তা সেদিন পাড়ায় বাঘ পড়লো; আচমকাই, ভর সন্ধ্যায়, দুম করে। সেকি ভয়ানক দৃশ্য মাইরি: পাকা হলদে আর কালোর ডোরাকাটা চিকন গা, উনুনের গনগনে আঁচের মতো লাল চোখ, শীতকালের টাটকা সদ্য মুলোর মতো ধপধপে সাদা দাঁত-এসব কিছু একেবারে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে সুবীরদাদের বাড়ির ওই লাল রকের আড়াল থেকে আধো আলো আঁধারের মধ্যে সটান চেয়ে আছে, আমাদের দিকে! ক’দিন ধরেই ওই রকের ধারের ল্যাম্প পোস্টটা চোখ মারছিল, আজ পুরো কানা- তাই আঁধারটা একটু বেশি। পড়ন্ত বিকেলের হালকা শীতের আমেজ গায়ে মেখে নিয়ে আমরা তখন রাস্তার এপারে রতন দার চায়ের দোকানের বাইরের বেঞ্চে বসে ধোঁয়া ওঠা লাল চায়ের কাপে সবে সোয়াস্তির চুমুক দিচ্ছিলাম। কেল্টু দাই আগে দেখলো।
অস্ফুট আর্তনাদ আর গোঙানি মেশানো এক অদ্ভুত শব্দে “বা…আ…আ….ঘ” বলে সেই যে ভোকাট্টা বগ্গা ঘুড়ির মতো গোঁত্তা খেয়ে বেন্চ্ঞ থেকে ধুপ করে পাশের মেঝেতে পড়লো, আর কোন সাড়াশব্দ নেই!!! রাজুদা, সুমনদা, ভোম্বলদা আর নকুলের অবস্থা তখন পুলিশি ভাষায় ‘জৈসে থে’—যে যেমন অবস্থায় ছিল সে সেই অবস্থায় ব্রোঞ্চের মূর্তির মতো স্ট্যাচু হয়ে, নট নড়ন চড়ন! শুধু সবার অপলক দৃষ্টি ওই রকের দিকে রাইফেলের মতো তাক করা। রাজুদার সিগারেট ধরা হাতটা ঠোঁটের ফাঁকে, সুমনদার বাঁ হাতটা প্যান্টের বাঁ পকেটে আর ভোম্বলদার চায়ের কাপটা মুখের দিকে যাত্রা শুরু করে গলার নিচ পর্যন্ত এসে মাঝ রাস্তায় হঠাৎ করে গিয়ার লক হয়ে থেমে যাওয়া ট্যাক্সিটার মতো আটকে গেছে!
এই ভীষণ দুঃসময়ে রমেন দা, গোপালদা, খোকনদা…. এদের কথা খুব মনে পড়ছিল! কত বড়ো বড়ো বাঘ ভাল্লুক মারার কৃতিত্ব রয়েছে এনাদের! কেউ ছড়ড়া বন্দুকে, কেউ ছাতার বাঁটে তো কেউ স্রেফ খালি হাতেই কত বিশাল বিশাল বাঘ ভাল্লুক কুপোকাত করেছেন! সুযোগ পেলেই তার ফিরিস্তি দিয়ে ফিরতেন, একেবারে নিরহংকারে!! বাঘটা এখনও নিস্পলকে এখানেই চেয়ে আছে, শরীরটা একটু গুটিয়ে নিয়েছে না? শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগের পোজিসন না? এমন সময় পায়ের গোড়ালিতে সুরসুরি অনুভব করলাম। দেখি, স্বঘোষিত বিরাট ডাকাবুকো, শত শত বাঘ ভাল্লুক মারার ঈর্ষণীয় রেকর্ড ধারণকারী মহামান্য রমেনদা বেন্চ্ঞের তলায় হামাগুড়ি দিচ্ছে!!! আমি ভাবলাম, যাক ভগবান শুনেছেন। এই ঘোর দুঃসময়ে এক বিশ্ব ত্রাতাকে পাঠিয়েছেন!
অপেক্ষায় ছিলাম কিছুক্ষণ পরেই হয়তো রমেনদা পড়ে যাওয়া ছাতাটা কুড়িয়ে নিয়ে হেলায় বাঘটাকে চিৎ করে আসবে- ছাতার বাঁট দিয়ে। ঠিক যেরকম ভাবে সেই কবে কোথায় যেন ওনার যখন ২২ বছর বয়সে একবার করেছিলেন, আমাদেরকে বলেছিলেন! উনি দেখি পারলে মাটি খুঁড়ে তার মধ্যেই সেঁধিয়ে যায় এমন অবস্থা। আমি ফিসফিস করে বললাম, রমেন দা এই সুযোগ। আপনার ব্যাঘ্র নিধনের কিল লিস্টে আরেকটি নাম সংযোজনের এ এক লোভনীয় সুযোগ- হাত ছাড়া করবেন না! যান ছাতার বাঁটটা ব্যাটার গলায় আটকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে পুরো পাড়ার বাইরে ফেলে আসুন, বুঝিয়ে দিন এ তল্লাটে বাঘ ভাল্লুকের যম রমেন দাসের বাস! দুটো হাঁটুর ঠকঠকানির মাঝে রমেন দা চিঁ চিঁ করে বলে উঠলো, না ভাই আজ দুপুর থেকে খুব চোরা অম্বল করেছে। শরীরটা ভালো নেই। নাহলে বলতে হতো না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম—“তা বেঞ্চের তলায় হামাগুড়ি দিয়ে কি অম্বল সারাবার যোগাসন করছেন?
“না ভাই মলয়, পাঁচ টাকার কয়েনটা পড়ে গেছে খুঁজছি..”
বুঝলাম, ইনি ভাঙবেন তবু মচকাবেন না, বিরাট যোদ্ধা বলে কথা! মনে মনে বললাম, কয়েন নয় শিড়দাঁড়া খুঁজছেন বলুন। পেলে জানাবেন।
এদিকে, রকের ধারের ল্যাম্প পোষ্টের আলোটা ঘটনাক্রমে আবার চোখ মারতে মারতে জ্বলতে শুরু করেছে। সেই আংশিক বিচ্ছুরিত আলোয় দেখা গেল, বাঘটা সেই একই রকম ভাবে স্ট্যাচুর মতো নট নড়ন চড়ন হয়ে এদিকে চেয়ে আছে; তবে সাইজে আগের থেকে কিছুটা ছোট আর বাঁদিকে টাল খাওয়া। অন্ধকারে বোঝা যায়নি, আলোতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে গাটা অনেক বেশিই চকচকে আর রঙিন। চোখে লাগার মতো, ঠিক যেন নতুন কেনা পুতুলের মতো…সঙ্গে সঙ্গে মাথায় বিদ্যুৎ ঝিলিক মেরে গেল!
একাই এগিয়ে গেলাম রকের দিকে, পিছন থেকে নকুল রে রে করে উঠল…
ডান হাত দিয়ে বাঘের ঘেঁটিটা তুললাম-একেবারেই পলকা! হবেনাই বা কেন? এতো প্লাস্টিকের তৈরি লাইফ সাইজের খেলনা! নিখুঁত ভাবে তৈরি করা। কালীপূজার মেলাতে সুবীর দা ওনার ছোট্ট মেয়েকে কিনে দিয়েছিলেন। বারান্দায় ছিল, হাওয়ায় হয়তো নিচের রকে পড়ে গেছিলো। তাই নিয়ে এত কান্ড!
নিজের মনেই হাসতে হাসতে এগিয়ে চললাম সুবীরদাদের দোতলা বাড়ির দিকে। পিছনে তখন রতনদার দোকানে সস-প্যানে সদ্য ফুটতে শুরু করা চায়ের মতো গুঞ্জন উথলে উঠতে শুরু করেছে।