আমরা – ওরা

আমরা – ওরা

‘আমরা’, ‘ওরা’ পার্থক্যটা চোখে পড়ছে? রাজ্যে আট বছর ক্ষমতায় নেই বামপন্থীরা। মিডিয়ার ভাষায় বামপন্থীরা ‘ফিনিশ’। কেতাদুরস্ত নবান্নের মালকিন বলেছেন, ‘সিপিএম খুঁজতে দূরবীন লাগবে’। আম্বানি-আদানির মালাইয়ে কব্জি ডুবিয়ে চর্বি জমানো অমিত শাহ’দের খোয়াবনামা, ‘কমিউনিস্ট মুক্ত দেশ গড়বেন’। গত এক দশকে রাজ্যে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হয়েছেন বামপন্থীরা। সালকু সরেন, অজিত লোহার, পূর্ণিমা ঘড়ুই থেকে শুরু করে, সুদীপ্ত-সইফুদ্দিন হয়ে হালফিলের কাকদ্বীপ -বামপন্থীদের রক্তে প্রতিদিন ভিজেছে বাংলার মাটি। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পার্টি অফিস, জবরদখল গন সংগঠনের হাজারো দপ্তর, ঘরছাড়া অসংখ্য কর্মী-সমর্থক। লেনিনের মূর্তি থেকে জ্যোতি বসুর নামাঙ্কিত ফলক, ভিটে-মাটি থেকে শুরু করে মা-বোনদের ইজ্জত -মদ্যপ লুম্পেন বাহিনীর হাতে রক্ষা পায়নি কিছুই। দলদাস প্রশাসনের কাছে ‘আমাদের’ ব্রিগেডের জন্য নুন্যতম সহযোগিতা পাওয়া যায়নি, ইউনিয়নের রক্তচক্ষু তে যথেষ্ট গাড়ি জোগাড় করা যায়নি, প্রবল শীতে রাত্রি বাসের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা যায়নি, সকলের মুখে দু-মুঠো খাবার তুলে দেওয়া যায়নি।

‘ওঁদের’ ব্রিগেডে ‘পাগলু’ ড্যান্স’র আকর্ষণ ছিল। আগের রাতে খিচুড়ি মাংসের পাত পড়ে ছিল। মদের বোতলের চুইয়ে পড়া মাদকতা ছিল। সানগ্লাসের আড়ালে ভেঙ্কটেশ ফিল্মের ভাড়া করা টলিউড তারকাদের ভিড় ছিল। মাথায় অক্সিজেনের কমে যাওয়া কেষ্ট-বিষ্টু সংগঠক ছিল। বাঁকুড়ার গরমে ভোটের প্রচারের জন্য নতুন ‘সানস ক্রিম’ খোঁজা মুনমুন সেনের মত সাংসদ ছিল। সরকারী প্রকল্পে সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন ছিল। হুমকি ছিল, ধমকি ছিল। মঞ্চে ২৪দলের নেতাদের ভজকট ভিড় ছিল। কৌন বানেগা প্রধানমন্ত্রীর মিউজিক্যাল চেয়ার কম্পিটিশন ছিল। আর ‘আমাদের’ ব্রিগেডে সরজমিনে মানুষ ছিল। নেতা নয়, নীতি বদলের ডাক ছিল। জান কবুল, মান কবুল লড়াইয়ের শপথ ছিল। আপামর বাংলার মেহনতি মানুষের চোখে স্বপ্ন ছিল। নতুন লড়াই’র রসদ ছিল। ‘আমাদের’ ব্রিগেডে প্রাণ ছিল।

‘আমরা’, ‘ওরা’ পার্থক্যটা চোখে পড়ছে? রাজ্যে ব্যাঙের হাঁচি হলেও সিবিআই তদন্ত চেয়ে তখন পাড়া মাথায় তুলতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টানা বাহাত্তর দিন পুলিশ-প্রশাসনের প্রবেশ নিষিদ্ধ তখন নন্দীগ্রামে। বিরোধী নেতা-সাংসদ’দের মদতে বে-আইনি অস্ত্রের পাহাড় জমছে তখন নন্দীগ্রামে। একদিনে সিপিএম’র ২৫টা পার্টি অফিসে আগুন জ্বলছে তখন নন্দীগ্রামে। নিয়ম করে শঙ্কর সামন্ত’দের লাশ পড়ছে তখন নন্দীগ্রামে। প্রশাসনের ডাকা সাত-সাতটা শান্তি বৈঠকে যোগ দিলো না তৃণমূল। ৯’ই ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হেড়িয়ার জনসভায় বলেছিলেন “মানুষ না চাইলে ক্যামিকাল হাব হবে না নন্দীগ্রামে। অধিগ্রহণ হবে না এক ইঞ্চি জমিও।” তবুও নন্দীগ্রামের মাটিতে দাঁড়িয়ে সিপিএম’র ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের’ দ্বিতীয়বর্ষ পূর্তির জনসভাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন বলেছিলেনে “নন্দীগ্রামের গণহত্যার সিবিআই তদন্ত চাই।” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবী মতই সিবিআই তদন্তও হয়েছিল। পেটোয়া আইপিএস দিয়ে তথ্যপ্রমাণ লোপাট করতে হয়নি, পুলিশ পাঠিয়ে তদন্তকারী সিবিআই অফিসারদের গ্রেপ্তার করতে হয়নি, প্রশাসন কে রাস্তায় বসিয়ে মেট্রো চ্যানেলে শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে ধর্নার নামে রকবাজি করতে হয়নি।

দিদি-মোদীর সেটিং-এ ঝুলিয়ে রেখে নয় বরং ২০১৪’তেই নন্দীগ্রামের ঘটনার চার্জশিট জমা দিয়েছিল সিবিআই। সিপিএম’র ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের’ কোন নিদর্শনই খুঁজে পায়নি সিবিআই। তালপাটি খালে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে ‘সিপিএম’র হার্মাদ বাহিনীর হাতে পা চিরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া একটাও শিশুরও লাশ খুঁজে পায়নি সিবিআই। গোটা নন্দীগ্রাম ঘুরে একটাও ‘স্তন কাটা মহিলা’ খুঁজে পায়নি সিবিআই।

‘আমরা’, ‘ওরা’ পার্থক্যটা চোখে পড়ছে? বছর দশ আগে, একটা স্টিং অপারেশনে, নন্দীগ্রামের সিপিআই’র প্রাক্তন বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াসের হাতে প্রায় জোর করেই গুঁজে দেওয়া হয় ১০,০০০ টাকা। বিধানসভায় স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিশ আনেন নারদা ঘুষ কাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত ‘পাঁচ লাখি’ সৌগত রায়। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে সেদিন পদত্যাগ করেন ইলিয়াস। বহিষ্কৃত হন পার্টি থেকেও। মানসিক অবসাদে আজ কোন রকমে বেঁচে আছেন ইলিয়াস। দু-বিঘা জমি বেঁচে চিকিৎসার খরচা চলে। বিধায়কের পেনশন চলে সংসার। পরে অবশ্য সিবিআই জানিয়েছিল ইলিয়াস নির্দোষ। আর ওদের সেই স্টিং অপারেশনর সাজানো সাংবাদিক শঙ্কুদেব পণ্ডা ও নাটের গুরু শুভেন্দু অধিকারী আজ চিট ফান্ডের আর্থিক তছরুপের দায়ে সিবিআই’র খাতায় অভিযুক্ত। জনাব শুভেন্দু বাবু জানলে দুঃখ পাবেন যে গত রোববার ইলিয়াসের ছেলেও এসেছিলেন ঐ ইনকিলাবি ব্রিগেডে।

মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ৫কোটি টাকা দিয়ে সতেরোটা কমিশন গড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।সিপিএম’র নেতাদের পিণ্ডি তর্পণের দিবাস্বপ্নে বিগলিত বুদ্ধিজীবীরা কমিশন’কেই দরাজ সার্টিফিকেট বিলিয়ে বলেছিলেন “এহি হ্যা রাইট চয়েস বেবি।” কিন্তু শত চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তো দূরের কথা, একজন বামপন্থী নেতারও কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেননি দিদিমণি। ৩৪ বছরের একটা দুর্নীতিও প্রমাণ করতে পারেননি দিদিমণি। আর আজ কান টানলে মাথা আসার সূত্রে নিজেই পথে বসেছেন মুখ্যমন্ত্রী। শাগরেদ আমলার কেঁচো খুড়তে কেউটে বেরিয়ে যাবার ভয়ে সিঁটকে গেছেন মুখ্যমন্ত্রী। লজ্জার মাথা খেয়ে নৈতিক জয়ের গল্প ফাঁদছেন মুখ্যমন্ত্রী। কথায় আছে, চোরের মায়ের বড় গলা।

আর আমাদের মা ছিতামনি সরেন। যে ছিতামনি সন্তান কে শহীদ হতে দেখেও লাল ঝাণ্ডার রাজনীতি করেন। প্রবল অসুখ নিয়েও ব্রিগেড আসার জন্য শিশু সুলভ ঝোঁক ধরেন। বয়সের ভারে ন্যুজ হয়েও দেওয়াল জুড়ে কাস্তে-হাতুড়ি আঁকেন। এরকম অসংখ্য ছিতামনি-দেবলীনা-ইলিয়াসদের ঠিকানা এই লাল ঝাণ্ডা। যারা পেটে গামছা বেঁধে নিঃস্বার্থে রাজনীতি করেন। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে পার্টির ডাইরেক্টিভস অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। যাদের কোনদিন কোনও স্টিং হয়নি। একটা ঘন্টাখানেক হয়নি। মিডিয়া ফুটেজ দেয়নি। এনারাই স্বচ্ছ রাজনীতির মুখ। আমাদের আদর্শ। আমাদের ভরসা। আমাদের নেতা। আর যে রাজনীতি, যে রাজনৈতিক দল ঘুষখোর ক্ষমতা লোভীদের দল চালানোর দায়িত্ব দেয়, দুর্নীতিবাজ’দের নেতা-মন্ত্রী বানিয়ে মাথায় তুলে নাচে, ফাঁদে পড়লে আঁচল দিয়ে আগলে রাখেন তাঁদের আমরা ঘেন্না করি। আমাদের গর্ব, আমাদের সাধ্যমত, আমরা সেই রাজনীতির বিরুদ্ধেই লড়াই করি।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত