যাপারে।ছেলেটাকি অাসলেই বোবা।নাকি কৌশলে অামার বাসায় গিয়ে লুটপাট করার ধান্ধায় নেমেছে।কিন্তু চেহারা দেখে তো এমন মনে হচ্ছেনা।সে যা হবার পরে দেখা যাবে।ভদ্রমহিলা অার বেশিকিছু ভাবলেননা।সুমনকে বললেন- ঠিক অাছে, অাগে বাসায় চল।দেখি তোমাকে কোন কাজ দিতে পারি কিনা।
সুমন একটু খুশি হল।ভদ্রমহিলা ভাবনায় পড়লেন।
ভদ্রমহিলার নাম মিস দেবলিনা চৌধুরী।পেশায় সরকারি ব্যাংকের প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তা।এক স্বামী অার এক মেয়েকে নিয়েই তার সংসার।বাসায় পৌঁছে সুমনকে গেস্টরুমে বসতে বলে রুমে ঢুকে যায় মিস দেবলিনা।সুমন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে পুরো বাসার সাজসজ্জা।এত বড় বাসা এতএত ফার্নিচার সে অাগে কখনও দেখেনি।কিছুসময় পর রুম থেকে বেড়িয়ে অাসে মিস দেবলিনা।এবং পিছন পিছন অাসে তারই ১৫ বছরের মেয়ে নিশি।
সুমন লক্ষ্য করে দুজনের চেহারার মাঝে মিল খুঁজে পায়।তার মানে এখানে মা মেয়ের সম্পর্ক।অারেকটু সামনে অাসতেই সুমন লক্ষ্য করে মেয়েটির হাতে খাতা অার কলম।দেবলিনা ও তার মেয়ে সুমনের সামনাসামনি সোফায় বসে পড়ে।সুমনের দিকে বাড়িয়ে দেয় হাতে থাকা খাতা কলম।তারপর নিজের সম্পর্কে লিখতে বলে সুমনকে।সুমন গুছিয়ে সব লিখে দেয়।মা মেয়ে দুজনেই অবাক হয় সুমনের লেখার মাধুর্য দেখে।অসম্ভব সুন্দর লেখনি।
ঠিকঠাকমত লেখাপড়া চালিয়ে গেলে সুমন এতদিনে ইন্টারে পড়ত।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেটা অার সম্ভব হয়নি।মিস দেবলিনা অন্য পৃষ্টায় নিজের নামটা লিখে বলল- এটা অামার নাম।সুমনের ইচ্ছে হল পাশে থাকা মেয়েটিরও নাম জানতে।কিন্তু জানা হলনা।তার অাগেই দেবলিনা খাতা বন্ধ করে টেবিলের উপর রাখল।সুমন কোথাও যেন একটু দুঃখ পেল।তবে সেটা প্রকাশ পায়নি।নিজের ভিতরই বন্দি ছিল।নিশির সাথে বার বার চোখাচোখি হচ্ছে ওর।কেমন ঘোর লাগানোর মত চেহারা মেয়েটির।
দেবলিনা ভাবছে ছেলেটাকে কি কাজে বাসায় রাখা যায়।বাসায় কাজের বুয়া অাছে; বাইরে গেইট ম্যান অাছে ; গাড়ির ড্রাইভার অাছে।তাহলে ছেলেটাকে কেমন কাজ দেয়া যায়।এরমধ্যে নিশি উঠে দাঁড়িয়ে বলল- মা, অামি রুমে যাচ্ছি। দেবলিনা বলল- যা। নিশি যখন রুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল দেবলিনা ডাক দিয়ে বলল- তোর খাতাটা নিয়ে যা।ওটা অাবার কার জন্য রেখে যাচ্ছিস।
নিশি এসে খাতাটা হাতে নিল।তখনি খাতার উপর চোখ গেল সুমনের।কারো নাম লিখা অাছে খাতার উপর।নিশ্চয় মেয়েটার নামই হবে।কিন্তু ততক্ষণে নিশি রুমে ঢুকে গেল।
নিশির বাবা সীমান্ত চৌধুরী বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে কাটান।অার দেবলিনা সারাদিন অফিসেই থাকেন।নিশিই থাকে বাসায় একা।অার সেই হিসেবে এমন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেকে বাসায় রেখে যাওয়া উচিত হবেনা।কখন কি না কি করে বসবে তার ঠিক নেই।দেবলিনা একটু মাথা খাটিয়ে ভাবলেন।ইদানিং মেয়েকে একদমি সময় দিতে পারছেনা।তাছাড়া স্কুলের রাস্তা অার অফিসের রাস্তা উল্টোদিকে হওয়ায় মেয়েকে কিছুদূর ড্রপ করে দেওয়াও সম্ভব হচ্ছেনা।নিশি একা একা স্কুলে যেতে চাইনা একদম।তাই বেশি বেশি স্কুল কামাই করছে অাজকাল।তাইতো স্কুলের নিকিতা ম্যাডামের অভিযোগ এসেছিল সেদিন।সুমনের দিকে একবার তাকিয়ে নিলেন তিনি।তারপর বললেন- তোমার কাজ হবে অামার মেয়ে নিশিকে স্কুলে পৌঁছে দেয়া এবং ছুটির সময় সঙ্গে করে নিয়ে অাসা।
সুমন সম্মতি জানায় দেবলিনার প্রস্তাবে।
পরদিন সকাল সকাল স্কুলে যাওয়ার জন্য পরিপাটি হচ্ছে নিশি।মিস দেবলিনা একবার নিজের মেয়ের রুমে গিয়ে উঁকি মেরে অাসলেন।ওদিকে সুমন অাগে থেকেই রেডি হয়ে অাছে।কতটা দায়িত্ববান ছেলে প্রথমদিনই বুঝা যাচ্ছে।নিশি এলেই দুজন একসাথে বেড়িয়ে পড়বে।নিশি এখনো জানেনা অাজ তাকে একা একা স্কুলে যেতে হবেনা।জানলে বোধই এত দেরি করতনা।