এই বসন্তেও তিনদিন হটাৎ আসা অকাল শ্রাবণের পর আজ মেঘমুক্ত আকাশে রোদের হাতছানি দেখে বিছানায় বসে বসেই সকাল সকাল মনটা ভালো হয়ে যায় ইমনের।ঝটপট নিজে ফ্রেশ হয়ে ছোট্ট উদিতাকে ঘুম থেকে তোলে ও।তারপর ওকে রেডি করে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে এসে এককাপ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় নিজে।দূরে একটা কোকিল এক নাগাড়ে ডেকেই চলেছে।
আচ্ছা কি খুঁজছে ওই কোকিল?কাছের কোন সঙ্গী বা বন্ধু?;মনেমনে ভাবে ইমন ওরফে মন।এমনসময় ওর মুঠোফোনটা স্বশব্দে জানান দেয় নতুন কোনো বার্তা এসেছে।ফোনটা ছুঁতেই টাচস্ক্রিনে ফুটে ওঠে আদি লিখেছে,”কি রে মন আজ আসছিস তো গোলপার্ক সিসিডিতে?ঠিক বিকেল চারটে।আমি কিন্তু তোর অপেক্ষাতে থাকব।” আদির কথার উত্তরে কিছু লিখতে গিয়েও হাতটা সরিয়ে নেয় ইমন।কিছু অপেক্ষা থাকা ভালো,অপেক্ষারা যে অনেক কিছু শেখায় জীবনে।ইমনদের এই সুউচ্চ ফ্ল্যাটে থেকে কমপ্লেক্সের বহুদূর পর্যন্ত চোখ চলে যায়।হটাৎ আসা বর্ষায় অনেককিছু ধুলো ময়লা ধুয়ে গেছে কিন্তু সাত বছর আগে ফেলে আসা এমনই এক বসন্ত দিনের সেই স্মৃতি কি আদেও মিটেছে হিসেবনিকেশ চলতেই থাকে ইমনের মনের গভীরে।?আলোছায়া বরাবর অতীতের সরণী বরাবর পাড়ি দেয় ওর মন।
সাত বছর আগে এই শহরেই এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস চত্বরে আলো করে ফুটে থাকা কৃষ্ণচুড়া ফুলগাছের নীচে সেদিন আদির জন্য দাঁড়িয়েছিল ইমন।আদি জানিয়েছিল সেদিন ইমনকে বিশেষ একটা কথা জানাতে আসবে সেই মতই অপেক্ষা করছিল ও।অবশ্য অপেক্ষা করানোটা আদির বরাবরের অভ্যাস।তবুও কিসের অজানা টানে দ্বিতীয় বর্ষের বাংলা অনার্সের ছাত্রী ইমন অপেক্ষা করত হাসিমুখে আদির জন্য।ভালোবাসার চোরাস্রোত বোধয় একেই বলে।বয়সে ইমনের থেকে দু বছরের বড়দার বন্ধু এই আদি ওরফে আদিত্য সেন।ওদের বাড়িতে যাতায়াত সূত্রেই পরিচয়।আদির যে জিনিসটা মন ছুঁয়ে যেত সেটা হল খুব সহজভাবে মিশতে পারা সকলের সঙ্গে।বড় ব্যবসায়ীর ছেলে হয়েও ইমনদের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে ছিল অবাধ যাতায়াত।তারপর ঐ আড়চোখের চাউনি,বুকের ধুকপুকানি সবকিছু পেরিয়ে এসে এক দোলের দিনে লাল আবীরে ইমনের সিঁথি রাঙিয়ে দিয়েছিল আদি।মুখে কোনো কথা না বললেও মনে দোলা লেগেছিল অবাধ্য খোলা চুলে আদির বুকে মাথা রেখেছিল সেদিন দ্বাদশ শ্রেণীর ইমন।
এভাবেই পেরিয়ে গেছিল দুটো বছর।উত্তেজনার পারদ বেড়ে চলছিল সেদিন ইমনের।প্রায় একঘন্টা হতে যাচ্ছিল।কখন যে আসবে আদি!আচ্ছা এতদিনের না বলা মনের কথা ভাষা খুঁজে পাবে?আদি কি বলবে আদি ওকে ভালোবাসার কথা।কিছু একটা আন্দাজ করে গোলাপী চুড়িদার,অবাধ্য চুল আর জোড়া ভ্রুর মধ্যিখানের টিপে নিজেকে সাজিয়েছিল সেদিন ইমন।ব্যাগ খুলে ছোট্ট আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নেয় ও।ঐতো এতক্ষণে আসছে আদি।ওর সামনে এসে বলে,”সরি রে ইমন দেরি হয়ে গেল।আজ পাসপোর্ট অফিস গেছিলাম একটা দরকারি কাজে,খুব তাড়াতাড়ি বিদেশ যাচ্ছি আমি।ভাবলাম ম্যানেজমেন্ট কোর্সটা করে আসি ভবিষ্যতে ব্যবসার কাজে লাগবে।”
