বাবা কুমিল্লার রসমালাই খুবই পছন্দ করে, মাসে অন্ততপক্ষে একবার আমাকে কুমিল্লা পাঠান রসমালাই আনার জন্যে। এইবারও বাবা কুমিল্লা যাওয়ার একটি ট্রেনের টিকিট এনে আমাকে দেয় আর বলে, যাও কুমিল্লা গিয়ে রসমালাই নিয়ে আসো।
বাবাকে বললাম, টাকাতো দেননি রসমালাই কি দিয়ে আনবো? বাবা জবাবে বলে, কুমিল্লা গিয়ে আমাকে একটা ফোন দিবে আর আমি বিকাশে করে টাকা পাঠাবো। তোমারতো আবার কোন ঠিক নাই।
বাবার এই অবিশ্বাসের পিছনেও কারণ আছে। একবার বাবা আমাকে রসমালাই আনার জন্যে টাকা দেয় আর আমি সেই টাকা দিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বিরিয়ানি খেয়ে ঘরে এসে বলি, বাবা টাকা পকেট থেকে হারায় গেছে। তার পরেরবার থেকেই বাবা আমাকে রসমালাই আনার জন্যে আর ঘরে টাকা দেয়না, কুমিল্লা গিয়ে বাবাকে ফোন করি আর বাবা আমাকে বিকাশে টাকা দেয়।
মানিব্যাগে ৭টাকা আর ট্রেনের টিকিটটা নিয়ে কুমিল্লা যাওয়ার জন্য ট্রেনে উঠলাম। কুমিল্লার উদ্দেশ্যে ট্রেন রওনা দিলো! আমার পাশে বসে আছে এক ভদ্র মহিলা আর তার পাশেই আছে এই ভদ্র মহিলার সুন্দরী একটা মেয়ে।
মাঝ রাস্তায় ভদ্র মহিলাটি যেন কার সাথে কথা বলছিলো, ” ছেলেপক্ষ কি বললো? না করে দিয়েছে? করবেইতো আমার কপাল! এই পর্যন্ত ৫০টা ছেলেই বিয়ে করার জন্যে না করে দিয়েছে। “
ফোনটি শেষে ভদ্র মহিলাটি কান্না করতে লাগলো আর পাশে থাকা উনার মেয়ে বললো, কান্না করিওনা মা। আমি পাশে থাকায় ভদ্র মহিলার কাছে জিগ্যেস করলাম, কি হয়েছে আপনার? কান্না করছেন কেন?
ভদ্র মহিলা বলে, জিগ্যেস করিওনা বাবা! দুঃখের কথা। এই বলে মহিলাটি আবার কাঁদতে লাগলো। আমি বললাম, দুঃখের কথা শেয়ার করলে নাকি মনের দুঃখ একটু কম হয়। তো চুপ না থেকে বলুন।
ভদ্র মহিলা উনার মেয়েকে দেখিয়ে বলে, ও আমার মেয়ে জেরিন। আচ্ছা ওকে দেখে বলোতো ও কি সুন্দরী না?
এ আবার কেমন প্রশ্ন! একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। আপনার মেয়েতো যথেষ্ট সুন্দরী! কিন্তু এ প্রশ্ন করলেন কেন?
ভদ্রমহিলা আবারো কান্না করে দিলো। কান্না করতে,করতে বললো, এই পর্যন্ত প্রায়ই ৫০টা ছেলে আমার মেয়েকে দেখেছে কিন্তু কেউ বিয়ে করার জন্যে রাজি হয়নি।
এতো সুন্দরী মেয়ে, যাকে একবার দেখলেই যে কেউ বিয়ে করার জন্যে রাজি হয়ে যাবে তাকে কেউ বিয়ে করতে চায়না! অবাক করার বিষয়।
আমি জিগ্যেস করার আগে সামনের সিটের একটি ছেলে ভদ্রমহিলাকে জিগ্যেস করলো, কেন আন্টি? এতো সুন্দর মেয়ে আপনার, কেউ বিয়ে করতে চায়না কেন?
” সমস্যা আমার মেয়ের না, সমস্যা হলো ওর জন্মদাতা বাবার। উনি আগে মানে আমাদের বিয়ের আগে অভাবে পড়ে কয়েকদিন রিক্সা চালিয়েছিলো, সে কারণেই কোন ছেলেপক্ষ বাইরে আমার মেয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে সবাই বলে বাবাতো রিক্সাওয়ালা ছিলো। “
আবারও আমি বলার আগে সামনের ছেলেটি বললো, এ তো অন্যায়! বাবা রিক্সা চালিয়েছে তাতে মেয়ের কি? তাছাড়া উনিতো তেমন বেশি রিক্সা চালায়নি, তারপরও রিক্সাওয়ালা হ্যাসট্যাগ পেয়ে গেলো কেমনে!
ছেলেটিকে দেখে অনেক শিক্ষিত মনে হলো। আমি তার সাথে মত জানিয়ে বলি, হ্যাঁ এ তো বিরাট বড় অন্যায়।
একটি স্ট্যাশনে এসে ট্রেন থামলো। আমি ট্রেন থেকে একটু নেমে একটা টং দোকানে গিয়ে ৫টাকা দিয়ে একটা চা খেলাম। চা খাওয়ার পর পেটে প্রচন্ড প্রস্রাব চেপেছিলো, সামনের টয়লেটে গিয়ে দেখি প্রস্রাব করা ৩টাকা।
মানিব্যাগ খুলে দেখি আর একটা ছেঁড়া দুই টাকা ছাড়া আর ট্রেনের টিকিটটা ছাড়া অবশিষ্ট কিছুই নেই। তাই বাধ্য হয়েই টয়লেটের সামনে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একটা নির্জন জায়গায় গিয়ে পেটটা খালি করলাম।
ট্রেনে ফিরে এসে ওই ছেলেটার পাশে গিয়ে বসলাম। ছেলেটি বাদাম খাচ্ছিলো, আমাকে হাতে দুইটা বাদাম দিয়ে বলে, নেন বাদাম খান।
আমি বাদাম দুইটাকে ফ্রেশ করে খাওয়া শুরু করলাম।
ছেলেটি আমাকে জিগ্যেস করলো,
” নাম কি তোমার?“
রাইহান! আপনার কি নাম?
” রাফি, আমার নাম রাফি। তো তুমি প্রফেশনাল কি করছো?“
এইতো অনার্স শেষ করলাম। সামনে এমবিএতে চান্স নিবো। আপনার প্রফেশন?
” এমবিএ শেষ করলাম। এখন একটা বিজনেস করছি। “
ছেলেটি খুবই ভালো! ওর পাশে বসে অনেকগুলো বাদাম খেতে পেরেছি।
ভদ্রমহিলাটি হঠাৎ আবার কান্না শুরু করলো। কেঁদে,কেঁদে বলতে লাগলো, হে আল্লাহ! কে করবে আমার এই অভাগা মেয়েকে বিয়ে? এই দেশে কি এমন কোন ছেলে নেয় যে আমার মেয়েকে বিয়ে করবে?
