সন্ধ্যা নাগাদ শুভ আমাকে কল দিয়ে বললো-অনন্যা,আমি তোমাদের বাসার পেছনের ম্যানহোলে পড়ে গিয়েছি। পড়ে আটকে গেছি।পুরোপুরি আটকে যাই নি।তবে এক হাত আটকে গেছে।আরেক হাত আটকায় নি।যে হাত বেঁচে গেছে সে হাতে ফোন ছিলো।তাতেই তোমাকে কল দিয়েছি। আশেপাশে কোনো মানুষ নেই।তুমি কি আসবে?
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে শুভ আমার উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলো।আমি নির্বিকারভাবে বললাম-‘না’।বলেই লাইন কেটে দিলাম।এতক্ষণ যার কথা বললাম,সে আমার একমাত্র গুণধর প্রেমিক।তার নাম যদিও শুভ কিন্তু তার সাথে সবসময় অশুভ কিছু ঘটতেই থাকবে এবং অবশ্যই সেটা তার নিজের দোষে।সে একজন অঘটনপটীয়সী!
আমি ওকে বারবার করে বলেছি,বাসার পেছনের দিকটা দিয়ে না আসতে।দরকার হলে ছাদে গিয়ে দেখা করবো।পেছনের দিকে ভয়টা ছিলো ম্যানহোল নিয়ে।যতটা না ম্যানহোল ততটাই শুভর অসাবধানতা নিয়ে।তার প্রতিদিন একবার করে আমাকে দেখা চাই-ই-চাই। ফলস্বরুপ,আজ সে ম্যানহোলে!
বাসার দারোয়ান চাচাকে নিয়ে গেলাম যতক্ষণে ততক্ষণে দেখি শুভ’কে ঘিরে উৎসুক জনতার ভীড় জমেছে।দেখলাম শুভ গোমড়া মুখ করে আছে আর বলছে-আমাকে উঠাতে অনন্যা আসবে।আপনাদের দরকার নেই,প্লিজ সরুন।
আমি গিয়েই চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম-এসব কি!
শুভ মুহুর্তে হাসি দিলো।আমার রাগ আরো এক ধাপ বেড়ে গেলো।দারোয়ান চাচা আর ক’জন মানুষ মিলে ওকে টেনে তুললো। সে এক বিদঘুটে কান্ড।বাসায় এসে আম্মুকে বললাম-এক ফ্রেন্ড ম্যানহোলে পড়ে গেছে।আব্বুর লুঙ্গি বা, প্যান্ট দাও তো একটা।
আম্মু তাড়াতাড়ি করে এনে দিলো।আমাকে ফিসফিসয়ে বললো-ছেলেটা ব্যাথা-ট্যাথা পায়নি তো? একটা ডাক্তার ডাকা উচিত না?
আমি বিরক্তমুখে বললাম- ওসব কিছু লাগবে না।আপাতত,দুইটা লাক্স সাবান দাও আর বডি স্প্রে গুলা বের করে রাখো।
দু’ঘণ্টা বাদে শুভ যখন ওয়াশরুম থেকে বের হলো তখন আমি ২০ মিনিট ধরে ওর গায়ে সেন্ট মাখালাম।ও বিরস মুখে বললো-তোমাদের খুব কষ্ট দিচ্ছি তাই না?
আমি কিছু বলার আগেই আম্মু কোথথেকে হুট করে এসে বললো-না,না,বাবা।কিসের কষ্ট।তুমি নিজেই তো…আহারে কি অবস্থা। অনন্যা,ওকে নিয়ে ডাইনিং-এ আয়।
শুভ বলে উঠলো-না,আন্টি।এখন একদম খাওয়ার রুচি নেই।বাসায় যেতে হবে।
-ওমা,তাই কি হয়! কিছু খাও
-আরেকদিন আন্টি…
শুভ যখন বের হয়ে যাচ্ছিলো আমার দিকে ফিরে বললো-তোমার জন্য গোলাপ এনেছিলাম,দুর্ভাগ্য সেটা ম্যানহোলে পড়ে গেছে।
আমি ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিলাম।এই আধপাগল ছেলেটার সাথে আল্লাহ কেন যে আমাকে জুড়ে দিলো।
শুভ’র সাথে আমার প্রেম কিন্তু হুট করেই হয়ে যায় নি। একটু একটু করে হয়েছে।আমি কখনো তাকে রাগ করতে দেখি নি।সবসময় রাগ-অভিমান আমিই করেছি।আর,সেসব ভাঙ্গাতে এসে সে যেসব কান্ড করে হাসব না কাঁদবো ভেবে পাই না।
একদিন রাতে শুভ কে বললাম-একটু রোমান্টিক হও না..
শুভ ফিসফিসিয়ে বললো-রোমান্টিক কি করে হবো?
আমি বিরক্ত মুখে বললাম-ফিসফিস করতেছো কেন।স্পষ্ট ভাবে কথা বলো।
শুভ হাই তুলতে তুলতে বললো-কালকে একটা নতুন তথ্য পেলাম জানো?
-কি?
–রাত জাগা নাকি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো না।রাত জাগলে নাকি মানুষ তাড়াতাড়ি মারা যায়।রাত জাগলে….
– shut up!
বলেই লাইনটা কেটে দিলাম আমি।এই ছেলেটা আন-রোমান্টিক তো বটেই, চরম বিরক্তিকর ও।
ক্যাম্পাসে ঢুকেই শুভকে দেখে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম-আসছো কেন?
শুভ বললো-রাগ করো না,অনন্যা।
আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম-আমার নাম ধরে ডাকবা না।
ও বললো-তাহলে কি ডাকবো?
আমি রেগে বললাম-ম্যাডাম ডাকবে।
শুভ আমার পাশে বসতে নিলে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম-খবরদার! একদম পাশে বসবে না।১০ হাত দূরত্বে বসো…
ও গুণে গুণে দশ হাত দূরত্বে বসে বিরস মুখে বললো-ম্যাডাম…
আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলাম। আজকে আর তাকাবোই না বদ’টার দিকে।
অভিমানের বরফ গলে জল হয়ে গেলো কিছুদিনের মধ্যেই।দিন কয়েক পর ও আমাকে বললো-অনন্যা,আমাকে কি কালারের শার্টে মানাবে?
আমি বললাম-নীল।
ও বললো-শুধু নীল!
আমি বললাম-গাঢ় নীল।
পরদিন দেখি বিশ্রী নীল রং এর একটা শার্ট পড়ে আসছে।দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আমার।আমি বললাম-ছিহ!কি বাজে দেখাচ্ছে, আয়নাতে একবারো দেখো নি?
শুভ মুখ গোমড়া করে বললো-দেখেছি..
আমি রেগে বললাম-পড়েছো কেন তাহলে?
ও বললো-তুমিই না বললে গাঢ় নীল!
আমি বললাম-তাই বলে এতটা নীল বলেছি!
ও বললো-গাঢ় নীল খুঁজে পাচ্ছিলাম না।তাই বাসায় এসে আকাশী কালার শার্টকে নীল রং করেছি।ভালো হয়েছে না? এটাই তো গাঢ় নীল, রাইট?
আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম-এক্ষুণি এটা খুলো,এক্ষুণি…
শুভ আঁতকে উঠে বললো-পাবলিক প্লেসে!
আমি বললাম-তোমাকে এতটাই বাজে দেখাচ্ছে যে,খালি গায়ে এর চেয়ে ভালো লাগবে।
শুভ কাকুতিমিনতি করে বললো-প্লিজ অনন্যা,এমনটা করতে বলো না প্লিজ…আর কখখনো হবে না।
আমি পাশের একটা শপিং মল থেকে শার্ট কিনে বিশ্রী রং এর শার্টটা ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম।ছেলেটার রুচিবোধ বলতেও কিছু নেই।ভবিষ্যতে, বিয়ের পর সবাই না বলে বসে,কি রুচিহীন একটা ছেলেকে বিয়ে করেছে অনন্যা।
আমি শুভ কে একটা লিস্ট দিলাম কি কি করা যাবে আর কি কি করা যাবে না।ওর যেসব বাজে অভ্যাস আছে সেসব পরিবর্তন করতে হবে সেটাও বললাম।শুভ শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বললো- সে আমার সব কথা শুনবে।আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।এবার যদি পথে আসে।
আমার জন্মদিনের আগের রাতে শুভ আমাকে বললো-অনন্যা,কালকে আমি তোমাকে নিজ হাতে রান্না করা কিছু গিফ্ট দিতে চাই।
আমি বললাম-কালকে জাস্ট তুমি আমার সাথে সারাটাদিন থাকবা ব্যস..তাতেই খুশী!
শুভ বললো-ঠিকাছে,অনন্যা তোমার না চিকেন পছন্দ?
আমি বললাম-তুমি জীবনে কখনো রান্না করো নি।ওসব করা লাগবে না।
শুভ বললো-না,লাগবে।
রাতে সে আমাকে ২ মিনিট পর পর কল দিতে লাগলো।তাও তখন প্রায় রাত তিনটা।আমি ঘুম ঘুম চোখে বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলাম-এত রাতে এতবার কল দিচ্ছো কেন?আমার ঘুম আসছে।বারবার ঘুম ভাঙ্গাবা
না,অসহ্য!
শুভ ফোনের ওপাশ থেকে ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো-অনন্যা,মুরগী খুঁজে পাচ্ছিলাম না।অনেক কষ্টে পেয়েছি।এটাকে জবাই করেছি।জবাই করার পর দেখি এটা উঠে বারান্দায় দৌড়ে চলে গেছে। একটুর জন্য বারান্দা থেকে লাফ দিতো।ধরে এনে গলাই আলাদা করে ফেলেছি।কিচেনে এত রক্ত মনে হবে যেনো আমি মানুষ খুন করেছি।
এত রাতে এসব শুনতে কার ভালো লাগে।আমি রাগে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম-তোমাকে না বলেছি যেটা পারবে না সেটা করবে না।
শুভ হতাশ গলায় বললো-এবারই শেষ, আর করবো না।একটা কথা বলবো?
আমি বললাম- তাড়াতাড়ি বলো..
শুভ বললো-মুরগীর চামড়া ছিলা+রান্নার সহজ উপায় কি?
আমি বিরক্ত নিয়ে বললাম-বেশী কিছু না জাস্ট একটা আস্ত মুরগীরে গরম সসপ্যানে লবণ-তেল-মরিচ-আদা-রসুন দিয়ে ঠেসে ঢুকিয়ে চুলায় বসিয়ে দিবা ব্যস..
শুভ খুশী খুশী গলায় বললো-আচ্ছা,ঠিকাছে…
পরদিন যখন তড়িঘড়ি করে বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম তখন কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাক দিলো।পেছনে ঘুরতেই দেখি রহমান চাচা।উনি এগিয়ে এসে বিরস মুখে বললেন-অনন্যা,মা।তোমার কি শুভ নামে কোনো বন্ধু আছে?
আমি বললাম-জ্বি,চাচা।কেনো?
উনি তিক্ত কণ্ঠে বললেন-পোলাডা কাল রাইত দুইটা বাজে আমার কাছে আইছিলো মুরগী কিনতে।আমি কইলাম সকালে নিয়েন।হেয় নাছোড়বান্দা। আমারে ঘুমের থেকে টাইন্না উঠাইয়া দোকানে নিয়া ফার্মের তে একটা মুরগী কিনা নিলো।হেয় মুরগীর দাম বেশী দিয়া দিছে।আরো ৫০০ টাকা পাইবো।এই লও,তোমারে দিলাম। তুমি হেরে দিয়া দিও…
আমি লজ্জ্বায় আর রাগে লাল-নীল হয়ে গেলাম।কি বলা উচিত ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।শুভ’র জন্য যে কত লজ্জ্বা পেতে হবে কে জানে!
আমি শুভকে ফোন দিয়ে বললাম- কই তুমি?আমি এসে বসে আছি।
শুভ বললো-জ্যামে আছি..আসছি।
ও আসলো আরো আধঘণ্টা পরে।ফুল,চকলেট হাবিজাবি দেয়ার পর আমি বললাম- মুরগী কই দেখি?
ও হতাশ কণ্ঠে বললো-মুরগী পুড়িয়ে ফেলেছি।
আমি বললাম-মানে কি?
শুভ বললো-সসপ্যানে ঢুকিয়ে কিচেনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।সকালে উঠে দেখি পুরো ছাই হয়ে গেছে।
আমি কিছু বললাম না।কিছু বলার ভাষা আসলে ছিলো না।আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।
দিন কয়েক বাদে এক সন্ধ্যার দিকে আমি শুভকে ফোন দিয়ে বললাম- রাতে জেগে থাকবা আজ, কথা বলবো।মন ভালো নেই…
শুভ ব্যস্ত কণ্ঠে বললো-মন ভালো নেই কেন?
আমি বললাম- এমনি..কথা বললেই ভালো লাগবে, ব্যস…
ও বললো ‘আচ্ছা’
রাত ১০ টা পেরিয়ে ১১ টা।তারপর, ১২ টা।আমি শুভকে ফোন দিলাম।ধরলো না।আবার দিলাম,আবার ধরলো না।দশমবারে সে রিসিভ করলো, বললো-কে?
আমি রেগে বলে উঠলাম-কে!তাই না?১১ টায় কল দেয়ার কথা ছিলো, দাও নাই।এখন ১২ টা পেরিয়ে ১ টা বাজতে চললো।
শুভ হতচকিত হয়ে বললো-সর্বনাশ!আমি তো ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম ১২ টার।এলার্ম বাজলেই তোমাকে কল দিতাম।কে বন্ধ করলো এলার্ম!
আমার রাগ আরো বেড়ে গেলো।বললাম- কেয়ারলেস একটা!কল দেয়া লাগবে না তোমার,তুমি ঘুমাও,সারাদিন-রাত খালি ঘুম আর ঘুম-এই বলে চট করে লাইনটা কেটে দিলাম।শুভ এরপর অনেকবার কল দিলো,রিসিভ করি নি।ওর কল দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেছিলাম।হঠাৎ রাত ৩ টার দিকে আবার ঘুম ভাঙ্গলো ওর কলেই।৩৮৭ টা কল ইতিমধ্যে দিয়ে ফেলেছে।আমি এবার রিসিভ করে বললাম- আশ্চর্য!এত কল দিচ্ছো কেনো?
শুভ বললো-অনন্যা…
আমি বললাম- ঘুমাচ্ছি আমি,তুমিও ঘুমাও।আমার মন ভালো হয়ে গেছে।
শুভ আবার বললো-শোনো…
আমি বললাম-বলো..
শুভ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললো- কল রিসিভ করছিলে না দেখে আমি বাসা থেকে বেরিয়ে তোমার বাসার সামনে আসছি।
আমি বললাম- এত রাতে আসার কি দরকার ছিলো? বাসায় গেছো?
শুভ বলল-উঁহু,না…
আমি বললাম- যাও, এত রাতে দেখা করতে পারবো না।
শুভ বললো-অনন্যা,আমি বাসার পেছন দিকটা দিয়ে এসেছি।যেদিকে তোমার বারান্দা আছে।কিন্তু অন্ধকারে কি করে যেনো ম্যানহোলে পড়ে গেছি।
আমি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললাম-আচ্ছা,আপাতত রাতটা ম্যানহোলে কাটাও।সকালে এসে উদ্ধার করবো।
শুভ চাপা গলায় বললো-একটা কয়েল জ্বালিয়ে দিলে ভালো হতো,ম্যানহোলের চারপাশে প্রচুর মশা…