সকাল সকাল স্নান সেরে পরিপাটি পোষাকে রেডি হয়ে গেছে মলি আর মন্টি। অন্য দিনে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে ওদের তাড়া দিতে হয় বকুল মাসিকে। আজ তার ঠিক উলটোটি হল। বরং বকুল মাসিকেই ওরা বেশ কয়েকবার রান্নাঘরের সামনে এসে তাড়া দিয়ে গেল। বকুল পাউরুটির ফ্রেঞ্চ টোস্ট করতে করতে স্যালাড কাটছিল। মলির আবার এসবের সাথে টমেটো সস নয়, কাসুন্দি খেতে ভালো লাগে। তাই সবার ডিসে আলাদা আলাদা করে সাজাচ্ছিল বকুল। ওদিকে গায়েত্রী দেবী অফিস বেরিয়ে যাবেন। সুমনতো সকাল সাড়ে ছটাতেই বেরিয়ে গেছেন। সবার লাঞ্চবক্স, ব্রেকফাস্ট, বিকেলের জন্য কিছু টুকটাক রেডি করতে হয় বকুলকে। তাই এই সময় রান্নাঘরে যেন যুদ্ধ তৎপরতায় দুটো গ্যাস ওভেনের উপর কড়ার সাথে হাতা খুন্তির ঠোকাঠুকি চলতে থাকে। তার উপরে মলি আর মন্টি তাড়া দেওয়ায় বকুল বলেই উঠল “আজ এতো তাড়াতাড়ি যে! স্কুলে যেতে তো দেরি আছে।”
মলি হড়বড়িয়ে উত্তর দিল “আরে, আজ স্কুল যাব না। তুমি তাড়াতাড়ি করো। নইলে দাদা আমায় না নিয়েই বেরিয়ে যাবে বলছে।”
বকুল এবার মলির দিকে তাকিয়ে দেখে, সে তার দাদুর গিফট করা জন্মদিনের পাটিয়ালা সালোয়ারটা পরে এক্কেবারে পরিপাটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে বকুল কিছু জানতে চাওয়ার আগেই মলির মা, গায়েত্রী দেবী ডাইনিং রুম থেকে গলা উঁচু করে জিজ্ঞেস করলেন “এই তোরা এতো সক্কাল সক্কাল কোথায় যাবি রে? আমায় তো কিছু বলিস নি।” তারিখটার কথা মাথায় আছে গায়েত্রী দেবীর। ছেলের কলেজে সবে পা পড়েছে, এই দিনে কী মতলবে কোথায় যাচ্ছে, জানাটা দরকার। হয়তো আসল উদ্দেশ্যকে আড়াল করতে এগারো বছরের বোনকেও সাথে নিয়ে যাচ্ছে।
“ওমা, তুমি জানো না? দাদাতো বাবাকে বলে রেখেছিল কাল। তুমি অনেক রাতে ফিরেছিলে, তাই বাবা বোধ হয় তোমায় বলতে ভুলে গেছে।” মলির নির্ভেজাল উত্তর।
গায়েত্রী দেবী কিছুক্ষণ আপনমনে ভাবলেন, ঠিকই বলেছে মলি। কাল ওর কলিগের বাবার খুব খারাপ অবস্থা ছিল বলে অফিস ফেরত সবাই হাসপাতালে গিয়েছিলেন ওরা। ফিরতে দেরি হয়েছিল। সুমনের সকালে অফিস। ওকে সাড়ে পাঁচটায় উঠতে হয়। তাই আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু চিন্তাজাত প্রশ্নগুলো উশখুশ করতে থাকে ওর মনে।
“জানি না বলেই তো জিজ্ঞেস করছি, কোথায় যাচ্ছিস তোরা?”
“ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন করতে।” পেছন থেকে ডাইনিং রুমে ঢুকতে ঢুকতে উত্তর দেয় মন্টি।
গায়েত্রী দেবী ধীরে ধীরে জীবনপথে চলার অভিজ্ঞতায় বুঝছিলেন যে এ জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা স্মার্ট, কিন্তু তাই বলে এতোটা ওভারস্মার্ট আর সেমলেস … তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি। এদিকে মন্টির মাকে দেওয়া উত্তর কানে যেতেই রান্নাঘরে গ্যসের দুই ব্যস্ত ওভেন ঝট করে সিমে চড়িয়ে দিয়ে মা ছেলের পরবর্তী উত্তেজনাকর
নাটকের অপেক্ষায় রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে পড়েছে বকুল। যেন, এক্ষুণি মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ শুরু হবে। রেফারি বাঁশি হাতে মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। খেলা শুরু হল বলে।
ঘরে বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা। গায়েত্রী দেবী পাশের চেয়ারের হাতলটা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আর বকুলের দিকে আড়চোখে চেয়ে দেখে হারেহারে বুঝছেন যে, এ খবরটার পাড়ায় খবরাখবর হতে আর কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা মাত্র। বকুল ভাবছে বলটা প্রথম কার পায়ে যাবে? মলি ডাইনিং টেবিলে বসে নিশ্চিন্তে নিজের ব্রেড টোস্টে কাসুন্দি মাখিয়ে চেখে চেখে খাচ্ছে। ওর আঙুল চাটার আওয়াজটাও স্তব্ধ ঘরে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
“তুই এমন নির্লজ্জ হলি কবে?” গায়েত্রী দেবীর বিস্ফোরিত প্রশ্ন।
“যাহ বাবা, এতে নির্লজ্জতার কী আছে? ভালোবাসার দিনে ডার্লিং কে উইশ করতে যাব না?” মন্টির নিষ্পাপ নির্বিকার উত্তর।
গায়েত্রী দেবীর মাথায় তখন ফেব্রুয়ারি মাসেও মে মাসের মতো উত্তাপ। তাতে আরো ধোঁয়া উঠছে বকুলের কৌতুহলী উঁকি মারা মুখটা দেখে। এতোক্ষণ মন্টি নিজের কিছু প্যাকিং করছিল দাঁড়িয়ে। মায়ের মুখের দিকে খেয়াল করেনি। এবার মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বুঝল মারাত্মকরকমের কিছু একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সাততাড়াতাড়ি ব্যাপারটাকে ক্লিয়ার করতে বলে উঠল “আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও। তুমি কি ভাবছো বলো তো মা? হে ভগবান, তুমি কি ভাবলে আমি কলেজে উঠে আমার ডার্লিংকে ভুলে গেছি? এতোগুলো বছর একসাথে ছিলাম। আজ প্রথমবার এই দিনে আমরা অন্য ঠিকানায় আছি। তাই বলে এই কটা স্টেশন পেরিয়ে ঠাম্মির কাছে লাল গোলাপ নিয়ে যাব না আজ?”
ছেলের কথায় মুহূর্তে গায়েত্রী দেবীর মাথার সমস্ত রাগ জল হয়ে গিয়ে টক মিষ্টি শীতল আমপানার সরবত হয়ে গেল। বকুল তখনো আশায় দাঁড়িয়ে। গায়েত্রী দেবীই ওর শেষ আশাগুলোকে তছনছ করে সহাস্যমুখে বলে উঠলেন “জানিস বকুল, তোর দাদাবাবু এই ফ্ল্যাটে গত চার বছর ধরে থাকলেও, আমরা আমাদের পুরানো কল্যাণীর বাড়িতেই থাকতাম। আমার শ্বশুর শাশুড়ি আমার ছেলে মেয়েকে ছেড়ে থাকতেই পারতেন না। বলতেন, ওরা নাকি ওদের পেয়ে এ জীবনে আবার নতুন করে প্রেমিক প্রেমিকা পেয়েছে। ভালোবাসার এই নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ওদের রেখে আমি অফিস বেরিয়ে যেতাম। জানতাম, আমার ছেলেমেয়ে দুটো আমার চেয়েও পাকাপোক্ত দুইজোড়া স্নেহের হাতে গড়ে উঠছে। কিন্তু গত বছর মন্টিও কলকাতার কলেজে ভর্তি হল। ওনারাই বললেন, নাতির কষ্ট হবে এতোদূর থেকে রোজ কলেজ যেতে। এতোদিন ছেলে এখানে একা ছিল, আমি কতটা ঠেঙিয়ে অফিস আসতাম, তাতেও বুড়োবুড়ির টনক নড়ে নি। কিন্তু নাতি নাতনির একটুও কষ্ট হবে, তা তারা মোটেই সহ্য করতে পারে নি। তাতে নিজেরা কষ্ট পাবে জেনেও আমাদের ঠেলে এখানে পাঠিয়ে দিলেন। একেই বোধ হয় বলে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।”
বোনকে নিয়ে দমদম থেকে অশোকনগরে আসতে সারাটা রাস্তায় মন্টির পুরানো দিনের কত কথাই না মনে পড়ছিল। ঠাম্মি ওর সাথে পুরানো দিনের কত গল্প করত। বলত ‘এক বাড়ি লোকের দামড়া সংসারে আমি যখন লাল টুকটুকে বেনারসি পরে ঢুকেছিলাম, তখন আমার বয়স ছিল ষোলো কি সতেরো। ভয়ে ভয়ে এঘরে ওঘরে নুপুর পরা আলতো পা ফেলে হেঁটে চলতাম। যাতে আওয়াজ কম হয়। হেসেলে ঢুকে ভোরে বড় জায়ের সাথে উনুন ধরাতে হত, বেলার দিকে সবার খাওয়া শেষে ঘরের বৌয়েদের পাত পড়ত। প্রথমের দিকেতো ক্ষিদেতে পেট চোঁ চোঁ করত আমার। কাউকে বলতাম না। কিন্তু তোর দাদু ঠিক টের পেতেন। আর আমার জন্য বাগান থেকে পেয়ারা, লিচু, কুল এসব পেড়ে চুপিচুপি ঘরে রেখে দিতেন। ব্যবসার কাজে কলকাতার দিকে গেলে কলকাতার বিখ্যাত গাঙ্গুরামসের মিষ্টি নিজে খেয়ে আমার জন্যও নিয়ে আসতেন।
আমার যে তোর দাদুর মতোই মিষ্টি খুব ভালো লাগত, তা তিনি খেয়াল করেছিলেন। আর মাঝেমধ্যেই সুযোগ হলে ডাক্তার দেখানোর নাম করে বিকালে দুজনে হাওয়া খেতে বেরোতাম।’ এসব কথাগুলো ভাবতেই মন্টি মনে মনে মিচকি হেসে ফেলল। ও বড় হয়েই বুড়োবুড়ির এতো প্রেম দেখেছে, তাতে আগে তা কতটা রঙিন ছিল, তা সহজ অনুমেয়। ঠাম্মি কিন্তু ওকে বলত, প্রেমের কোনো নতুন পুরাতন হয় না। রবিঠাকুর নাকি বলতেন ‘দাম্পত্য একটা আর্ট, তাকে নিত্য নতুন রঙে সাজাতে হয়।’ ছোটো থেকেই বাড়িতে লোডশেডিং হলে মন্টি আর মলিকে নিয়ে দাদু ঠাম্মি বসে পড়ত সঞ্চয়িতা হাতে। ঠাম্মি আগেকারদিনের ক্লাস সিক্স পাশ হলেও কত স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল। ওনাদের বিয়েতে নাকি দাদুর এক নিকট বন্ধু এই বইটা গিফট করেছিলেন। মন্টি সবসময় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করত এমন দুজন ভালোবাসার মানুষকে এতো কাছের করে পাওয়ার জন্য। তাইতো ও ঠাম্মিকে আর মলি দাদুকে ডার্লিং বলে ডাকত। গত চার পাঁচ বছর ধরে এই দিনে লাল গোলাপ এনে দিয়ে ওরাই দাদু ঠাম্মিকে এই দিনের গুরুত্ব বোঝাতো। কত রঙিন ছিল দিনগুলো।
