নীল অফিস থেকে ফিরে দেখে সব ঘরের আলো নেভানো। রাইয়ের কদিন ধরেই খুব মন খারাপ ছিল জানে নীল। অদ্ভুত এক উদাসীনতা গ্রাস করেছে ওকে। নীল জানে একটু সময় ওদের দুজনেরই চাই। কিন্তু এইসময় তো কোথাও যায়না রাই। বেডরুমে ঢুকে দেখলো আলো নেভানো। বাথরুম থেকে হালকা আলো ভেসে আসছে। দরজা খুলে ঢুকতেই যা দেখলো মাথাটা ঘুরে গেলো ক্ষনিকের জন্য। বাথটবে আধশোয়া রাই, বাঁ হাতটা বাইরে ঝুলছে। অনেকটা রক্ত জমে আছে বাথরুমের সাদা টাইলসে।
“রাই… রাই… কেন এমন করলে।” কাছে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলো নীল তার রাইকে। তখনো নিঃশ্বাস পরছে ধীরেধীরে। আর দেরি করেনি নীল।
রাইয়ের অন্যহাতে তখনো আলতো করে ধরা একটা ডায়েরি। রোজ ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল ওর। তাতে লেখা নীলের জন্য একটা শেষ কবিতা।
তোমার খোলা আকাশে পাখি হতে চেয়েছিলাম,
তুমি সোনার খাঁচা এনে দিলে।
তোমার বুকে খোলা বই হতে চেয়েছিলাম, এলোমেলো পরে থাকতাম তোমার খাটে,
তুমি মেহগনি কাঠের দামী বুকশেলফে বন্দী করলে।
খোঁপায় বাঁধবো বলে একটা গোলাপ চেয়ে…. অর্কিড পেয়েছিলাম।
ভাঁজ করা পুরোনো জামায় ন্যাপথলিনের গন্ধের মতো মধ্যবিত্ত গন্ধটাও গা-ছাড়া হচ্ছিল ক্রমশ…
তবু ধীরেধীরে একদিন কাশ্মীরি কার্পেটের সুখে বাসা বাঁধল অসুখের বিলাসিতা।
যত্ন করে সাজানো ঘরগুলোর আর বাড়ি হয়ে ওঠা হয়নি,
তোমার উপন্যাসের প্রাক্তন আমি, তবু তুমি আজও আমার কবিতায়…
শুধু একবার পাশে বসে, কাঁধে মাথা রেখে একটা বিকেল চেয়েছিলাম….
আমি আজও আঠারো তলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় একা বসে রাত্রি নামা দেখি… তোমার প্রতিক্ষায়…
অপারেশনের থিয়েটারের লাল আলোটা জ্বলে উঠলো। বাইরে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নীল। কিছুক্ষণ আগেই নার্স স্ট্রেচারে করে রাইকে ভেতরে নিয়ে গেছে…
ঠিক আধঘন্টা আগেই নীল রাইকে নিয়ে আরোগ্য নার্সিংহোমে ছুটে এসেছিল।
“ডাক্তারবাবু আমার রাইকে বাঁচান, প্লিজ। ওকে ছাড়া আমি বাঁঁচবো না।”
“আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন। আমরা সবরকম চেষ্টা করবো। তবে অনেকটা ব্লাডলস” বাকিটা শেষ না করেই ডাক্তারবাবু ওটিতে চলে গেলেন।
কী হয়ে গেলো। অথচ এমনটা হওয়ার কথা কী সত্যি ছিল? জীবনের জিগ’স পাজেলের প্রতিটা অংশ যেন নিজের জায়গায় ছিল। তবু কেন এই দুর্ঘটনা এলো তাদের জীবনে। সময়ের হাত ধরে সে ফিরে গেলো দুইমাস আগের এক সন্ধ্যেবেলা।
আজ মে উপর…. আসমান নিচে… আজ মে আগে… জামানা হ্যা পিছে….”
“কী হলো রাই, আজ হটাৎ এত খুশিখুশি।” নীলের প্রশ্নে একটু গানটা থামালো রাই। তারপর বাথরুম থেকে ভেজা হাতদুটো কাছে ডাকলো নীলকে।
” এই নীল, এদিকে এসো।”
নীল রেডি হচ্ছিলো অফিসে যাবে বলে, কিন্তু এ যে রাইকিশোরীর ডাক ! কেমন করে উপেক্ষা করে সে।
“এই ভোঁদুরাম…. এই দেখো পসিটিভ।” রাইয়ের চোখে দুষ্টু হাসি। নীল কোলে নিয়ে রাইকে আছড়ে পরলো দুধসাদা বিছানায়। কিছুক্ষণ আগে টানটান করে পাতা বিছানার চাদর গুটিয়ে গেলো বন্য আদরে। আজ বিয়ের পাঁচ বছর পর বাবা হচ্ছে নীল। এ যে এক বাঁধভাঙা আনন্দ। কী ভাবে প্রকাশ করবে সে । এরপর বেবীর জন্য শপিং আর রাইয়ের জন্য পৃথিবী জোড়া ভালোবাসা নিয়ে হাজির হলো নীল। বেবীর রুম পেন্টিং থেকে আসবাবপত্র সব বেবীপ্রুফ করার দায়িত্ব একা হাতে সামলালো নীল।
মাঝে মাঝে হাসি পায় রাইয়ের। এই ছেলে ভেজা টাওয়াল বিছানায় রাখতো । এই ছেলে এক গ্লাস জলও নিজে নিয়ে খেতো না । সে এখন রাইকে চুল বেঁধে দেয়, খাইয়ে দেয় । মাঝে মাঝে কপট রাগ দেখিয়ে বলে রাই ।
“সব বুঝি, নিজের বেবীর জন্য আমায় মাস্কা লাগাচ্ছ।”
“তুমি তো আমার রাইকিশোরী, কিন্তু যে আসছে তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার” জবাব দেয় নীল।
নীলের ছেলেমানুষী দেখে আনন্দ পায় রাই।
কিছুদিনের মধ্যেই রাইয়ের শাশুড়ি আসেন। রাইকে বরাবরই মেয়ের মতোই ভালোবাসে নীলের মা। একমাত্র পুত্রবধূকে নিয়ে সুখের সংসার সবার। নতুন অতিথি আসবার অপেক্ষায় সবাই উন্মুখ। প্রায় পাঁচ বছর হলো বিয়ে হয়েছে ওদের। এতদিন কেরিয়ারের জন্য প্ল্যান করা হয়নি।
কিন্তু হঠাৎ এক লহমায় সব বদলে যায় একদিন।
রাতে হঠাৎ তলপেটের যন্ত্রনায় ঘুম ভেঙে যায় রাইয়ের।
“নীল ওঠো ওঠো… আমাকে একটু জল দাও গো।”
কী হয়েছে রাই। ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে জলের গ্লাস এগিয়ে দিল নীল।
“একী এত রক্ত কেন বিছানায়। রাই রাই তুমি ঠিক আছো তো?”
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে উদভ্রান্তের মতো ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করে নীল।
ওটির আলো নিভে গেছে। ডাক্তারবাবু আশ্বাস দিয়েছেন রাই সুস্থ আছে। সঠিক সময়ে নার্সিং হোমে নিয়ে আসতে পেরেছে নীল ওকে।
“ডাক্তারবাবু সব ঠিক আছে তো? আমার বাচ্চা ভালো আছে তো? বলুন প্লিজ। আর রাই?কেমন আছে রাই।”
“প্লিজ মিঃ চ্যাটার্জি। আপনি শান্ত হন। রাই ঠিক আছে। অনেকসময় গর্ভাবস্থায় ওভারি ঠিকমতো কর্পাস ল্যুটিয়াম তৈরি না করলে প্রোজেস্টেরন হরমোনের অভাবে মিসক্যারেজ হতে পারে।
তবে ভয়ের কিছু নেই ট্রিটমেন্ট করালেই উনি আবার মা হতে পারবেন।
মিসক্যারেজের পরেও মা হতেই পারেন।
কর্পোরেট দুনিয়ায় টিঁকে থাকার প্রতিযোগিতা, নিত্যনতুন টেনশন আর পরিশ্রম। তবুও তো সংসারের কথা ভাবতে হয়। নতুন অতিথিকে কে না চায়? ঘটনা হল, প্রেগন্যান্সি আসছে, কিন্তু তা ধরে রাখা যাচ্ছে না।
শুধু শরীর বা চেহারায় নয়, স্ট্রেস অজান্তেই থাবা বসাচ্ছে প্রেগন্যান্সিতেও। মিসক্যারেজ হলে মনের ওপর বিরাট চাপ পড়ে। পরবর্তী প্রেগন্যান্সির আগে সেই চাপ না কাটালে মিসক্যারেজের সমূহ সম্ভাবনা। সব সময় আতঙ্ক, আবার বুঝি মিসক্যারেজ হল। সেই স্ট্রেসই ডেকে আনে রেকারেন্ট মিসক্যারেজ।
কর্পোরেটের কাজের চাপ হোক বা বাড়ির কোনও অঘটন, যে কোনও স্ট্রেসই শরীরে স্টেরয়েডের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।স্টেরয়েডের প্রভাবেই কমে যায় শুক্রাণু বা ডিম্বাণুর গুণমান। তৈরি হয় ত্রুটিযুক্ত ভ্রূণ। জরায়ু এ ধরনের ভ্রূণকে বাতিল করে দেয়। তার থেকেই মিসক্যারেজ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কিন্তু মন্দের ভাল। নইলে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হত। তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলেও চলবে না। দুই বার মিসক্যারেজ হলে তিন বারের বার যাতে একই ঘটনা না ঘটে তার চেষ্টা করতে হবে। রাইকে এখন চাকরিটা ডিসকন্টিনিউ করতে হবে। সম্পূর্ণ রেস্ট নিতে হবে ওকে।
নীলের মনের মধ্যে তখন ঝড়। ডাক্তারের কোনো কথাই কানে যাচ্ছেনা ওর। শুধু বুঝতে পারছে ওদের সব স্বপ্ন একদলা রক্তে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। টলতে টলতে ডাক্তারের চেম্বার ছেড়ে রাইয়ের কেবিনে এলো নীল।
সাদা চাদরে ওর পা দুটো ঢাকা। স্যালাইন চলছে। বেডের পাশে গিয়ে বসলো নীল।
“আমাদের সোনা আর নেই না গো? মায়ের ওপর বড্ড অভিমান করে চলে গেলো। মা ওকে রাখতে পারলো না।”
“চুপ করো রাই। ডাক্তার বলেছেন ট্রিটমেন্ট করালেই।” নীলের কথা সম্পূর্ণ হতে দিলনা রাই, তার আগেই মুখ ফিরিয়ে নিল।
“কিসের ট্রিটমেন্ট নীল। আমাদের পাপের ট্রিটমেন্ট? আমি জানি ও আর আসবে না। কোনোদিন আসবেনা। বড্ড অভিমান করে চলে গেলো যে”। নিজের মনেই কথাগুলো বলে যাচ্ছে রাই।
সপাটে কেউ চড় মারলো মনে হলো নীলের গালে। মাথাটা ঘুরে গেলো যেন। রাইয়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো, একটু ভয় পেলো। রাইয়ের মুখে কোনো শোকের ছায়া নেই। কেমন নির্বিকার দৃষ্টি ওর। যেন পাথর হয়ে গেছে। নীল ফিরে গেল চার বছর আগের এক সন্ধ্যাবেলায়। সেই সবে অফিস থেকে ফিরেছে ও। রাই এসে ওর বুকে মাথা রাখলো।
“কী ব্যাপার, আজ আমার বৌয়ের এত প্রেম পাচ্ছে হঠাৎ। উমমম… আরে কী হলো? কাছে এসো।”
“যাহ! তুমিও না। আর এত ছেলেমানুষী করলে চলবে না নীলবাবু। এবার একটু বড়ো হতে হবে। অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। একজন আসছে আমাদের বাড়িতে।” রাইয়ের চোখে দুষ্টুমির হাসি।
“আমাদের বাড়িতে আবার কে আসবে? মা আসবে নাকি?”
“আরে ধুর ছাই। উফফ্। কেউ আসছে মানে তিন নম্বর চ্যাটার্জি আসছেন বাড়িতে।”
“কী বলছো রাই! চমকে উঠেছিল নীল। কিন্তু আমরা তো সবরকম প্রোটেকশন নিয়েছিলাম। তুমি তো জানো এখন সম্ভব নয়। আম এখন দায়িত্ব নিয়ে পারবোনা।” চমকে উঠলো নীল।
“নীল বোঝার চেষ্টা করো, অনেকসময় প্রোটেকশন ব্যর্থ হয়। তাছাড়া আমরা দুজনে চাকরি করি। ঠিক পারবো।” রাইয়ের মনে হলো সমস্ত পৃথিবী দুলে উঠল যেন।
“না, না, রাই এটা হয়না। তুমি প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। আর একটু সময় দাও আমায়। পৃথিবীর সব সম্পদ আমি তোমাদের এনে দেবো। একটু সময় দাও শুধু।” নীলের গলায় একরাশ হতাশা।
“আমি পারবোনা নীল। আমাদের প্রথম সন্তান। আমাদের ভালোবাসা ছাড়া আর কী চাই ওর। তুমি প্লিজ না বোলোনা।”
দীপান্বিতা দে রায়
প্রতিদিনের অশান্তি রাই নিতে পারলো না। শেষবারের মতো চেষ্টা করেও নীলের সাথে অবশেষে নার্সিংহোম গেলো একদিন। সব ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিল নীল। বাড়ি ফিরে তিনমাস কোনো কথা বলেনি রাই। কিন্তু ধীরেধীরে সব আগের মতো হতে লাগলো। সেইদিনের ঘটনা নিয়ে কোনোকথা ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ জানেনি। তারপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। নীল এখন মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির এরিয়া ম্যানেজার। স্বপ্ন দেখা সার্থক হয়েছে ওর। এখন আর কোনো কিছুতেই বাধা নেই ওর। কিন্তু নিয়তি। তাকে তো মিথ্যের আড়ালে রাখা যায়না।
গল্পটা এখানেই থেমে যেতে পারতো। থমকে যেতো দুটো জীবন। পাহাড় সমান অভিযোগ আর অভিমানের ভীড়ে রাই সেদিন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। দূরত্ব তৈরি হয়েছিল এক আলোকবর্ষ যেন। তারপর
ওদের জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। নিয়তি ততটাও নিষ্ঠুর হতে পারেনি। এক মায়ের ডাকে সারা না দিয়ে মুখ ফেরাতে পারেনি। নীল এবার আর চেষ্টায় ত্রুটি করেনি কোনো। সঠিক ট্রিটমেন্টে অবশেষে দুই বছর পরে ওদের কোলে সন্তান আসে আবার। নীল আর রাইয়ের সন্তান “নীরা” আজ ওদের জীবনের সব দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে। ভয়ংকর অন্ধকার রাতের পরেও যেমন সূর্য ওঠে তেমনই নীরার আগমনে নীল আর রাই আবার ফিরে পেয়েছে ওদের হারিয়ে যাওয়া সময়।