আমরা যারা রবি ঠাকুর বলি, শুনি, পড়ি বা গাই- আমাদের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রথম আলাপ হয় মা-বাবা, শিক্ষক কিম্বা নিছক পড়ার বইয়ের হাত ধরে। কেউ উপহার পেয়েছি, কেউ বাড়িতে পরম্পরায়, কেউ শখে ,কেউ বা লাইব্রেরীতে। যে মেয়েটার কথা এখন বলব, তার সাথে রবির আলাপ কিছুটা অন্যরকম, কিছুটা ব্যতিক্রম।
সকাল থেকে সময় যেন কাটছে না লক্ষ্মীর, যদিও সপ্তাহের ছটা দিন জুড়ে শুধু এই একটা দিনই খেলা করে তার মাথার মধ্যে । আজ যে ছুটি, নিয়মিত প্রতিদিনের ছুটি। বাসী রুটি খেয়ে না খেয়ে রোদ্দুর পায়ে হেঁটে যাওয়া সেই পথটার ছুটি। আজ সব্বার ছুটি, শুধু মাকে ছাড়া। মন থেকে না হলেও মার এই যাওয়াটাকে চুপচাপ মেনে নেয় লক্ষী, প্রতিবার,মা ফিরলে একটু ভালো খাওয়া জুটবে এইভেবে।
রোজকার পোড়া রুটি, আলুনী তরকারিরা রোববার কিরকম যেন বদলে যায় লুচি-পরোটায়। হারিয়েই গেছিলো মনটা।“কি রে? কখন থেকে ডাকছি…” লক্ষীর চোখ প্রথমেই চলে যায় মার ঝুলিতে। আজ যেন প্রয়োজনের থেকে একটু বেশীই বড় সেটা। তাহলে কি বিশেষ কিছু? অনেক পরিমাণে? “দ্যাখ তো এগুলো, বাবুদের বাড়ি থেকে দিলে, বললে পুরনো হয়ে গেছে, পোকা ধরে গেছে, আমি ভাবলাম নিয়ে আসি, বেচলে যদি কিছু আসে…”
সেফটিপিনে গোঁজাতালি মারা সঞ্চয়-পুঁটলি থেকে একে একে বেরোতে থাকে বাঁধাই করা শব্দ বাক্য ঝাঁক।পড়ে পাওয়া ছুটির দুপুরে ছদিনের একটু একটু জমা খিদেরা কি আর শান্তি পায় এতে?ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ভাঙ্গাচোরা চারপেয়ে জুড়ে একে একে সাজানো শুরু করে মোটা মোটা বইগুলোকে। ছবিটা চেনা, নামটাও শুনেছে স্কুলে বারকয়েক। খানিকটা কৌতূহল নিয়েই ওল্টাতে থাকে পাতা।সময়ের ওজোন কালো অক্ষরগুলোয় কেমন পাক ধরিয়েছে, ভাঁজ ফেলেছে, বই-পোকাদের ঘরবাড়ি ছোটবড় নানা রকমের এদিক সেদিকে। হঠাৎই চোখ আটকে গেল কয়েকটা লাইনে, একি এসব কি লেখা?
“ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে
কাগজ নৌকা খানি
লিখে রাখি তাতে আপনার নাম,
লিখি আমাদের বাড়ি কোন গ্রাম
বড় বড় করে মোটা অক্ষরে
যতনে লাইন টানি।
যদি সে নৌকা আর কোন দেশে,
আর কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষ,
আমার লিখন পড়িয়া তখন
বুঝিবে সে অনুমানি,
কার কাছ হতে ভেসে এল স্রোতে
কাগজ নৌকা খানি।….”
