– আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে/
বসন্তের বাতাসটুকুর মত — ‘
হৃদয়ের সবটুকু বিষাদ যেন ভিড় করেছিল পৃথার গলায় । পাত্রপক্ষের সামনে এরকম একটা গান ধরায় অবশ্য বিব্রত হয়েছিলেন বাড়ির সবাই । বিস্মিত অতিথিদের সামলাতে পৃথার মা বলেছিলেন – আসলে ও রবীন্দ্রসংগীত ভালোবাসে তো – কিন্তু কেন ওই গানটা সেই প্রশ্ন অনুচ্চারিত হয়েও সেদিনের বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছিল । শুধু উদাসী দৃষ্টি নিয়ে বসেছিল পৃথা । ওটা আমার খুব ফেভারিট গান – একমাত্র রাহুলের কথায় খানিকটা হালকা হয়েছিল পরিস্থিতি ।
রাহুল সেন – ডাক্তার । জমিয়ে পসার করার পর বাবা – মার অনুরোধে বলা যায় রোজের ‘ বিয়ে কর ‘- এর হাত থেকে বাঁচতে মেয়ে দেখতে আসা । আজকালকার ছেলে হলেও প্রেম ব্যাপারটাতে বোধহয় কেরিয়ার গড়তেই আর মন দেওয়া হয়নি ।কিন্তু পৃথার উদাসী দৃষ্টিতে আটকে গেল মনটা ।
‘ ছাড় বাবু , দুনিয়ায় মেয়ের অভাব নেই ; তাছাড়া দেখে তো মনে হল না বিয়ে করার একটুও ইচ্ছা আছে বলে ।’ উমাদেবীর কথার উত্তরে রাহুল বলল – ‘ আমার কিন্তু বিশেষ আপত্তি নেই মা । আর সত্যিই কথা বলতে কি জিনিসপত্র কেনাবেচার মত পাল্লায় পাল্লায় মেয়ে দেখে বেড়াতে আমার রুচিতে বাধে । আমার যখন কোনো প্রেম নেই তখন পৃথা কিংবা মিতা কোনোটাতেই আপত্তি থাকার কথা নয় ।
ছেলের কথার ভিত্তিতেই আর বেশি এগিয়ে গেলেন না উমাদেবী । তার স্বামীও বললেন – ছেড়ে দাও , কি প্রয়োজন । খারাপ তো কিছু দেখলাম না । যেহেতু তিন জনের সংসার তাই মাসি – পিসিদের মতামতে ভারাক্রান্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হল না ।
কিন্তু পৃথা তখন প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার । ‘ তুই কি মনে করেছিস সারাজীবন এই ভাবেই কাটানো যায় ? ‘ – মায়ের কথার সূত্র ধরেই দাদার ধমক ‘ শোন স্মৃতি নিয়ে গল্প – উপন্যাস চলে , জীবন নয় । আর পড়াশোনাতেও এমন কিছু আহামরি নও তুমি যে ডেকে তোমায় কেউ চাকরি দেবে – বাবার সংযোজন । তাই বিয়ে তোমায় করতেই হবে At any cost ।
নতমুখে চুপ করেছিল পৃথা । সত্যিই তো এদের কথায় যুক্তি আছে । কতদিন আর – কিন্তু নতুন কারোও কথা ভাবলেই যেন কানের কাছে কেউ বলে যায় – ‘ মিশে আছি আমি তোর অস্থিমজ্জায় -‘ শিউরে ওঠে পৃথা । অবুঝ চোখ দুটো বারবার চলে যায় চারিদিকে । একরাশ হাওয়া বলে যায় – কেউ নেই – ‘ সব ঝুট হ্যায় ‘-
” দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ও পারে – / আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাইনে তোমারে – ” সুরের মূর্ছনায় মেদুর হয়েছিল college fest – এর হল । গান করে নেমে আসার পর ঋজু হাত বাড়িয়ে পৃথার দিকে বলেছিল excellent । তুমিও তো তবলাটা খুব ভালোই বাজাও । বাঃ প্রথাগত ধন্যবাদ না দিয়ে উল্টোদিকের মানুষের প্রশংসা ; নতুন লাগলো – বলে দাঁড়িয়ে পড়েছিল ঋজু । বাড়ানো হাতে করমর্দন করে পৃথা বলেছিল সঙ্গত সঠিক না হলে সঙ্গীত মধুর লাগে না । এভাবেই শুরু হয়েছিল ওদের প্রথম আলাপ ।
আলাপ প্রেমালাপের সংঞ্জা পেতে সময় নেয়নি বেশিদিন । মধ্যবিত্ত রিজুর চোখে মহান হবার স্বপ্ন না থাকলেও প্রতিষ্ঠা পাবার ঝোঁক ছিল । পড়াশোনার মাঝেও নিজেকে দায়িত্ব নেওয়ার উপযোগী করে তুলতে সে Rice Mill এ কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল । ‘ হাতে কালি কেন এত ‘- পৃথার প্রশ্নের উত্তরে ঋজুর জবাব ছিল কারোর হাতটা নরম আর সুন্দর রাখার জন্য । সলজ্জ হেসে চোখ নামিয়ে ছিল পৃথা । পৃথার সাহায্যে ঋজুর কামাই করা কলেজের দিনগুলোয় পড়াশোনার অসুবিধাও হত না ।
কিন্তু কিছু গান মাঝপথে থেমে যায় । কিছু গুরুত্বপূর্ণ মেশিনের দায়িত্বে ছিল ঋজু । বন্ধ হয়ে যাওয়া মেশিনে পরীক্ষা করতে গিয়ে গুরুতর ভাবে জখম হয় সে । হৃদপিণ্ডের শেষ স্পন্দন থেমে যাওয়ার আগে পৃথার হাত ধরে নার্সিং হোমে বলে যায় ‘ Forget & forgive me , জীবনটা অনেক সুন্দরভাবে সাজাতে চেয়েছিলাম পৃথা । ভগবান সময় দিল না । ভালো থাকিস ।’ ইতি ঘটে গেল দু বছরের কুঁড়ি থেকে ফুল হতে চাওয়া একটা সম্পর্কের ।
সময় কখন থেমে থাকে না । সূর্য নিজের নিয়মে ওঠে আর অস্ত যায় – সঙ্গে নিয়ে যায় অনেক অনুভূতি । পৃথার বুকেও সময়ের পলি পড়তে লাগল । শুধু ভিসুভিয়াসের মত ঘুমন্ত হয়ে রইল ঋজুর স্মৃতি । তারপর জীবনের দোহাই কিংবা পরিবারের দায় মেনে রাহুলের সঙ্গে বিয়েতে রাজি হতে হল ওকে । Engagement এর দিনও ঠিক হল । পৃথার পক্ষে সুবিধা হল যে রাহুল এখুনি বিয়েতে রাজি নয় । নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার বেশ কিছুটা সময় হাতে পেল সে ।
কি গো মেয়ে হাত টা বাড়াও দেখি – সলজ্জ রাহুল হাতটা ধরে দেখল অনামিকা অধিকার করে আছে অনামী এক আংটি । সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চোখ তুলতেই পৃথা মৃদু অথচ দৃঢ় গলায় জানাল ‘ আমি ও আংটি খুলতে পারব না । আপনি অন্য যে কোনো আঙুলে আংটি পড়ান ।’ রাহুল কিছুক্ষন চুপ করে থেকে নিজের মোবাইলটা পকেট থেকে বার করে হঠাৎ বলল – ‘ হ্যাঁ আমি আসছি । ‘ চরম নাটকীয়তা সৃষ্টি করে বলল – ‘ আমাকে ক্ষমা করবেন । আমার পেশেন্ট এমার্জেন্সিতে । তাই আমার পক্ষে এই মুহূর্তে আংটি বদল করা সম্ভব হল না । ‘ হতবাক মানুষগুলোকে কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রাহুল শুধু বেরিয়ে গেল । যদিও সেদিন খুব ঘনিষ্ঠ কজন ছিল অনুষ্ঠানে । তবুও কোথাও যেন অশান্তির কালো মেঘ ঘনিয়ে এল সেদিনের আকাশে । রাহুল খুব কর্তব্য পরায়ণ – এই যুক্তিটা কিছুটা হলেও জোলো শোনালো ওর মায়ের গলায় ।
