খোকা যখন ছয় দিন ::
” মিনুর মা,তুমি হাত ধুয়েছো তো? মানে খোকাকে তেল মাথাবে তো ” বেশ উদ্বেগ এর সাথে কথা গুলো বললো উমা |
” হ্যাঁ,ধোবো না কেন ? বৌরানী ধুয়েছি ”
” না কচি বাচ্চা যদি কিছু বিষক্রিয়া হয়ে যায়”
কথা না বাড়িয়ে তেল মাথাতে শুরু করে মিনুর মা..
” এই আস্তে মাখিও লেগে যাবে যে,কচি চামড়া ”
” বৌরানী আমরা কোনো নতুন কাজ করছি না,তেল মালিশ, সেঁক দিয়ে আমাদের রুজিরোজকার হয়..তুমি তোমার ছেলেকে তেল মাখিও, আমাকে আর ডেকোনা ” বলে উঠে গেলো মিনুর মা | গজগজ করতে করতে বললো
” বুড়ো বয়েসে মা হয়েছে ,তাই আদিখ্যেতা দেখলে বাঁচি না”
মিনুর মা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়াতে শাশুড়ি এসে বললো
“কি গো বৌমা মিনুর মা চলে গেলো কেন ?”
” না মা খুব জোরে খোকার গায়ে তেল মাখাচ্ছিলো ,ওটা বললাম তো রাগ | যাকগে খোকাকে আমি তেল মাখবো ”
” তাই করো ” বিরক্ত মুখে বললেন উমার শাশুড়ি |
আঠেরো বছর বয়েসে উমার বিয়ে হয়ে ঘোষ বাড়িতে এসেছিলো,বিয়ের ষোলো বছর পেরিয়ে গেলেও মাতৃত্ব অধরা ছিল | অনেক ডাক্তার-কবিরাজ, মানত করার পর পঁয়ত্রিশ বছর বয়েসে উমা একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় | তাই বাচ্চাটিকে আতুপুতু করছে উমা |
খোকার যখন দশ মাস::
উমার বাচ্চাটার এক সমস্যা সারাদিন খেললেও খেতে চায় না একদম | খাওয়া নিয়ে তো উমার অশান্তি লেগেই আছে| সেদিন আবার খোকার জ্বর এসেছে,উমা রান্নাবান্না ছেড়ে খোকাকে কোলে নিয়ে বসে আছে | খোকা কিচ্ছু মুখে তুলছে না ও,তুললেও বমি হয়ে যাচ্ছে | হাপুস নয়নে কাঁদছে উমা
” আমার ছেলে আজ কিছুই খাচ্ছে না ”
” তো বাপু ওমন ধারা কাঁদার কি কারন আছে,ছোট ছেলে শরীর খারাপ হয়েছে তাই খাচ্ছে না ,তার জন্য অমনি মড়া কান্না জুড়তে হবে? ” বেশ বিরক্ত মুখে উমার শাশুড়ি বললো |
” আপনি কি যে বলেন না ,খোকা আমার খাচ্ছে না তো আমার খারাপ লাগবেনা ? আপনিও তো ছেলের মা ,আপনি বোঝেন না ? ঝাঁজিয়ে কথা গুলো বলে উমা | চুপ করে গেলো উমার শাশুড়ি |
খোকা যখন পাঁচ বছর::
” মা,উমা কিছুতেই গ্ৰামে থাকছে চাইছেনা ,খোকার পড়াশোনা আছে,ওখানেই গিয়ে ভালো ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করবো |বাবা হিসাবে আমারো তো দায়িত্ত্ব আছে , আমি তাই আমার কাজের জায়গায় ওদের নিয়ে যেতে চায় ” এক দমে কথা গুলো বললো উমার স্বামী |
” তুই যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিস তখন আমার কিছু বলার নেই,তবে মাঝে মাঝে দাদুভাই কে দেখিয়ে নিয়ে যাস ,ও তো আমার বংশের প্রদীপ ” থেমে থেমে কথা গুলো বললো উমার শাশুড়ি |
” মা,আপনিও তো আমার সাথে যেতে পারতেন ” উমা বলে উঠলো |
” না বৌমা শহরের জল আমার সহ্য হবে না,তাছাড়া মোক্ষদা তো থাকলো আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ,আমার অসুবিধা
হবেনা ”
হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো উমা ,লোকে কি বলবে তাই একবার লোক দেখানো বলতেই হলো ,এবারে স্বামীর সাথে একাকী বাসায় থাকতে পারবে,শাশুড়ির প্যানপেনানি,ঝাঁঝানি থাকবেনা,একেবারে মুক্ত বিহঙ্গ |
এক কামড়ার ছোট্ট ঘরে বসে আছে বছর সাতষট্টির এক বৃদ্ধা | কোমর ব্যাথা,আর চোখে ছানি পড়ার জন্য বয়েসের তুলনায় ওনাকে আরো বেশি জীর্ণ করে দিয়েছে | দিন কুড়ি হলো এই বৃদ্ধাশ্রমে এসেছেন তিনি,পায়রার খুপরির মতো ছোট ,স্যাতস্যাতে ঘরে যেন তিনি আরো অসুস্থ হয়ে গেছেন | অথচ ওনার স্বামীর দু জায়গায় বড় বাড়ী,গাড়ি চাকর-বাকর আভাব ছিলোনা,আর এখানে নিজের কাপড়-বাসন নিজেই ধুতে হয় | স্বামী মারা যাওয়ার দু বছরের মধ্যে ওনার যে এই দূর্গতি হবে সেটা কল্পনা করতে পারেনি উনি | পুত্র স্নেহে অন্ধ হয়ে যে সম্পত্তি লিখে দিয়ে ভুল কাজ করেছেন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পায় এখন | সেই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে , না তার পর ছেলে আর কোনো খোঁজ নেয় নি | ওনার কাছে একটা ফোন আছে অবশ্য ,তবে ওটার তেমন টাকা নেই,তাছাড়া এখন ছেলে বৌমাকে ফোন করলে ফোন বেজে যায় কেও ধরেনা | দু চোখে জলের ধারা নেমে আসে…
” মাসিমা খেতে আসুন” রান্নার মেয়ের ডাকে সম্বিৎ ফেরে ওনার ….
