পদ্মিনী

পদ্মিনী

টিচার্স রুমে বসে যে মেয়েটা গভীর মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছে তার নাম পদ্মিনী। বাবা আদর করে ডাকে পদ্ম। তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে পদ্মের বাবাকে ডেকে কেউ একজন বলেছিলো, ওরে নূরু মিয়া তোর মেয়ে যে অনেক সুন্দরী হবেরে।এমন দুধে আলতা রঙ কার থেকে পেলো বলতো? তোর তো কপাল আসমানে উঠলোরে, এই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য তো তোর বাড়িতে রাজপুত্ররা লাইন ধরবে।

নুরু মিয়া মেয়েকে কোলে নিয়ে তখন হাসিমুখে বলেছিলো, তাই যেনো হয়গো চাচী। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নূরু মিয়ার প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। মেয়ে তো নয়, যেনো পদ্মসায়রের তেলতেলে জলে ডোবা সুন্দর পদ্মফুল। এমন উজ্জ্বল রঙের মেয়ে এই তল্লাটে খুব কমই হয়েছে।

নুরু মিয়া বড্ড আহ্লাদ করে মেয়ের নাম রাখলেন পদ্মিনী। আর মুখে ডাকতেন পদ্ম। কিন্তু কে জানতো, এই জ্বলে ডোবা সুন্দর পদ্ম ফুলটি যে বড্ড পোড়া কপাল নিয়ে এই ত্রিভুবনে পদার্পণ করেছে!

চার ভাইবোনের মাঝে পদ্ম সবার বড়।গ্রামের আর সব ছেলে মেয়েদের সঙ্গে বেড়ে ওঠছিলো সে। পড়ালেখায় খুবই ভালো ছিল বলে নূরু মিয়া খুশি হয়ে মেয়েকে পড়াতে লাগলেন।নূরু মিয়ার অভাবের সংসার।পেটেভাতে খেয়ে, পরে দিব্বি সুখে আছে ছেলে মেয়েদের নিয়ে।

দেখতে দেখতে পদ্ম এসএসসি পরীক্ষাও পাশ করে ফেললো। এ প্লাস না পেলেও ‘এ’ গ্রেড পেয়েছিলো সে। মেয়ের ভালো পাশের খবর শুনে নূরু মিয়া প্রচন্ড আনন্দ পেয়েছিলো সেদিন। ভাবলেন মেয়েকে এবার কলেজে ভর্তি করাবেন। পদ্মও মনে মনে তাই ভেবে রেখেছিলো। অনেক লেখাপড়া করবে সে।ভালো চাকরি করবে। কিন্তু কে জানতো, এমন আকস্মিক ঝড়ে পদ্মের জীবনটা ছন্নছাড়া হয়ে যাবে!

পাশের গ্রামের ঘটক আসলেন পদ্মের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। ছেলে বিদেশে থাকে, অনেক টাকা পয়সার মালিক। ঘটক সাহেব নূরু মিয়াকে বললে প্রথমে রাজি হয়নি নূরু মিয়া।বললো, পদ্ম মেট্রিকে ভালো পাশ করছে, ভাবছি কলেজে ভর্তি করাবো ওকে।

ঘটক সাহেব পদ্মের বাবাকে বুঝালেন, আরে মিয়া সেটা তো ভালো কথা। তোমার মেয়ে বিয়ের পরেও পড়তে পারবে। ছেলের কি আর পয়সার অভাব আছে? কলেজে পড়তে হলে অনেক খরচ হয়। সেটা তুমি দিবা কি করে বলো তো? বিয়ে দিলে তোমার জামাইয়ের খরচে মেয়ে পড়ালেখা করবে।

এসব শুনে নূরু মিয়া ভাবলেন হয়তো ঘটকই ঠিক বলছে।মেয়েকে তারা পড়ালেখা করাবে। পদ্মের মাও এই বিয়েতে রাজি হলেন। কিন্তু পদ্মের মনটা খারাপ হয়ে গেলো কোনো এক অজানা আশংকায়।

একদিন পদ্মের বিয়ে হয়ে গেলো। বরের বয়স পদ্মের চেয়ে ১২বছর বেশি। এমন আকাশ-পাতাল তফাৎ বয়স্ক এক লোকের সঙ্গে সংসার করতে ১৫ বছরের কিশোরী পদ্ম নিজেকে কিছুতেই মানাতে পারছেনা। লোকটাকে পদ্ম ভীষণ ভয় পায়। ভীষণ রাগী স্বভাবের লোকটি যখন তখন পদ্মকে হুকুম করে। আর বলে লেখাপড়া করে কি হবে বলো তো? বরং সংসারের কাজে মন দাও।

সেদিন এই একটা বাক্য শুনে মুহূর্তেই ভেঙে গিয়েছিলো পদ্মের সব স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা। স্বামী নামক লোকটাকে আরো বেশি অচেনা লাগতে শুরু করলো। শাশুড়ি থেকে ননদ সবাই সারাদিন পদ্মকে হুকুমের উপর রাখে।বাড়ির বড় বউ বলে কথা, তাকেই তো সব কাজ করতে হবে।

সবাই সুর মিলিয়ে যখন সংসার ধর্মের বাক্যালাপ করে, পদ্মের মন পড়ে রয় তখন বাড়িতে অযত্নে পড়ে থাকা কিছু বই খাতা, আর পড়ার টেবিলে। খুব ইচ্ছে করে পড়ালেখা করতে।কিশোরী মেয়েটা নিজের চেয়ে ১২বছরের বেশি বয়স্ক লোকটার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনা। লোকটাও খিটখিটে মেজাজের। যখন তখন ঝগড়া হয় দু’জনের মাঝে।

সংসারের কাজকর্ম ঠিক মত করতে না পারলে শুনতে হয় শাশুড়ি ননদের কটুকথা। এমন পরিস্থিতে একদিন পদ্মের স্বামী পদ্মকে বাপের বাড়িতে চলে যেতে বললো। বের করে দিলো সংসার থেকে। সেই যে পদ্ম বাপের বাড়িতে এলো আর কেউ পদ্মকে নিতে আসেনি।কয়েক মাস অতিবাহিত হবার পর পদ্মের স্বামী পদ্মকে ডিভোর্স দিয়ে দিলো।

নেমে এলো পদ্মের জীবনে এক করুন হতাশাময় অধ্যায়। গ্রামের লোকেদের নাক ছিটকানো কটুবাক্য, বাবার টানা পোড়নের সংসার, ভাইবোনদের ভবিষ্যৎ, সবকিছু পদ্মকে একসময় বেপরোয়া করে তুললো। জীবনের সকল গ্লানি মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলো সে।

নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য ইচ্ছে জেগে উঠলো পদ্মের মনে। গ্রামের এক সম্মানীয় শিক্ষিত লোকের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে কম্পিউটার কোর্স করলো। প্রাইমারী স্কুলের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলে দেখতে পায় এসএসসি পাশ মেয়েরাও এপ্লিকেশন করতে পারবে। পদ্ম এপ্লিকেশন করলো প্রাইমারী স্কুলের চাকরির জন্য।

কম্পিউটারে ভালো দক্ষতা আর মেধার জোরে পদ্ম ভাইবাতে উত্তীর্ণ হলো। হয়ে গেল পদ্মের চাকরি। একেই হয়তো বলে ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন। ঘুরে দাঁড়ালো পদ্মের জীবন। সরকারী চাকরি করে, গ্রামের লোকেরা শিক্ষিকা বলে আজ পদ্মকে সম্মানের চোখে দেখে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পদ্মকে দেখলে সালাম দেয়। এসবে পদ্মের বুকটা গর্বে ফুলে উঠে, বুক ভরে শ্বাস নেয় সে।

নূরু মিয়াকে লোকেরা আজকাল মান্যগণ্য করে, সম্মানের চোখে দেখে। বাবার চোখে মেয়ের জন্য গর্ব দেখে পদ্ম, মায়ের মুখে হাসি দেখে, ভাইবোনদের চোখে মুখে আনন্দ দেখে। এই তো সুখ, কি লাগে আর জীবনে?

অতীতের বিভীষিকাময় দিনগুলো এখন পদ্মের চোখের সামনে তুচ্ছ স্মৃতি হয়ে মাঝে মাঝে উঁকি দেয়। তখন পদ্ম হয়তো দুই’ফোঁটা চোখের জল বিসর্জন দেয়, অথবা বর্তমানকে ভেবে সেই স্মৃতিগুলো ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে।

ক্লাসে গিয়ে বাচ্চাদের আদর যত্নে পড়ালেখা করায়, কম্পিউটারে দক্ষ হাতে বাচ্চাদের প্রশ্নপত্র প্রিন্ট করে পদ্ম। পদ্মকে দেখে আজ গ্রামের অন্য মেয়েগুলো জীবনকে জীবনের মত ভাবতে শিখে, স্বপ্ন দেখে। একজন প্রতিষ্ঠিত মেয়ে হতে পেরে পদ্ম আজ নিজেকে পৃথিবীর সুখি মানুষটি ভেবে আনন্দ পায়।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত