শরতের আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘেরা, বাতাসে কাশফুলের গন্ধ, কলকাতার ওলিতে গলিতে তখন ঢাকের শব্দ—–মা দুর্গা এসেছে বাপের বাড়ি এক বছর পর।
অনন্যা এসে ঢুকলো তার চব্বিশ বছর কাটানো সেই নীড়ে। স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা ইঁটের বড় বড় দেয়ালের মাঝে ছোট্ট সরু একটা গলি, যেখানে সূর্যের আলো হয়তো ঠিক করে এসে পড়েনা কিন্তু এই গলিতে পা রাখতেই অনন্যার জীবনের সেরা আনন্দ আর শান্তি ফিরে আসে। তার জন্মস্থান, উত্তর কোলকাতা। কোলকাতার সৃষ্টি, কোলকাতার ইতিহাস সবটাই জড়িয়ে আছে এই উত্তর কলকাতার পাতায় আর অনন্যার জীবনেরও ইতিহাস লুকিয়ে আছে এখানেই। জন্ম, কর্ম এবং বিয়ে সবটাই এখান থেকেই শুরু। তার মা এর বিয়ের আগে থেকেই তার বাবা, দাদু এবং কাকারা ভাড়া থাকেন এই বাড়িতেই, তা প্রায় চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে আর তাই এই বাড়ির প্রতি একটা আলাদাই মায়া। যদিও মায়া করার মতো হয়তো বাহ্যিক চাকচিক্ক কিছুই নেই। অর্ধভগ্ন আগাছাতে ভর্তি, শেওলা ইঁট বার করা প্রায় একশো বছরের পুরনো বাড়ি, তিনটে পরিবারের একসাথে থাকা আর বাথরুম বলতে একটাই, দুটি ছোট ছোট ঘর আর সিঁড়ির নিচে ছোট্ট একটা রান্নাঘর এটুকুই অনন্যার পরিবারের নিজের আর বাকিটা ওই সবার সাথে ভাগ করে নেওয়া। এমনকি জলের সময়ও ভাগ করা, ছাদে জামাকাপড় শুকোতে দেওয়ার জায়গাও আলাদা আলাদা করা। আগে যখন সদস্য সংখ্যা অনেক ছিল তখন সমস্যা আরও ছিল কিন্তু এখন একটু স্বস্তি।
এত সমস্যা কিন্তু তাও বড়ই মায়া এই বাড়ির প্রতি, এই শহরের প্রতি। অনন্যার জীবনের স্মৃতিগুলো লেগে আছে এই বাড়ির প্রতিটা ইঁটের পাঁজরে পাঁজরে। তার দাদু, ঠাকুমা, দুই কাকা একে একে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই ভিটে থেকেই, তাঁদের আশীর্বাদ লেগে আছে এই বাড়ির স্যাঁতস্যাঁতে হাওয়ায়। তার ছোটবেলার প্রতিটা মুহূর্ত জড়িয়ে আছে এই বাড়িতে। তার প্রথম মা বলে ডাকা, প্রথম স্বপ্ন দেখা, তার প্রথম কথা বলা, প্রথম হাতেখড়ি, প্রথম সেই নেচে ওঠা গানের তালে, তার প্রথম দুর্গা পুজো, বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, মা এর হাতের রান্না, কাকুদের কাছে আবদার, ঠাকুমা দাদুর ভালোবাসা, প্রথম ভাইকে কোলে নেওয়া, কলেজ শুরুর প্রথম দিন, প্রথম রান্না করা, প্রথম প্রেম—– জীবনের সবকিছুর প্রথম অনুভূতি এখান থেকেই শুরু।
অনন্যার কাছে তার শহর বলতে আহিরিটলার ঘাটে হাওয়া খাওয়া, বাগবাজার মা এর ঘাটের সূর্যাস্ত, বাবুঘাটের বৃষ্টিভেজা বিকেল, প্রিন্সেপ ঘাটের আড্ডা, নকুরচন্দ্রের মিষ্টি, ধর্মতলার ভীড়, হাতিবাগান এর কেনাকাটা, হেদুয়াতে সাঁতার শেখা, ট্রামলাইন এর বাঁক, কলেজস্ট্রিট এর বই এর গন্ধ, মান্না দের স্মৃতি জড়ানো কফি হাউস, শোভাবাজার রাজবাড়ীর অষ্টমীর সন্ধিপূজা, শ্যামবাজার গোলবাড়ির কষা মাংস, পরেশনাথ দেখা, ঠেলা রিকশার ঝুনঝুন আওয়াজ, কুমরটুলীর মাটির গন্ধে লেগে থাকা শরতের স্নিগ্ধতা।
চাকরিসূত্রে অনন্য এখন অন্য শহরের বাসিন্দা, দুর্গা পুজোর ছুটিতে এক বছর পর শহরে আসা। সে এখন তার সেই উত্তর কলকাতার ইঁটের পাঁজর বার করা বাড়ির দোতলায় তার পুরোনো ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আর তার চোখের সামনে পুরোনো স্মৃতিগুলো সিনেমার মতো ভেসে উঠছে, কিছুটা স্পষ্ট আবার কিছুটা ঝাপসা। কখন তার চোখের জলে ঝাপসা হয়ে গেল তার দৃষ্টি আর কখন সেই জল তার কাজল ধুয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো তা সে নিজেও টের পেলোনা। ঘরের প্রতিটা জিনিসে সেদিন সে খুঁজে পাচ্ছিল কিছু পুরোনো গল্প, এতটা অন্যরকম আর এতটা আপন আগে কখনো লাগেনি—- সত্যি হয়তো কিছু জিনিস দূরে গেলে স্পষ্ট হয়।
তার নতুন শহরেও সূর্য ওঠে একই সময়, সন্ধ্যে ঢলে পড়ে লাল রঙে আকাশকে ঢেকে, সেখানেও বৃষ্টির ফোঁটা হাসি ফোটায় অনন্যার মুখে কিন্তু তাও সে শহর তার আপন নয়। সেখানের মাটিতে সে পায়না ভালোবাসা, সেখানের হাওয়ায় সে পায়না সোঁদা মাটির গন্ধ, পায়না নিজের মানুষগুলোর আলিঙ্গন, খুঁজে পায়না তার জীবনের স্মৃতিভরা প্রতিটা অধ্যায়—-সেই শহর চেনা হয়েও অচেনা। সেই শহর যদিও অনেক কিছু দিয়েছে তাকে, ভালো চাকরি, নতুন স্বপ্ন–তাই সে ঋণী, কিন্তু তাও সেই শহরকে ভালবাসাটা আজও হয়ে ওঠেনি। জন্ম থেকেই তার প্রেমিক মানে তার কাছে শহর কোলকাতা।
-“অনু নিচে আয়, এবার বেরতে হবে” — মা এর ডাক। তার ফ্লাইট এর সময় হয়ে এসেছে, তার স্বামী আর্য নিতে এসেছে তাকে। তার সেই পুরোনো আয়নার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আরেকবার সাজিয়ে নিল নিজেকে। আজ যেন এই আয়নাতে নিজেকে একটু বেশি সুন্দরী লাগছিলো তার।
-“চলো আমি তৈরি” — ট্যাক্সি এসে গেল। ট্যাক্সির জানলা দিয়ে উকিঁ মেরে বিদায় জানালো তার পুরোনো স্মৃতিদের।
দুর্গা পুজোর পর মা দুর্গার মতো অনন্যাও ফিরে গেল। কলকাতার মাটি ছাড়লো ফ্লাইট, শহর থমকে গেল আর অপেক্ষায় রইলো আরো একটা বছরের। অনন্যা ফ্লাইট এর জানলা দিয়ে নিচে তাকালো, মনে হলো সারা শহর যেন বলে উঠলো — “আসছে বছর আবার হবে”। অনন্যার মুখেও অদ্ভুত হাসি আর চোখের কোনে জল। সেও মনে মনে কথা দিলো তার শহরকে —- “ফিরবো খুব তাড়াতাড়ি, শুধু একটু সময় চেয়ে নিলাম।”