সকাল সাতটা আরামপ্রবণ বিছানা থেকে উঠলো উল্লাস | মৌ তখনো ঘুমে কাদা | ততক্ষনে বেবিসিটার ওদের পাঁচ বছরের ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছে | ও একটা মাল্টি ন্যাশানাল কোম্পেনীতে উচ্চ পদে কর্মরত | ফিরতে ফিরতে রাত ,বেশিরভাগ দিন যখন উল্লাস আসে তখন ওর ছেলে ঘুমিয়ে পড়ে | ওদের মুখ চেয়ে এত খাটনি …ক্যালেন্ডারের পাতায় জ্বল জ্বল করছে সাত এপ্রিল | আজ সাত এপ্রিল মানে তো মায়ের জন্মদিন | দু বছর আগেও কত ধুমধাম করে অনুষ্টিত হতো এই দিনটা ,অথচ আর আজ মা নেই |একবার কি মাকে ফোন করবে ? মনে মনে ভাবে ও |
” এই আজ তুমি আমাকে বেডটি করে এনে দাও না প্লিজ ” মৌয়ের এমন আদুরে গলায় উল্লাস এখনো পাগল হয়ে যায় | খুব ভালোবাসে ও মৌকে ,তাই মৌয়ের কথায় সব সম্পত্তি লিখিয়ে নিয়ে মাকে একটা সস্তার বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে দ্বিধা করেনি উল্লাস |
” যাচ্ছি বেবি ” বলে কিচেনের দিকে হাঁটা দিলো | মাকে ফোন করে কাজ নেই,মৌ কোনো ভাবে জানতে পারলে অশান্তি করবে ,তাই মায়ের সাথে কথা বলার চেয়ে মৌয়ের বেড টি বানানো বেশি শ্রেয় মনে করলো উল্লাস |
আজ সাত এপ্রিল ,আজ ওনার জন্মদিন ,ওনার স্বামী বেঁচে থাকতে পার্টি দিতো |কিন্তু আজ কোথায় উনি ? একেই বোধহয় বলে ভাগ্যের
পরিহাস | ভাবছিলেন বৃদ্ধা | ছেলে একবার টাকা জমিয়ে একটা কেক কিনে এনেছিল ,আর সাথে হাতে আঁকা একটা কার্ড | কতই বা বয়েস হবে ওর খুব জোর সাত কি আট | পাগল ছেলে বলতো
” মা ভাগ্যিস তুমি জন্মেছিলে ,নাহলে আমি কাকে মা বলতাম ?” আজও কি একবার ফোন করবেনা ও ? বৃদ্ধা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসে আছে | নয় টা বাজে ,এখন হয়তো অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে ,পরে ঠিক মনে করে করবে ‘ মনে মনে বলে বৃদ্ধা | না ,সকাল পেরিয়ে দুপুর,দুপুর পেরিয়ে বিকেল বৃদ্ধার ছেলে আর ফোন করে না | ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধা…. ভগবান কোন পাপে এত শাস্তি দিচ্ছ ভগবান ,যে ছেলের ভালোর জন্য আমি শ্বশুরের ভিটে ছেড়েছি ,যে ছেলের আমি ভবিষ্যত গড়তে আমি প্রাণপাত করেছি সেই ছেলে আজকে একবারো ফোন করলো না….তবে কি শেষ বয়েসে শাশুড়িকে না দেখার ফল ভোগ করছি আমি ?” নিজেকেই প্রশ্ন করেন উমাদেবী…
হ্যাঁ, ইনিই সেই উমাদেবী ,যিনি ছেলে না খেলে কাঁদতো ,আজ উনি কাঁদছেন ছেলে খবর নেয় না বলে |
সত্যিই এমনি কত মা তখনো কাঁদতো যখন সন্তান খেতো না ,আর মা আজও কাঁদে যখন সন্তান দেখে না |