__”কিন্তু তুমি বললে যে বিশেষ কিছু বলবে আমাকে?”একটু চমকে মুখটা তুলে শুধায় ইমন।
__”আরে পাগলি তুইও না! এটাই তো বিশেষ খবর।”হাসতে হাসতে বলেছিল আদি। ইমনের কাজল কালো চোখ দুটো নিমেষে লাল হয়ে গেছিল।বসন্তের ফুলে ঢাকা ক্যাম্পাসের পথে মিলিয়ে গেছিল আদি।কতক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়েছিল ইমন জানেনা সেদিন। তারপর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ঈশান।হাসিমুখে বলেছিল,”কলির কেষ্ট কুঞ্জবন ছেড়ে চলে গেল তো কি? আমি তো আছি এই ধিঙ্গী কেষ্ট।নে চল ঢপের চপ আর চা খাবি চল।”একপ্রকার জোর করেই ইমনকে নিয়ে গেছিল ঈশান যাকে ইমন শুধু সহপাঠী বা ভালো বন্ধু ছাড়া কিছু ভাবতে পারেনি।”তারপর আদির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগটাও নিভে এসছিল।আর নিজের দাদার কাছে ওর সম্পর্কে কিছু সাহস করে জিজ্ঞাসা করতে পারেনি ইমন যদি কেউ কিছু ধরে ফেলে।বছর দুই পর দেশে ফিরে ওদের বাড়ি এসছিল আদি সাথে বিয়ের কার্ড।ওর সামনে আসেনি ইমন শুধু শুনতে পেয়েছিল বড়দার গলা,”এসবের কি দরকার ছিল আদি?জানিস তো আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার।মা বাবার বয়স হয়েছে।ওরাও একটা আশায় ছিল তোর সাথে বোনের বিয়েটা দেবার জন্য আর ইমনও তোকে খুব ভালোবাসে।”
সাথে সাথে কাটা কাটা গলায় আদি উত্তর দিয়েছিল,”দেখ ভাই সাধারণ মধ্যবিত্ত চিন্তা করিসনা একটু বেরো এসব থেকে।প্রেম আর বন্ধুত্বের সীমারেখা করতে শেখ তোরা এবার।তোর বাবার ওই সামান্য মুদির দোকান ছাড়।আমি ফ্ল্যাটের ব্যবসা শুরু করছি। আমার হবু বৌয়ের বাড়ি থেকেও মোটা টাকা দিচ্ছে বিয়েতে।বিদেশ ফেরত জামাই বলে কথা।”তারপর হুশ করে মিলিয়ে গেছিল আদির গাড়িটা।পড়ার টেবিলে ইমনের মাথায় হাত রেখেছিল বড়দা বলেছিল,”মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে রে বোন।”তারপর অনেকগুলো বছর, মা বাবাও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। সবকিছু ভুলে যাবার জন্য আস্তে আস্তে কলম ধরে ইমন। অবশ্য টুকটাক লেখালিখির অভ্যাস আগে থেকেই ছিল। কিন্তু এবার পুরোদমে নিজের অনুভূতিগুলো লিখতে লিখতে কখন আস্তে আস্তে সাহিত্য জগতে বেশ নাম করেছে আজকের ইমন।নিজের ব্যক্তিগত ব্লগ,ম্যাগাজিন,সাহিত্যচর্চার আসরে বেশ পরিচিত ও।এমনসময় একদিন অচেনা নম্বর থেকে ফোন।ট্রু কলার অ্যাপের দৌলতে ফুটে ওঠে আদি নামটা।ক্রমাগত রিং হতে থাকে।
__”কেন এতদিন পর আবার?”ইমন ফোনটা ধরতেই ভেসে আসে আদির গলা,”জানি মন অনেক বড় লেখিকা হয়ে গেছিস তুই এখন।তোর ব্লগ থেকে ফোন নম্বরটা পেলাম।তবুও বলছি একবার আমার সামনে আসবি ইমন?তোর একটা খুব দামী জিনিস আছে আমার কাছে।তোর প্রথম লেখা কবিতার খাতাটা আমার কাছে ছিল। যাবার আগে তোকে দেব ভেবেছিলাম কিন্তু হয়ে ওঠেনি যে কারণেই হোক।”
যে দামী জিনিসটা কোনোদিন পাবেনা বলে ধরেই রেখেছিল ইমন সেটা হটাৎ পাবার কথা শুনে রাজি হয় ও।প্রথম প্রেমের মত প্রথম লেখার খাতাটাও যে লেখক, লেখিকাদের জীবনে একটা পরম রত্ন। তাই দোনামনা করেও রাজি হয় ইমন।এসব ভাবনার মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছু সময়।হুশ ফেরে ঈশানের ফোনে,”কি ম্যাডাম আজ বেরোচ্ছেন তো কেনাকাটা করতে?বেশিদিন তো বাকি নেই!”
__”হুম ঠিক সাড়ে চারটে চলে আয় গোলপার্ক সিসিডিতে। দুপুরে একটা অনুষ্ঠান আছে নারীদিবস নিয়ে আমি ওটা মিটিয়ে এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করব সিসিডিতে। একটা খুব দরকারী জিনিস নেওয়ার আছে।ওখান থেকে তোর সাথে গড়িয়াহাট চলে যাব।”ইমন বলে।
__”আচ্ছা জো হুকুম” ঈশান উত্তর দেয়।
__”শোন ঈশান তুই জানতে চাসনা আমার কোন বন্ধু?কেনো এমন রে তুই?” ইমনের প্রশ্নের উত্তরে ঈশান বলে,”সব উত্তর পাবি আজ।”ফোনটা ছেড়ে ইমন ভাবে সেদিন আদি চলে যাবার পরে কম তো কিছু করেনি ঈশান ওর জন্য। কখন যে নোটস দেওয়া নেওয়া থেকে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে দুজনে। যাইহোক নিজে গোছগাছ সেরে উদিতাকে দেখাশোনার লোক মতির মাকে সব কাজ বুঝিয়ে বেরোয় ও।গোলপার্কের এক আশ্রমে নারীদিবসের আমন্ত্রণ সেরে সিসিডিতে পৌঁছে কাঁচ ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই ওর নজর যায় কোণের টেবিলের দিকে আদি বসে আছে। ওকে দেখেই বলে,”দেখ মন আজ কিন্তু আমি দেরি করিনি আগের মত।আগে তুই অপেক্ষা করতিস আর এখন আমি। যাক কেমন আছিস তুই?”সানগ্লাসটা চোখ থেকে নামিয়ে ইমন বলে,”নিজের মনটাকে বাঁচিয়ে বেশ ভালো আছি আদি আমি এখন। আমার খাতাটা দেবে কি? যার জন্য আবার আসা।”
__”এত তাড়া কিসের তোর?সেদিন ছেড়ে যাবার অভিমান ভুলতে পারিসনি।আমি কি করতাম বল? বিদেশ থেকে ফিরে শুনেছিলাম বাবা বিয়েটা ঠিক করে ফেলেছে বাবারই এক ব্যবসায়ী বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে। সেই মুহূর্তে রাজি হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিলনা আমার। কিন্তু এখনও আমার মন জুড়ে শুধু তুই ইমন।একটু ক্যাপুচিনো তো নে তোর পছন্দের।আমি অর্ডার করে দিয়েছি তুই আসার আগেই।” কবিতার খাতাটা বাড়িয়ে দিতে দিতে বলে আদি।অগত্যা খাতা ব্যাগে ঢুকিয়ে চুমুক দেয় ইমন।আদি বলে,”জানি তোর অস্বস্তি বোধ হচ্ছে ভীষণ।কিন্তু আমরা কি নতুন করে শুরু করতে পারিনা?আমার ঘরটা পরিপূর্ণ হলনা রে ইমন তোকে ছাড়া। মাস তিন আগের ফাইনাল সই করে বিচ্ছেদ হয়ে গেল আমাদের।” মৃদু হেসে ইমন বল,” উঠি রে আদি। কিছু কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরব।উদিতা স্কুল থেকে ফিরে কতক্ষণ একা থাকবে আর!”
__”তুই তো এখনও বিয়ে করিসনি তাহলে উদিতা কে?”আদি জিজ্ঞাসা করে।
পিছন থেকে কাটা কাটা কণ্ঠে একটি পুরুষকণ্ঠ বলে ওঠে,”বিয়ে করলেই বুঝি সন্তানদের মা হওয়া যায়? ইমন চমকে দেখে ঈশান দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। একটু থেমে ঈশান বলে,”নিজের চিন্তাধারা একটু পাল্টান মিস্টার আদিত্য সেন।ইমন আপাতত সিঙ্গেল মাদার।আর উদিতাকে ও একটা হোম থেকে দত্তক নিয়েছে বেশ কিছুদিন।তবে খুব তাড়াতাড়ি উদিতা ওর মা ইমনের আদরের সাথে বাবা ঈশানের আদরটাও পাবে। আমাদের বিয়েতে আসবেন কিন্তু আদি।চল ইমন”।বেরিয়ে যায় ঈশান আর ইমন আদিকে একা বসিয়ে রেখে।আদি দেখতে পায় ঈশান,সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিপছিপে তরুণটি ইমনকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে ওঠে।দরজা বন্ধ হতেই ইমন বলে ওঠে বলে,”ঈশান আমি কিন্তু তোকে বলতে চেয়েছিলাম আদির কথা।”ওর ঠোঁটে হাত রাখে ঈশান,”আমি তোকে চিনি মন।নিজের স্বচ্ছতা অন্যের সামনে প্রমাণ করার কোনো দরকার নেই।তোর মন যা চায় তাই করবি।আজ নারী দিবস।সবার আগে প্রতিটি নারীর উচিত নিজে নিজের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো।আমিও যেতাম না তোর অন্য কোনো বন্ধুর মাঝে।কিন্তু সময়ের একটু আগে তোকে আনতে গিয়ে যখন দেখলাম যে আদি তখন তোর সাথে হওয়া সমস্ত অন্যায়ের জবাব দিতে চেয়েছিলাম।ব্যাস এটুকুই।এখন দেখ তো আমাদের বিয়ের কার্ডটা কেমন লাগছে?”
ঈশানের দিকে তাকিয়ে দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয় ইমন।এফএমে তখন বাজছে,”মধুর অমৃত বাণী, বেলা গেলো সহজেই/মরমে উঠিল বাজি;বসন্ত এসে গেছে”। নারীদিবসের সেরা উপহারটা পেয়ে গেছে ইমন সেটা হল ঈশানের ভরসা আর ওর প্রতি বিশ্বাস।সিসিডিতে তখন একলা বসে তখন আদি ঠিক যেমন সেদিন ইমন ছিল ওর জন্য।সামনে টেবিলে রাখা চিরকুট। এটা আবার কোথা থেকে এলো। ঈষৎ কৌতূহলবশে আদি খুলে দেখে তাতে ইমনের লেখা “সুখে আছে যারা সুখে থাক তারা/সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা।
(সমাপ্ত)