মিতু পরী না হলেও পরীর চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বাপ মার মাথার বোঝা হয়ে তার জন্ম হয়, অভাবী এক সংসারে। সংসারের আর্থিক সংকট দূর করার জন্যই মিতুকে ষোল বছর বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়। মিতুর স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে পরিবারের অভাব ঘুচাবে। গরীবের যে স্বপ্ন দেখা নিষেধ! মিতুর স্বামীর নাম আক্কাস আলী। আক্কাস আলীর না আছে রূপ না আছে ধনদৌলত। তবুও মিতুকে তার কাছে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। আক্কাস আলী অবশ্য বিয়ে করতে চায়নি। শুরু থেকেই তার এককথা “আমি দেখতে শুনতে ভালো না, বয়স হইছে এই মেয়ের বিয়ে আমার সাথে হলে জীবনে সুখী হতে পারবে না” তবুও জোড় করে আক্কাস আলীকে বিয়ে করানো হয়। বিয়ের ছয় মাস কেটে গেছে। এখনো আক্কাস আর মিতুর ভাব হয়নি। রাতে আক্কাস ঘুমায় মাটিতে মাদুর পেতে মিতু এক পা ভাংগা খাটে। মিতু অনেক দিন আক্কাস-কে খাটে ঘুমানোর জন্য বলেছে। প্রতিবারই আক্কাস বলেছে “আমি মোটা মানুষ। ওজন বেশি। এমনিতেই খাটে এক পা ভাঙা। আমার ওজন সহ্য করতে পারব না” মিতুও বারাবারি করেনি।
আক্কাস আলীর পেশা বাজারে মাছ কাটা। দৈনিক দশ-একারোটা মাছ কেটে যে টাকা পায় সেই টাকা দিয়েই তিন বেলা পেটের ইন্দুর মারে। আক্কাস আলীর অনেক ইচ্ছা তার বৌকে সে কিছু কিনে দিবে। কিন্তু টাকা কই, একবেলার খাবার জোগাড় করতেই যে সব টাকা শেষ।
দেখতে দেখতে বছর কেটে গেলো। আক্কাস আলী সারাদিন বাইরে থাকে। মিতু একলা একলা ঘরের মেঝেতে বসে থাকে। কখনো সে চোখে কাজল দেয়। কখনো ঠোঁটে লাল টকটকা লিপস্টিক দেয়। আবার উঠিয়ে ফেলে। কখনো কান্না করে। এভাবেই মিতুর দিন কাটে। এক সাজের বেলা আক্কাস মাছ কাটা শেষ করে বাড়ি ফিরেছে। ঘরে ঢুকতেই দেখে মিতু পুতুলের মতো করে সেজে কান্না করছে। সেদিন রাতে আক্কাস কিছু আর মুখে তুলল না। ঘর থেকে বের হয়ে শীতালক্ষী নদীর পারে গিয়ে বসে রইল। আকাশে অনেক বড় একটা চাঁদ উঠেছে। গভীর রাতে আক্কাস বাড়ি ফিরল। মিতু ঘুমাচ্ছে। জানালা দিয়ে চাঁদর আলো মিতুর মুখে পরেছে। মিতুকে আজ পরীর মতো লাগছে। আক্কাস অনেকক্ষণ মিতুর দিকে চেয়ে রইল। মিতুর ঘুম ভেংগে গেছে। সে আক্কাসের দিকে তাকিয়ে আবার কেদে দিলো। মিতু কাদছে আর আক্কাস দেখছে। কেটে গেলো একটি রাত।
সকালবেলা রান্নাঘর থেকে গুনগুন শব্দ হচ্ছে। আক্কাসের ঘুম ভেংগে গেলো। বুঝতে পারলো মিতুর আজ মন ভালো। গতকাল রাতে আক্কাস মিতুর ভাব হয়েছে। আক্কাস রান্না ঘরে ঢুকে দেখে মিতু রান্না করছে। রান্নাঘরে কিছু নেই তবুও সে মরিচ গুড়া, আদা বাটা, পেয়াজ তেলে নাড়ছে। আক্কাস বলছে ” রান্দদের তো কিছুই নাই, তাইলে তেলে মরিচ পেয়াজ ভাজার কারণ কী” মিতু জানালার দিকে চেয়ে বলছে “আমার বয়স তহন ৭ বছর। পাশের বাইত্তে চিতল মাছ রান্না হইতাছিল। আমি আম্মার কাছে কইলাম চিতল মাছ খামু। সেদিন ঘরে রন্দনের কিছুই আছিল না। তহন আম্মা আমারে শান্তনা দেওয়ার লাইজ্ঞা ঠিক এমনেই তেলে পিয়াইজ, মরিচ গুড়া, আদা লারতেছিল। আমি ভাবছি সত্যি সত্যি চিতল মাছ রান্তাছে।
আম্মা সেদিন সারা দিন এভাবে নাড়ছিল, যহন আমি বলি আর কতোক্ষণ লাগব। বারবারই আম্মা বলত এইত্তো হয়ে গেছে আরেকটু খাড়া মা। সেদিন রাইতেই আম্মা মইরা গেলো” মিতুর চোখে জল। মিতুর চোখের জল আক্কাসের দেখার সাহস নেই। আক্কাস বাড়ি থেকে তার মাছ কাটার বটি নিয়া বাজারে গেলো। আক্কাসের মনে চিতল মাছ ঘুরছে। সে ঠিক করছে আজ বাড়ি ফিরার সময় যেকরেই হোক চিতল মাছ সাথে নিয়ে ফিরবে। চিতল কেনার সমর্থ তার নেই। তবুও আজ সে চিতল নিয়ে ফিরবে। বাজারে আজ বিশাল এক চিতল উঠেছে। আক্কাস দাম জিগাইতেই দোকানদার বলল “এই মাছ ফকিন্নিরপুতের লাইজ্ঞা না এইডার দাম সাতশ টাহা। তুই যদি ছয়শ পঞ্চাশ দিতে পারস তাইলে দিয়া দিম” আক্কাস কিছু না বলেই তার আস্থানায় গিয়ে বসল। এক বাবু হাসি হাসি মুখে চিতলটা নিয়া আক্কাসের সামনে হাজির।
বাবু বলছে “শোন মাছের পিছ বড় করে কাটবি। বাইত্তে মাইয়্যা জামাই আইব বুঝলি? ভালো করে কাটলে ৭টাকার জায়গায় ১০ টাকা দিম” আক্কাস মাছ কাটতে ব্যস্ত। তার মাথায় এখনো চিতল ঘুরছে। হঠাৎ করে তার আংগুল দিয়ে রক্ত বের হয়ে গেলো। ধারালো বটির সাথে আংগুল লেগে গেছে। হাতে নোংরা একটা কাপড় প্যাচ দিয়ে আবার মাছ কাটা শুরু করছে। মাছ টুকরা করছে আর ডালার মধ্যে রাখছে। বাবু একটু অন্যদিকে তাকাতেই দুই টুকরা মাছ আইশের সাথে ময়লার পাতিলে ফালাইয়া দিল। আক্কাস এক গাল হেসে বাবুর দিকে মাছের ডালা বাড়িয়ে দিল। বাবু তাকে দশ টাকার একটা নোট দিল। আর বলল “দেখি মাছের আইশের ভিত্তে আবার টুকরা রাইখা দিলি নি, কুত্তারে বিশ্বাস করা যায় কিন্তু তোগো মতো নিচু জাতের মানুষরে না” আক্কাস আইশের নিচ দেখাতেই বের হয়ে আসল দুই টুকরা রুপালী মাছ। রেগে গিয়ে বাবু আক্কাসের গালে বসিয়ে দিল এক চড়। বাবু চোর চোর বলে চিল্লায়ে পুরো বাজার মাথায় তুললেন। বাজার কমিটি আসলে আক্কাসের শাস্তি দেওয়া হবে। কমিটি সিদ্ধান্ত নিলো ভবিষ্যতে যাতে কেউ এমন কাজ করতে সাহস না পায়। তাই আক্কাসকে বাজারের রাস্তায় বাবুর জুতা গলায় ঝুলিয়ে, কানে ধরে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
আক্কাস জুতার মালা পরে কানে হাত দিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার সমস্ত পৃথিবী যেনো কালো হয়ে আসছে।
বিকেল গড়িয়ে রাত নেমে এলো। মিতু চুলা জ্বেলে আক্কাসের অপেক্ষা করছে। কখন আক্কাস রূপালী দুই টুকরা মাছ নিয়ে এসে বলবে “রান্না খারাপ হলে আজ আমি নিচে ঘুমাব”