কথায় বলে “মামারবাড়ি ভারি মজা, কিল চড় নাই!” সুজন এখন ক্লাস নাইনে উঠে গেছে। তাই কিল চড়ের ভয় নিজের বাড়িতেও এখন নেই। কিল চড় না থাকলেও বাড়ির ব্যাপার অন্য। নিত্য নিয়ম, স্কুল, প্রাইভেট টিউশন, শাসন অনুশাসন ইত্যাদি থেকে রেহাই নেই। বাড়িতে কি আর এতটা স্বাধীনতা পাওয়া যায়? সেক্ষেত্রে মামারবাড়ি এলে সুজন ওর বাবার কথায় “হাতে চাঁদ পায়” আর মায়ের কথায় “সাপের পাঁচ পা দেখে।” সে কলকাতার ছেলে। গ্রামে মামারবাড়ি হওয়ার একটা মস্ত সুবিধা হলো, শহরের মত চার দেওয়াল আর পার্ক, শপিং মলে ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ থাকে না। চারিদিক উন্মুক্ত। পুকুর, মাঠ, বাঁশ বাগান সর্বত্রই অবাধ গতি। তার উপর প্রায় সারা গ্রামের লোকই চেনা, সকলেই মামা কিংবা মাসি। সুতরাং কোথায় যাবে, কোথায় ঘুরবে সে ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা কর্তৃপক্ষ জারি করেননি। শুধু একটাই সমস্যা, এখানে মাঝে মাঝেই পাওয়ার কাট হয়। যদিও এখন শীতের সময়, এখানে ঠাণ্ডা কলকাতার থেকে অনেকটাই বেশি, তাই ফ্যান চালানোর প্রশ্ন নেই কিন্তু অন্ধকারে ওই হ্যারিকেন লণ্ঠন বা মোমবাতিতে বসে থাকতে ওর ভালো লাগে না।
সুজনের মামাতো ভাই ছোট্টু ক্লাস সিক্সে পড়ে।কিন্তু সিক্সে পড়লে কি হবে, সে এমন সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে, শুনলে মনে হবে সুজনের মতই বয়স।তাই তার সাথে সুজনের বেশ সদ্ভাব। বোন তিতলি আরো ছোট, তাই তাকে খুব একটা পাত্তা দেয়না তারা। তাছাড়া ছোটদের সঙ্গে কথা বলেও সুখ নেই। তাই তাকে সযত্নে এড়িয়ে দুপুরবেলা খাওয়ার পরে দুজনে ছাদে বসে গল্প করছিল। মিঠে রোদটা বেশ ভালো লাগে এই সময়। একটা শুকনো হাওয়া চলছে বটে, তবে রোদের তেজ বেশী থাকায় আরাম লাগছে। ছাদ উঁচু করে ঘেরা, তাই বাড়ির কেউ কোন আপত্তি করে না ওদের এই ছাদে যাতায়াতে। একটা দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে এমনভাবে বসে পড়লো দুজন, যাতে মুখটা ছায়ায় থাকে, বাকিটা রোদ পায়। জমিয়ে বসা হলে তাদের গল্প শুরু হয়। একথা ওকথা হতে হতে হঠাৎ ছোট্টুর কি যেন মনে পড়ে যায় আর সে বলে ওঠে,
-“আরে সুজন দাদা, তোকে তো বলাই হয়নি, জানিস এখানে কি হয়েছে?”
-“কি হয়েছে?”
-“সে সাংঘাতিক ব্যাপার। মধু কাকু বলে একজন এখানে ফুচকা বিক্রী করতে আসতো। সবাই বলতো মধুর ফুচকা।”
-“হ্যাঁ জানি তো, আমিও তো কয়েকবার খেয়েছিলাম।”
-“যাক তাহলে তো তোর মনে আছে।”
-“হ্যাঁ, বল তারপর।”
-“হ্যাঁ বলি। তা সে মধু কাকুর বাড়ি কোথায়, কোথা থেকেই বা আসতো সে সব খবর আমার কাছে নেই। গ্রামের কেউ জানে বলেও শুনিনি। তবে এখানকার বাচ্চা বুড়ো সকলেই মধুর ফুচকার জন্য মুখিয়ে থাকতো। মনে পড়লেই জিভে জল এসে যায়।”
কোনক্রমে জিভের জল সামলে নিয়ে ছোট্টু আবার বলল,
-“কিন্তু আজ প্রায় মাস ছয় হয়ে গেল, মধু কাকু আসেনি। আমাদের পোস্টম্যান কাকু আছে না, যে ওই চিঠিপত্র নিয়ে আসে, সেই কাকু কোথা থেকে খবর পেয়েছিল, মধু কাকু নাকি ট্রেন এক্সিডেন্টে মারা গেছে। রেল লাইনের ধারের জমিগুলোতে যারা চাষ করে, তারা নাকি দেখেছে। তখন ওই সন্ধ্যে হয় হয়, মধু কাকু রেল লাইন পার হতে গিয়ে..”
-“ইস, খুব খারাপ খবর।”
-“হুঁ, সকলেই শুনে খুব দুঃখ পেয়েছিল। কিন্তু তারপর যা হয়েছে সেটা কিন্তু বেশ ভয়ের ব্যাপার।”
-“মানে? কি হয়েছে?”
-“এই ছ’মাসে কেউ কেউ নাকি সন্ধ্যের পর মধু কাকুকে দেখেছে, সেই ফুচকার গাড়ি নিয়ে হেঁটে যেতে।”
সুজন একটু ভীত স্বভাবের। এইসব শুনলে তার কেমন যেন হয়। তবে সেটা বুঝতে না দিয়ে সে বলল,
-“ব্যাস, ওমনি গুল গাপ্পি শুরু করলি?”
-“আরে না রে, সত্যি! রায়দাদুর নাতি ভুলু একা দেখলে আমিও বিশ্বাস করতাম না কিন্তু পুতুল পিসীও দেখেছে, শুধু দেখেইনি, পুতুল পিসী তো অজ্ঞানও হয়ে গেছিল। ভাব তাহলে! পুতুল পিসী হাসপাতালে চাকরী করে, নার্স না পুতুল পিসী! মা বলে মরা মানুষ দেখে দেখে ওর চোখ পচে গেছে, ও এমনি ভয় খাওয়ার মেয়ে নয়। নির্ঘাৎ সে আছে।”
সুজনের এই ভর দুপুরেও গা টা কেমন ছম ছম করে উঠলো। এসব কথা মিথ্যে বা ভুল হলেই ভালো হয় বটে, কিন্তু মন থেকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়াও তো সোজা নয়। সে যুক্তি সাজালো,
-“হয়তো মারা যায়নি। এমনি গুজব রটেছে, সে হয়তো যেমন আসতো তেমনি এসেছিল, এদিকে যারা দেখতে পেয়েছে তারা ভয় পেয়ে যাচ্ছে শুধু শুধু। তাই আর আসে না।”
-“আরে না না, ওটা পাকা খবর। বাবাও বলেছে।”
সুজন গম্ভীর ভাবে একটু টেনে উত্তর দিল, -“হুঁ।”
মামা যে ভুল বলবে না সে বিশ্বাস সুজনের আছে। তাই কথা না বাড়িয়ে সে সুযোগ বুঝে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো,
-“বিকেলে ওই সরকার পুকুরের পাশের মাঠটায় খেলতে যাবি?”
ছোট্টু এই কায়দাটা ধরতে পারলো না। তাই খেলার কথায় দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে আবার বকবক করতে লাগলো।
বিকেলবেলা গ্রামের ছেলেপুলে মোটামুটি এই মাঠেই জড়ো হয়। বিরাট মাঠটা ভাগ করে একদিকে ক্রিকেট আর একদিকে ফুটবল চলে।মাঠটার একধারে সরকারপুকুর, অন্যধারে মাঠের সীমানার বাইরে বয়স্করা এসে বসে। পুকুরের পাড়ে বাঁশের ঝোপ ঝাড় আছে কিছুটা, সেখানে কেউ কেউ লোকচক্ষু এড়িয়ে বিড়ি ফুঁকতে যায়। সুজন দারুন ক্রিকেট খেলে। ছোট্টুর পছন্দ ফুটবল। কিন্তু দাদার খাতিরে সেও ক্রিকেট খেললো আজ। খেলার পরে ছেলেরা সব আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে গেল। কেউ বলছে, ছোট্টু ক্যাচটা না ছাড়লে আমরাই জিততাম; তো কেউ বলছে, শেষ ওভারে পঞ্চুকে বল দেওয়াই ভুল হয়েছে ইত্যাদি। সুজন তো বেজায় খুশি, ও যে দলে ছিল সেই দলই জিতেছে। ছোট্টু ছিল অন্য দলে। দাদাকে ভালোবাসলেও খেলায় হার মেনে নেওয়া কি অত সোজা! তার ওপর ছোট্টুর ছোট হাতে বলটা না বসে সোজা বাউন্ডারি। আউট তো হলোই না, উপরন্তু চারটে রান বেশী হলো বিপক্ষের। তার থেকেও বড় কথা আঙুলে বেশ লেগেওছে। কিন্তু এসব হয়তো ও খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যেত যদি সুজন একটু সহানুভূতি দেখাতো। যদি একবার বলতো সে ভালো খেলেছে, কেবল ভাগ্যদোষে ক্যাচটা মিস হয়েছে, তাহলেও ছোট্টু খুশি হতে পারতো। কিন্তু সুজন জেতার আনন্দে কেবল হেসে গেল। তাই ছোট্টু কোন কথা বললো না, গুম মেরে রইলো।
শীতের বিকেল, কখন ঝুপ করে শেষ হয়ে সন্ধ্যে নামে বোঝা যায়না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যে নামলো। সব ছেলেরা বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠে পড়ল। সুজন বারবার বলা সত্ত্বেও ছোট্টু কিছুতেই বাড়ি যেতে চাইলো না। সে আরেকটু বসবে। ছোট্টুকে না নিয়েও তো ফেরা যায়না। অগত্যা সুজনও বসে রইল। আসলে ছোট্টুর মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি এসেছিল। ও জানতো ওর সুজন দাদা একটু ভীতু স্বভাবের। তাই দাদার উপর রাগ করে একটু ভয় দেখানোর মতলব করলো। মনে মনে ভেবে নিল, সুজন যখন ভয় পেয়ে চিৎকার করবে, তখন ছোট্টু ঠিক তেমনি করে হাসবে যেমনটি তখন সুজন হাসছিল। ছোট্টু ভাবছিল কি বলে ভয় দেখানো যায় দাদাকে, ঠিক এমন সময় শোনা গেল,
-“এই যে ভাই, ফুচকা খাবে নাকি?”
অন্ধকারে মাঠের এক কোণ থেকে গলাটা ভেসে এলো যেন। সুজন কিছুটা চমকে উঠলো। আশেপাশে আর কেউ কোত্থাও নেই। যে দু’একজন ছিল একটু আগে, তারাও চলে গেছে। ছোট্টু একমনে প্ল্যান করছিল, সেও ঘাবড়ে গেল। একে ঠাণ্ডা জোলো হাওয়া আসছে, তার উপর এমন অন্ধকার। সুজন কেঁপে উঠলো একটু। ঠিক তখনই আবার শুনতে পেল, “এসো এসো, ফুচকা খেয়ে যাও।”
চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। ভালো করে ঠাহর করা যাচ্ছে না কিছু। দূরে কয়েকটা আলো জ্বলছে কিন্তু সেই আলোয় কিছুই স্পষ্ট দেখা যায়না। তবু অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে যেমন আবছা দেখা যায়, সেরকম আবছা আলো আঁধারিতে সুজন দেখলো, একটা রোগা লোক জীর্ণ শীর্ণ হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকছে। পাশের ঝোঁপ থেকে একটা বিড়াল কেঁদে উঠলো। একদম বাচ্চা ছেলের মত আওয়াজ করে। পুরো পরিবেশটা কেমন পাল্টে যাচ্ছে।
ছোট্টু ভয়ে সুজনকে জাপটে ধরলো। সুজন ভয়ে কাঁপতে লাগলো ঠকঠক করে। তবে কি ছোট্টুর বলা সেই গল্পটা সত্যি? ওই কি তবে মধু? সেই কি ফুচকা নিয়ে এসেছে? এমনই রোগাটে ধরণের ছিল মধু। মাথা কাজ করছে না কারোরই। ওদের পিছনের দিকে পুকুর। সামনে ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে। পালাবেই বা কি করে! মুখ দিয়ে কোন কথা সরছে না ওদের। বিড়ালটা ঘনঘন কাঁদতে লাগলো। খনখনে গলায় লোকটা আবার বলে উঠলো, “ভয় কি খোকা! এসো এসো। খেয়েই দেখো না, ভালো লাগবে।” তারপর সামনে থেকে ধীরে ধীরে ওদের দিকেই এগিয়ে আসতে লাগলো। ছোট্টু তারস্বরে চিৎকার করে উঠলো এবার। সুজনের গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরোল না। ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল। আর তাকে দেখা যাচ্ছে না। সুজন পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলো। কোন শক্তিই যে তার নেই।
যেন কোন অনুভূতিই ওর কাজ করছে না। হৃদস্পন্দন বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে সেটা এখন স্পন্দনশীল কিনা তা বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে এক্ষুণি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। কতক্ষণ এমন ভাবে কাটলো তা বোঝার মত অবস্থায় সে ছিল না। যেন কেউ তাদের দুজনকে অদৃশ্য দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এমন সময় সুজনের মনে হলো ওর ঠিক পিছনে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় ঘোরাতে পারছে না কিন্তু বুঝতে পারছে এক অশরীরি অস্তিত্ব। সুজনের ঠিক কানের পিছনে সে ফিসিফস করে বলে উঠলো, “ভয় নেই, চলোই না।”
কোথা থেকে যে আবার শক্তি এসে গেল সুজন বা ছোট্টু কেউই তা জানে না। তারা রুদ্ধশ্বাসে দৌড়তে লাগলো একসাথে। ওই বিরাট মাঠটা যেন কয়েক মুহূর্তেই পেরিয়ে গেল তারা। পিছন থেকে তখন ভেসে আসতে লাগলো, “ভয় পেও না। মধুর ফুচকা খেয়ে যাও।”
তারপর আর এগোতে পারেনি তারা। মাঠটা পেরিয়েই অচেতন হয়ে পড়ে দুজনেই। ভাগ্য ভালো, কিছু লোক সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। তারাই দেখতে পেয়ে ওদের চোখে মুখে জল দিয়ে সুস্থ করে বাড়ি দিয়ে আসে। সকলেই ঘটনাটা জানতে পেরে মধুর নামে পিণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করে। তারপর আর কিছু ঘটেছিল কিনা জানা যায়নি!