ঘন্টা খানেক বাদে পৃথার মোবাইলে Whatsapp ঢুকল বিকেল ৪টে তে ‘ বৈকালিক ‘ ক্যাফে তে আসবেন কথা আছে । অস্থির লাগছিল ৩টে থেকেই । Seen করেও কোন reply দেয়নি পৃথা । হালকা হলুদ রং বিকেলের আকাশ অধিকার করে আছে । সেই বিবর্ণতার সাথে মিশে যাবে কি রাহুলের অনুভূতি ? কে জানে ! হলুদ আকাশকে পাল্লা দিয়ে হলুদ রঙের চুড়িদার পরে ক্যাফেতে এল পৃথা । টেবিলএ বসে কথা শুরু করার জন্যে রাহুল বলল বাঃ আপনি বেশ punctual তো ! ঘড়ির কাঁটা এই ৪টে ছুঁলো ।
কি বলবেন বলুন ।
রাহুল চুপ করে রইল ।
পৃথা বলল – ‘ আমার আংটির ব্যাপারে আপনার বোধহয় কিছু কথা ছিল । শুনুন রাহুল , আমি মরে গেলেও ও আংটি খুলতে পারব না । ওটা ঋজুর মানে আমার প্রথম ভালোবাসার শেষ চিহ্ন । সেক্ষেত্রে আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে আপনার জীবনের সঙ্গে নাই জড়াতে পারেন -‘ বলে চুপ করল সে ।
‘বেশ , বোঝা গেল ।। জীবনসঙ্গী না হলেও বন্ধুত্বটা চলতে পারে ‘ বলে হাত বাড়ালো রাহুল। আর এমনিতেই আমাকে ছমাসের জন্যে বাইরে যেতে হবে , দিল্লিতে । বিয়ে এখন করতে পারতাম না । আপত্তি না থাকলে পরিচয়টা
অপরিচয়ের গন্ডি টপকাতে পারে । আপনার অনুভূতি কে অসম্মান করবো না একথা বলতে পারি । রাহুলের বাড়ানো হাতে হাত রাখল পৃথা ।
ফোনে কথাবার্তা চলতে লাগল । সকালে একবার আর রাতে ঘুমাতে যাবার আগে একবার প্রায় অভ্যাস হয়ে গেল দুজনেরই । ‘ ওরা কোনো law মানে না / তাই ওদের নাম ললনা
– কথাটা বোধহয় সত্যিই । এখন পৃথার ফোন রাহুলের মোবাইলে আগে ঢোকে । ‘ রাতে বেশিক্ষন জাগবেন না ‘ এ ধরণের নির্দেশ নামাও রাহুলের উপর বার্তায় । বলা বাহুল্য রাহুলের তাতে মন্দ লাগে না ।
বেশ কিছুদিন ধরে রাহুলকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না । বহুবার Not reachable শোনানো ফোনটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে পৃথা । বাড়িতে কোনো কথা বলতে পারছে না । আসলে engagement ভেঙে যাবার পর সকলেই বিমর্ষ । ছমাস পর কথাবার্তা কোন দিকে এগোয় সেটাই এখন দেখার । পৃথার বাড়ি থেকেও সেভাবে বিষয়টা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হয়নি । তাই অস্থির পৃথা কি করবে কিছু বুঝতে পারলো না । প্রায় এক সপ্তাহ পরে ফোন করল রাহুল – হ্যালো কেমন আছেন ? বলতেই পৃথা ঝড়ের গতিতে প্রশ্ন করল ‘ তুমি ফোন ধরনি কেন ? এতদিন আমি কিভাবে কাটিয়েছি কোন ধারণা আছে তোমার ? এতটা Irresponsible লোকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাই আমার উচিত হয়নি ‘- etc etc . উত্তেজনায় কখন সে তুমিতে নেমে এসেছে খেয়ালই করেনি ।
‘সম্পর্ক আর সত্যিই থাকবে না পৃথা ।’ ঠান্ডা গলায় রাহুল জানাল । আজ আর একবার আসবেন ‘ বৈকালিক ‘ -এ ? নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলনা পৃথা । ছেড়ে দেওয়া গলায় বলল – ক’টায় ?
৪টে বলে ফোন রাখল রাহুল ।
এক বিকালে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল । আজ আবারও এক বিকেলে দুজনে মুখোমুখি । পৃথার হাতে রাহুলের হাতটা শক্ত করে ধরা । বেশ খানিকক্ষণ পার পৃথা বলল – আমি আমার ভালোবাসাকে বারবার হারাতে পারব না রাহুল । সপ্রশ্ন অথচ মুগ্ধ রাহুলের দৃষ্টি অভিষিক্ত করছিল পৃথাকে । দৃঢ় গলায় চোখের জল মুছে পৃথা বলল – ‘ হ্যাঁ রাহুল , কখন কিভাবে তুমি আমার মনে জায়গা করে নিয়েছ বলতে পারব না নির্দিষ্ট করে । কিন্তু এ কথাও ঠিক তুমি এখন আমার জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে উঠেছ , এই সাতদিনে একথা আমি পুরোপুরি বুঝেছি । না রাহুল । ঋজু আমায় সময় দেয়নি । কিন্তু তোমাকে এভাবে আমি ছেড়ে দিতে পারি না । তুমি না ডাক্তার ? এইভাবে ভেঙে পড়তে তুমি পার না । একবার লড়েই দেখি । সত্যিই আমার ভাগ্য ভালোবাসাকে টিকিয়ে রাখতে পারে কিনা । ‘
আসলে রাহুলের শরীরে একটি বিরল রোগ বাসা বেঁধেছে । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার কোন নিরাময় হয় না । তাই আজ রাহুল সম্পর্ক ছিন্ন করতেই এসেছিল । কিন্তু এই নতুন পৃথার সঙ্গে তার পরিচয় ছিল না ।
যেন এক তীব্র নেশায় দিনরাত এক করে রাহুলকে মনোবল জোগাতে লাগল পৃথা । বাড়িতেও সে নিজের মনোভাব জানিয়েছে । তার বাবা মা যখন তাকে অন্য কোথাও পাত্রস্থ করার কথা বলেছিল তখন সে উত্তর দিয়েছিল – ‘ তোমাদের দেখানো পথেই তো হাঁটছি মা ; বারবার তোমাদের কথায় পথ পাল্টানো সম্ভব নয় বাবা । আমি রক্ত মাংসের মানুষ , বাজারের আলু পটল নই।’
মির্যাকল – ডাক্তারবাবু বললেন – আমি ভাবিনি রাহুল তুমি এত তাড়াতাড়ি recover করবে ।
তোমার মনের জোর অসাধারণ । বেশিরভাগ সময় এই সব রোগের রোগীরা মনোবলের অভাবেই শেষ হয়ে যায় । স্মিতমুখে রাহুল চুপ করে রইল । মনে মনে বলল – কোন অবস্থাতেই পৃথাকে আমি হেরে যেতে দিতে পারতাম না । ও যে আমার প্রথম ভালোবাসা । বড় যত্নের ধন । হেরে গেলে আমি মরেগেলেও শান্তি পেতাম না ।
আজ রাহুল পৃথার ফুলশয্যা । রাতে পৃথা রাহুলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল । বিস্মিত রাহুল দেখল অনামিকা আজ ফাঁকা । কিছু বলার আগেই পৃথা বলল – ঋজুর প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি তুমি আসার পর বুঝেছি অতীত রসদ দেয় । কিন্তু তাকে আঁকড়ে চলা যায় না । তুমি আজ আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছ , তাই হৃদয়ের সঙ্গে সংযোগকারী আঙুলে তোমার চিহ্ন থাকবে । হাসিমুখে রাহুল আংটিটা পাড়িয়ে দিল । রাহুলের বক্ষলগ্না হল পৃথা ; শুরু হল ওদের নবজীবন ।