মেয়েটার চোখ চলে যায় , নোনা ধরা জীর্ণ তাক ঘেঁষে উঁকি মারে দিস্তে খাতার নৌকোরা।
দেখতে দেখতে আরও কয়েকটা বছর চলে যায়। লক্ষ্মীও বড় হয় আস্তে আস্তে। বস্তির দমবন্ধ চিটচিটে আস্তানা, নাইনের ক্লাসরুমটা আর ঘ্যানঘ্যানে অভাব নিয়ে। তবু ওই বইগুলো তাকে যেন ভীষণভাবে টানত। রোজ যে নিয়ম মেনে পড়ত, কিম্বা খুব যে একটা ভালোলাগা বইগুলোকে ঘিরে তাও ঠিক নয়। বরং যত্নের অভাবে আরও কিছুটা বৃদ্ধ, আরও কিছুটা দূর্বল হয়ে গেছে পাতাগুলো এই ক’বছরে। লক্ষীর শুধু ভয় হত, পরীক্ষার ঠিক আগে নিজের কাছে ধরা পড়ার মতো একটা ভয়। ইতিহাসের মোগল সাম্রাজ্য পেরিয়ে ধোবিঘাটে ডিঙ্গি নৌকার ছলাৎছল হয়ে বেড়ানো তার ইচ্ছেগুলো, রোববারের বিকেলে মন-খারাপি আলোয় ভারি হয়ে ওঠা তার মেয়েবেলা, অথবা সমস্ত না-পাওয়ার না-হওয়ার গরিবিয়ানা ফেলে ডানবার মাঠের ধুলো-মাটি-সোঁদা গন্ধ মেখে ঘাসফড়িঙ হওয়া স্বপ্নেরা, সাদা খাতায় খামখেয়ালী পেন্সিল আঁকিবুকির দল কখনো বা মাঝরাতে চোখ জুড়ে অকারণ বালিশ-ভেজা ঘুমটা — সবই কেমন যেন লেখা আছে ওই বেঢপ বইগুলোর পাতায় পাতায়। কি অদ্ভুত ভাবে তার সমস্ত অনুভূতি, তার অস্থি-মজ্জা–শিরা-ধমনী-সত্ত্বা জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো সমস্ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ারা অবধারিত বাধা পড়ে আছে ওই ছেঁড়াখোঁড়া শব্দগুলোয়।
ভাবতে ভাবতে অবাক হওয়ারা বেড়েই চলছিল। বাধ সাধলো দাদার অসুখটা।বেশ কদিন ধরেই সারা গা জুড়ে যেন উনুনের তাপ। সস্তার ডাক্তার, সাধ্যের পথ্য, জ্বর তবু নামে না। একটু একটু করে এত বড় শরীরটা কিরকম পচে মিশে যাচ্ছিল বিছানার ময়লা জংলী ফুলগুলোয়। একদিন পুরোপুরি মিশে গেলো। সেদিন উঠোনে ছড়ানো দাদার শরীর-খোলস স্তূপ মাড়িয়ে, মায়ের ক্ষতবিক্ষত আদরগুলো পেরিয়ে ,শ্মশানে একের পর এক পুড়ে যাওয়া হাড়-মাংসের শব্দ মেখে লক্ষী যখন বাড়ি ফিরল, তার সমস্ত শরীর জুড়ে শুধুই ছাই মাখা অতীত। কিরকম একটা বেসামাল হাতে টানতে থাকলো আলমারি ঘেঁষে রাখা বইগুলোকে। আছড়ে ফেলতে থাকলো মাটিতে । খুঁজতে চাইলো সান্ত্বনা, আচমকা পোকা ধরা ঝুরঝুরে হলদে পাতায় ভেসে উঠলো
“জীবনের মধ্যে কোথাও যে কিছুমাত্র ফাঁক আছে, তাহা তখন জানিতাম না; সমস্তই হাসিকান্নায় একেবারে নিরেট করে বোনা।এমন সময় কোথা হইতে মৃত্যু আসিয়া এই অত্যন্ত প্রত্যক্ষ জীবনটার একটা প্রান্ত যখন এক মূহুর্তের মধ্যে ফাঁক করিয়া দিল, তখন মনটার মধ্যে কি ধাঁধাই লাগিয়া গেল। যাহা আছে, যাহা রহিল না, এই উভয়ের মধ্যে মিল করিব কেমন করিয়া। শূন্যতাকে মানুষ কোনোমতেই অন্তরের সঙ্গে বিশ্বাস করিতে পারে না। যাহা নাই তাহাই মিথ্যা, যাহা মিথ্যা তাহা নাই। তবু এই দুঃসহ দুঃখের ভিতর দিয়া আমার মনের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে একটা আকস্মিক আনন্দের হাওয়া বহিতে লাগিল, তাহাতে আমি নিজেই আশ্চর্য হইতাম। জীবন যে একেবারে অবিচলিত নিশ্চিত নহে, এই দুঃখের সংবাদে মনের ভার লঘু হইয়া গেল। আমরা যে নিঃশ্চল সত্যের পাথরে গাঁথা দেওয়ালের মধ্যে চিরদিনের কয়েদি নহি, এই চিন্তায় আমি ভিতরে ভিতরে উল্লাস বোধ করিতে লাগিলাম। সংসারের বিশ্বব্যাপী অতি বিপুল ভার জীবনমৃত্যুর হরণপূরণে আপনাকে আপনি সহজেই নিয়মিত করিয়া চারিদিকে কেবলই প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে, সে ভার বদ্ধ হইয়া কাহাকেও কোনোখানে চাপিয়া রাখিয়া দিবে না – একেশ্বর জীবনের দৌরাত্ম্য বহন করিতে হইবে না –এই কথাটা একটা আশ্চর্য নূতন সত্যের মত আমি সেদিন যেন প্রথম উপলব্ধি করিয়াছিলাম।“
লক্ষ্মী চোখ তুলে তাকালো, কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও বিছানার যেখানটা জুড়ে দাদার শেষ স্পর্শটুঁকু মিলিয়ে যাচ্ছিল গতকালে, ঠিক সেইখানেই জীবনের খোঁজ শুরু করেছে বেঁচে যাওয়া আগামী ।
আরও কিছু বছর, লক্ষী আরও কিছুটা পরিনত। স্কুল গণ্ডি পেরিয়ে কোনোমতে কলেজ। মা আরও একটু ভঙ্গুর শরীরে-মনে। লক্ষ্মী কিছুটা সামলিয়েছে মৃত্যুকে। এখন শুধু ঘুপচি দেওয়ালে লেগে থাকা সবসময়ের দৈন্যতা ছাড়াও তার জীবনে এসেছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চের সেই ছেলেটা। হাতচিঠির হাতছানি, নরম আঙুল ছোঁয়াছুয়ি খেলায় কাটছিল বেশ। কলেজ ছুটির এক দুপুরে কি মনে হল আবার বসল সেই খেলায় ,বইগুলোকে নিয়ে। এবার সে লাজুক, ভরসা জন্মেছে কিছুটা । তার শরীরজোড়া শিরশিরানি, চোখের কোণে খুচরো সোহাগ-পরাগ, আর নখের ডগায় বিন্দু বিন্দু দ্বিধারা ওই বইগুলোতেই আছে হয়তোবা। লক্ষ্মীর অনুমান সত্যি হয়ে যায় যথারীতি…
“আমি যে তোমায় জানি সেতো কেউ জানে না
তুমি মোর পানে চাও , সেতো কেউ মানে না
মোর মুখে পেলে তোমার আভাস
কত জনে করে কত পরিহাস
পাছে সে না পারে সহিতে
নানা ছলে ডাকি যে তোমায়
কেহ কিছু নারে কহিতে
বলিনে তো কারে, সকালে বিকালে
তোমার পথের মাঝেতে
বাঁশি বুকে লয়ে বিনা কাজে আসি
বেড়াই ছদ্মসাজেতে
যাহা মুখে আসে গাই সেই গান
নানা রাগিণীতে নিয়ে নানা তান
এক গান রাখি গোপনে
নানা মুখপানে আঁখি মেলি চাই
তোমা পানে চাই স্বপনে….”
আদুরে বিকেলে বুড়ো পাতা জুড়ে খেলা করে যৌবন।
সকালের চায়ের অভ্যেসটা যেভাবে রোজের কাপগুলো থেকে সরতে চায় না কিছুতেই, সেরকম লক্ষ্মী নামের মেয়েদের জীবন জুড়েও দুঃখটা ধ্রুবক। কলেজ থেকে ফিরতে সেদিন একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছিলো। ভিড় বাসটা থেকে নেমে দু’পা হাঁটতেই বিট্টুর সঙ্গে দেখা “দিদি তোমার মা… তুমি শিগগিরি চল।” যন্ত্রের মতো ছুটতে থাকে লক্ষ্মী, দৌড় যেখানে শেষ হয় ,সেখানে মায়ের ছোট হয়ে যাওয়া দোমড়ানো কোঁচকানো প্রাণটা রেললাইনের পাশে শান্ত পড়ে আছে। চারদিকে জড় হওয়া ভিড় থেকে গুটিকয়েক কাকিমা বৌদিরা ওকে জড়িয়ে কান্না বাঁধতে শুরু করে, তবু লক্ষ্মী কেমন অস্বাভাবিক স্থির। এতো বছরের সমস্ত টানাপোড়েন হাসি-রাগ-অভিমান-ঝগড়া-সুখ দুঃখের সিঁড়ি ভাঙ্গা অঙ্ক সব পুড়িয়ে সব ফুরিয়ে লক্ষ্মী যখন বাড়ি ঢুকলো, বাইরে তখন আকাশ ভাঙছে –সর্বস্বান্ত। তার অসু/হৃদয় চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে ধূপ-মধু-ঘী-স্মৃতি মেশানো মৃত্যু। কুৎসিত, অনিবার্য শোক রঙচটা কড়িকাঠে স্পষ্ট হচ্ছে, প্রবল হচ্ছে, চেপে ধরছে আস্তে আস্তে ।লক্ষ্মী ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো , হাত রাখল ঝুলকালি মাখা বইগুলোতে। স্পর্শ এবার বিরক্তিহীন, ভয়হীন দ্বিধাহীন ।অর্ধেক জীবনের বিশ্বাস দুচোখে জড় করে বলে উঠলো
“দুঃখ যদি না পাবে তো
দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে
বিষকে বিষের দাহ দিয়ে
দহন করে মারতে হবে
জ্বলতে দে তোর আগুনটারে
ভয় কিছু না করিস তারে
ছাই হয়ে সে নিভবে যখন
জ্বলবে না আর কভু তবে
এড়িয়ে তারে পালাস নারে
ধরা দিতে হোস না কাতর
দীর্ঘ পথে ছুটে কেবল
দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর
মরতে মরতে মরণটারে
শেষ করে দে একেবারে
তারপরে সেই জীবন এসে
আপন আসন আপনি লবে”
লক্ষ্মী চোখ মেললো , খাটের গায়ে জামরঙ্গা আঁচলের মায়া-মায়া গন্ধ, আলনায় উঁকি মারা নীল শার্টটার শ্বাসপ্রশ্বাস, আর তার একলা বেঁচে থাকা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মাথা তুলে, তারপর ফুসফুস ভরে সঞ্জীবনী সুধা ছড়িয়ে দিলো আকাশে বাতাসে।