মনে, মনে বললাম যদি আমি সেট হয়ে যেতাম এই মেয়েকে নিশ্চিত বিয়ে করে নিতাম। এইরকম সুন্দরী মেয়ে হাতেগোনা কয়েকটাই পাওয়া যায়।
আমার মনে,মনে কথা বলা শেষ হওয়া মাত্রই ওই রাফি নামের ছেলেটা মুখে বলে দিলো, আপনি আর কান্না করবেননা! আমিই করবো আপনার মেয়েকে বিয়ে।
ট্রেনের সবাই বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে রাফির দিকে তাকালো। মেয়েটির মা রাফিকে কপালে চুমু দিতে লাগলো, আর ওকে হাজার রকমের দোয়া করে ভরিয়ে দিলো।
ট্রেনের সবাই রাফির জন্য হাত তালি দিলো। সবাই একটা ইতিহাসের সাক্ষী হতে চলেছে। আমার অবশ্য মনে,মনে একটু হিংসে হচ্ছে কারণ যদি আরো আগে ক্যারিয়ার সেট হয়ে গেলে আজ রাফির জায়গায় আমি হতাম।
ট্রেনের সবাই রাফিকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলো। “এইরকম ছেলেও দেশে আছে ভাবায় যায়না, সত্যি এইরকম ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।“
ভদ্রমহিলাটা বললো, এই খুশিতেতো সবাইকে মিষ্টি মুখ করানো দরকার। রাফি বললো, হ্যাঁ আন্টি ঠিক বলেছেন। আমার কাছে মিষ্টি আছে, আমার বোনের শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলাম।
এই বলে রাফি মিষ্টি বের করে ট্রেনের সবাইকে খাওয়ানো শুরু করলো! আমার মুখের ভিতর ২টা মিষ্টি দিয়ে বললো, ” দোয়া করিও ভাই। “
মিষ্টি খাওয়ার পর আমার হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে ঘুম আসতে লাগলো এবং নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুম থেকে উঠার পর আমি আমার মাথায় প্রচন্ড রকমের ব্যাথা অনুভব করলাম। চোখ খুলতেই দেখি কয়েকজন পুলিশ পানি নিয়ে ট্রেনের সবার মাথায় দিচ্ছে।
ট্রেনে যেসব মহিলাদের গলায় স্বর্ণের চেইনি ভরা দেখেছিলাম তাদের গলা দেখি খালি। ট্রেনের সবাই একসাথে কান্না শুরু দিলো! এক ভাই চিল্লায়,চিল্লায় বলছে আমার বউয়ের জন্য ডায়মন্ডের রিং কিনেছিলাম, ও বলেছে ডায়মন্ডের রিং না দিলে আমাকে আর ঘরে ঢুকাবেনা।
আরেকজন কান্না করতে,করতে বললো গার্লফ্রেন্ডের জন্য ৩টা মোবাইল নিছিলাম, ও বলেছে ৩টা মোবাইল না দিলে রিলেশন রাখবেনা।
সবার সব জিনিসপত্র ও টাকা পয়সা গায়েব! সাথে গায়েব রাফি নামের ছেলেটা, ভদ্রমহিলা ও উনার মেয়েকেও আর পাওয়া যাচ্ছিলো না। সাথে গায়েব ট্রেনের চালকও। সবাই বুঝে গেলোযে এইসব মিষ্টির কামাল।
আমার মানিব্যাগ ও মোবাইলের কথা মনে পড়তেই তারাতারি পকেটে হাত দিয়ে দেখি আমার মানিব্যাগ, মোবাইল পকেটে নাই। বসার সিটে চোখ যেতেই দেখি আমার মানিব্যাগ ও মোবাইল পড়ে রয়েছে। তারাতারি মানিব্যাগ খুলে দেখি ৭টাকা আছে, ছিলো ২টাকা ৭টাকা আসলো কেমনে? মানিব্যাগের ভিতর একটা চিঠি পেলাম। চিঠিতে লেখা ছিলো, ” ভাই তুমিতো বাদাম পছন্দ করো তাইনা? এই ৫টাকা দিয়ে বাদাম খেয়ে নিও।“
মোবাইলের নিচে পেলাম আরেকটা চিঠি। চিঠিতে লেখা, ” এই যুগে এইরকম মোবাইল? বাই দ্যা ওয়ে, ভাই তোমার এই মোবাইলের কভারটা ছিঁড়ে গেছে। ছিঁড়ে যাওয়া কভারের নিচে ১০০টাকা রাখা আছে তা দিয়ে নতুন কভার কিনে নিও। “
ট্রেনের সবাই কান্না করছে আর আমি খুশি মনে ট্রেন থেকে বের হয়ে গেলাম। হাসিমুখে ট্রেন থেকে আসার সময় এক পুলিশ অফিসার বলেছে, আহা এই ছেলেটার টাকা পয়সা মনে হয় বেশিই ছিলো। তাই অতিরিক্ত শোকে মুখে হাসি নিয়ে চলে যাচ্ছে।
সামনে একটা রসমালাই এর দোকান দেখেই মনে পড়লো যে কুমিল্লায় আমি রসমালাই নিতেই এসেছি। যাই, বাবাকে একটা ফোন দিয়ে বিকাশে টাকা দিতে বলি।