ভাবনার মধ্য দিয়েই ওরা কখন যে দুই ভাইবোনে দাদুবাড়ির সামনে চলে এলো, টেরই পায় নি। আগে থেকে খবর না দিয়ে আসায়, দুই প্রেমিক প্রেমিকাকে দেখে সবার দারুণ চমক লাগবে… মনে মনে ভাবতে লাগল মন্টি। কিন্তু বাড়িতে ঢুকতেই উলটে ওরাই চমকে গেল। ভেজানো দরজা পেরিয়ে উপরতলার ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখল একটা টকটকে লাল গোলাপের কুঁড়ি নিয়ে দাদুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইতু। দাদু বেশ রসিয়ে ফ্লাট করছেন ইতুকে। দাদুর হাতে চকচক করছে একটা বড় ডেয়ারি মিল্কের প্যাক। ঠাম্মিও বেশ গদগদ হয়ে দাদুর পাশে দাঁড়িয়ে। এই নতুন সম্পর্কের খবরটা যদিও মন্টি একবার ঠাম্মির সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে জানতে পেরেছিল। কিন্তু মলির কাছে ব্যাপারটা পুরোটাই একটা চমকের মতো। মলিতো এ দৃশ্য দেখে চিৎকার করে বলেই ফেলল “আমি বাড়িতে নেই বলে, আমার কথা ভুলে তুমি অন্য প্রেমিকা জুটিয়েছো দাদান।” ওর কথাতে রীতিমতো চমকে গেল ঘরের সবাই। দাদু তখন তিন বছরের ইতুর সামনে রীতিমতো খাবি খাচ্ছেন। কিছু বললে পাছে অন্য প্রেমিকার অভিমান বেড়ে যায়। মন্টিরা কলকাতার ফ্ল্যাটে শিফট করার পরে পরেই ইতুরা নিচের তলায় ভাড়া এসেছিল। এতো বড় বাড়িতে বুড়োবুড়ির একা থাকাটা ঠিক নয় বলেই সুমন এ ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু তাতে যে আজ মলির নিজের বাবার উপরই সবচেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
মুখ ভার করে রান্নাঘরের দরজার দিকে হনহন করে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল মলি। পেছন পেছন লাঠি হাতে দাদু সাধ্যমতো ছুটতে লাগলেন তার মিষ্টি গিন্নীকে শান্ত করতে। আর মুখে বলতে লাগলেন “আরে এতো আমার টক গিন্নি। টকাস টকাস করে কথা বলে। তুই তো হলি গিয়ে আমার মিষ্টি কথা বলা মিষ্টি গিন্নী।” ঠাম্মিও সেপথে যেতে গেলে মন্টি ঠাম্মির হাত ধরে টেনে কাছে এনে নিচু রসিক গলায় বলে উঠল “ওদের সম্পর্কটা ওদেরকেই বুঝে উঠতে দাও। আমরা ততক্ষণে একটু প্রেম করে নি।” বলে পকেট থেকে লাল গোলাপটা বের করে ঠাম্মির হাতে দিয়ে দুগালে ঝটপট করে কিস করে নিল। ইতু সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে তখন দেখছে সে দৃশ্য। মন্টি ওই ক্ষুদেকে খেয়াল করে জিভ কেটে বলল “এই যা পেকে গেল রে বাচ্চাটা।” ঠাম্মিরতো সে কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হল।
“ওরে এই পাকাবুড়িটা সব বোঝে। জানিস, স্কুলে যায় এখন। একদিনতো আমি একটা সিরিয়াল দেখছিলাম, তোদের মতো বয়সী দুটো ছেলেমেয়ের একটু রসেবসের কথা দেখাচ্ছিল আর কী সেখানে। তো তাই দেখে আমায় বলে কিনা, ওরা তো প্রেম করছে নতুন ঠাম্মা।” ঠাম্মির একথা শুনে মন্টির কী হাসি। সামনে দাঁড়িয়ে মুখটিপে পুচকিটাও হেসে চলেছে তখন।
এমন সময় দেখল মলির কাঁধে হাত দিয়ে দাদু আসছেন এই ঘরের দিকে। মন্টি বুঝল মলিকে দাদু শান্ত করতে পেরেছেন। একটু মুখ টিপে হেসে ঠাম্মিকে ইশারা দিয়ে মন্টি বলল “তা দাদু তোমার কি তাহলে মিষ্টি গিন্নী, টক গিন্নী দুইই একসাথে চাই?”
“সেই, আমি এখন দুই সতীন নিয়ে ঘর করি আর কী। পুরুষদের কৌলিন্যপ্রথা আর গেল না রে মন্টি।” ঠাম্মির রসিক কথার পিঠে তখন রসিকতায় তাল রেখে বলল মন্টি “আরে ঠাম্মি তুমি হলে গিয়ে দাদুর গিন্নী… শুধুই গিন্নী। ছোটো থেকেই দেখেছি দাদু তোমায় না বাবার নাম করে সুমনের মা বলে ডেকেছে, না তোমার নাম ধরে। তাইতো তুমিই হলে আসল গিন্নী। যার আগে পিছে কোনো বিশেষণের দরকার হয় না।”
মন্টির কথাটা শেষ হতে না হতেই ওর দাদু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেটে বলে উঠলেন “এ রাজ্যের আদি অন্ত নাহি জানো রানি, এ তবু তোমার রাজধানী।” দাদুর আবৃত্তির মধ্য দিয়ে ঘরটা যেন প্রেমের মিষ্টি সুবাসে ভরে গেল। ঠাম্মিতো ভেতরের আবেগ সামলাতে “মরণ” বলে তড়িঘড়ি ছুটলেন রান্নাঘরের দিকে। মন্টি এই প্রেমের বাতাবরণ থেকে যে কত সুন্দর করে ছোটো থেকে সম্পর্ক শব্দটাকে উপলব্ধি করেছে,
সেটা সেই একমাত্র জানে। ওর মনে হয়, আজকালকার এই জটিল স্বার্থান্বেষী পরিবেশে এই সম্পর্কই একমাত্র তপ্ত দুখের মধ্যে শীতল যত্নের ছায়া হতে পারে।
এমন সময় কলিং বেলের শব্দ শুনে ঠাম্মি এগিয়ে যেতেই দাদু ভুরু কুচকে একটু উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠলেন “বাবুয়া এসেছে বোধ হয়।” মন্টি দেখল দাদুর কপালের সমান্তরাল বলিরেখাগুলোও যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল মুহূর্তে। মন্টি জানে বাবুয়া কাকু এ বাড়ির প্যাথোলজিস্ট।
“কেন দাদু, তোমার ব্লাড সুগার টেস্ট করিয়েছিলে নাকি?” মন্টির প্রশ্নের উত্তরে ওর দাদু বলল “নারে, তোর ঠাম্মির।”
“সেকি? কবে হল এসব? কিছুই তো জানিনা আমরা।”
“কদিন ধরে রাতের দিকে ঘন ঘন বাথরুমে যাচ্ছিল বলে আমিই বলেছিলাম একবার টেস্ট করাতে। আসলে কী জানিস তো আমার জন্য এত্ত টেনশন করে না তোর ঠাম্মি …”
কথাটা শেষ না হতেই হাসিমুখে ঘরে ঢুকল মন্টির ঠাম্মি।
“তাহলে রিপোর্ট ভালো?” ঠাম্মির হাসিমুখ দেখে স্বপ্রতিভ প্রশ্ন মন্টির।
“আমি খুব খুশি জানিস তো। এবার তোর দাদু আর ঘরে মিষ্টি আনবে না। আমি খাব বলে এনে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেও ফ্রিজের ভেতর থেকে মুখে পুরে দিত। সে কাজ করতে গিয়ে আমার কাছে ধরাও পরেছে বেশ ক’বার। এবার আমিও ওনার দলে নাম লিখিয়ে নিয়েছি। এখন থেকে আর ওনার মিষ্টি খেয়ে সুগার বাড়ার উপায়ই থাকবে না।”
ঠাম্মির কথাগুলো শুনেই দাদু রাগে হইহই করে উঠলেন। তার চিন্তায় এসব বাঁধিয়েছে, সারাদিন ধরে রাজ্যের চিন্তা করে এসব বলেই যাচ্ছে দাদু। মন্টির কানে আবছা হয়ে আসছে কথাগুলো। ওর মন তখন বিষ্ময়ে হতবাক ও তৃপ্ত। সত্যিই এখনো এ পৃথিবীর বুকে এমন ভালোবাসা আছে, যে ভালোবাসা তার ভালোবাসার মানুষকে সুস্থ রাখার জন্য নিজের রোগের তোয়াক্কা করা দূরস্থ, রোগটিকেও আপন করতে চান। সত্যি, ভালোবাসা বা প্রেম একটিমাত্র শব্দ হলেও, তার অনুভূতির বিপুল তরঙ্গ যত্ন, স্নেহ, বিশ্বাসের মতো আরো অনেক অনেক শব্দ বেষ্টিত হয়ে সারা জীবনটাকে অমৃতের আস্বাদ দিতে সক্ষম হয়।
এমন সময় পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে ইতুর গলায় গানের আধো আধো কটি লাইন “তুমি খুশি থাকো, আপার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাকো।”
সেটি শুনে মলি জিজ্ঞেস করছে ইতুকে “কে তোকে এই গানটা শিখিয়েছে রে?”
“নতুন ঠাম্মা” ইতুর আনন্দে গদগদ উত্তর।
মন্টি ভেতরের ঘরে চেয়ে দেখছে, তখনও দাদু ঠাম্মি উভয় উভয়ের ভালো চেয়ে প্রেমের যুদ্ধ লড়েই চলেছেন। সে সুমধুর দৃশ্য অবচেতনেই মন্টির গলাতেও তখন ছোট্ট ইতুর মতোই সুরের দোলা দিয়ে উঠল।
(সমাপ্ত)