গুড়গুড়া ভূত

গুড়গুড়া ভূত

শহরের ঝলমলে আলোয় আমাদের দেশের পুরানো ভূতেদের দেখা পাওয়ায় আজকাল দুস্কর । এখন ভূতেরা বেশিরভাগ বিল্ডিংএর লিফটে, ফাঁকা ছাদে বা ফ্ল্যাটে ঘোরাঘুরি করেন; ফোন, ফেসবুক, ইমেইলের মাধমে যোগাযোগ করেন। তবে সাবেকি প্রথা মেনে সকলেই হিমশীতল বাতাস আর অন্ধকারের ব্যপারটা এখনো বজায় রেখেছেন।

আমি কিন্তু সেই পুরানো ভূতেদের বড্ডো মিস করি ।
নিমগাছের একটা ডাল, কালো কুচকুচে হাত পা ছড়িয়ে যেন ঠিক মামদোভূতের ছানা, মা বলতো ‘কিম্ভূত’; সন্ধেবেলা লোডশেডিং, হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসে আমাদের নিজেদেরই ছায়াগুলো কেঁপে কেঁপে আমাদের ভয় দেখাতো।
পূর্ণিমার চাঁদ উক্যালিপ্টাস গাছের ফাঁকে, আর পেঁচার ডাক… উফ, ভাবতেই শিহরণ জাগে।

আমাদের পুরুলিয়ার গ্রামেগঞ্জে এক ধরণের উপকারী ভূতের কথা শোনা যেত। স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ইনি গোপাল ঠাকুর বা গুড়গুড়া ভূত নামে পরিচিত ছিলেন।

দেড়ফুট লম্বা ছোট বাচ্চা, মাথায় জটা, শুধুমাত্র ল্যাঙট পরা, রাতের বেলা ধানের গোলার আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। এর কোমরে মাদুলি আর পায়ে থাকতো মল, গোলার চারধারে দৌড়ে বেড়ানোর সময় মলগুলি ছুনছুন করতো। বলা হয়, যে গ্রামে এই উপদেবতাটিকে দেখা যেত তার শ্রীবৃদ্ধি হতো।

এরকমই একটা গ্রামের বাসিন্দা আমার বন্ধু অনুরূপরা ছিল প্রচুর জমিজমার মালিক। সেইসময় ধান কাটা হয়ে গেলে গোলা পাহারা দেওয়ার জন্য কাউকে না কাউকে থাকতে হতো। অনুরূপের কাকু, মন্মথ, তখন যুবক। অমল, মন্মথর ছোটবেলার সাথী এবং খুব ঘনিষ্ট। তারাই এই পাহারা দেওয়ার ভার নিতেন।

একবার পাহারা দেওয়ার সময় নুপুরের ছুনছুন শুনে মন্মথ ঘুম ভেঙে গোলার চারপাশে একটি ছোটোখাটো মানুষকে ছুটতে দেখে অন্ধকারে চোর ভেবে তার জটা ধরে টান মারেন। এতে জটার অনেকটা ছিঁড়ে তার হাতেই রয়ে যায়। পরদিন জানতে পারেন ওটা কোনো চোর নয় গোপাল ঠাকুর এসেছিলেন।

এই পর্যন্ত ঠিক ছিল, গোল বাঁধালো অমল। সে ওই জটা নিজের কাছে রাখতে চাইলো, ভাবলো তাতে তার অবস্থার উন্নতি হবে। গুরুজনেরা বারন করলেও “ইটা আমি লিব”, বলে জটা নিয়ে সে তো নিজের বাড়ি চলে গেলো।

তারপর, রাতদুপুরে অমল ঘুমিয়ে আছে, হটাৎ জানালায় টোকা; একবার, দুবার, তিনবার। বিরক্ত অমল উঠে জানলা খুলতে কাউকেই দেখতে পেলো না, কিন্তু অন্ধকারের ভিতর থেকে আওয়াজ এলো “আমার জটা দে।”
অমল আরো বিরক্ত হয়ে জোরে জানলা বন্ধ করে আবার ঘুমাতে গেলো। সারারাত গোপাল ঠাকুরটি কেঁদে কেঁদে তার জানলার নিচে ঘুরলো।
সকালে এই শুনে মন্মথ বললেন অমলকে, “কাজটা ঠিক হয়নি, দিয়ে দে ।” কিন্তু কে শোনে!

তাই গুড়গুড়ে রোজ রাতে আসতো আর কেঁদে কেঁদে জটা ফেরত চাইতো|
এভাবে কিছুদিন চলার পর শুরু হলো নতুন উপদ্রব| সন্ধেবেলা অমল কাজ শেষে গ্রামে ফিরত| শ্মশানঘাটের বুড়ো অর্জুনগাছের নিচ দিয়ে আসার সময় একদিন ঝুপ করে ওর সাইকেলএর পিছনের ক্যারিয়ারে, গোটা রাস্তা একইরকমভাবে ‘জটা দে, জটা দে’ করে গুড়গুড়ে কেঁদে চললো।
এরকম রোজ গুড়গুড়ে অমলের পিছুপিছু ঘোরে, অমলও কিছুতেই দেবে না।

যতই ভূত হোক, সবারই একটা সহ্য ক্ষমতা আছে, তাই এবার গুড়গুড়ে অন্য রাস্তা ধরলো।
অমল ছিল ম্যাজিসিয়ান, গ্রামের উৎসব অনুষ্ঠানে ম্যাজিক দেখিয়ে দুপয়সা রোজগার করতো। গুড়গুড়ে উপায়ান্তর না দেখে সেটাকেই টার্গেট করলো।

টুপির মধ্যে রুমাল ঢুকিয়ে পায়রা বের হলো না, রুমালটাই পায়রার মতো উড়তে লাগলো। হতভম্ব অমল লাফিয়ে লাফিয়ে রুমালের পিছনে দৌড়ালো। আবার কখনো তাসেরা অমলের এ পকেট ও পকেট থেকে বেরিয়ে পড়তে লাগলো।
অমলের ম্যাজিক আর ম্যাজিক রইলো না।

শেষপর্যন্ত অমল মন্মথর সাথে শলাপরামর্শ করে ঠিক করলো জটা ফেরত দেবে।
সেইমতো, রাতে জানলায় টোকা শুনতেই উঠে অন্ধকারে জটা বাড়িয়ে ধরলো।

ওমা, অমনি জটা নিয়ে ছুনছুন ছুনছুন ছুনছুন…

আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেলো।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত