-আচ্ছা আমি যে একজন অপয়া এটা কি আপনি জানেন?
তনু ভেবেছিল ওর এই ধরনের প্রশ্নে রাতুল বেশ অবাক হবে।কিন্তু সে রাতুলের মাথায় চিন্তার কোনো ভাজই দেখল না।রাতুল পকেট থেকে খুব যত্ন করে একটা সিগারেট ধরালো।তারপর কিছুক্ষণ থেমে বলল
-এটুকুই আপনার বলার ছিল এজন্যই কি ডেকেছিলেন?
তনু রাতুলের এই প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল।সে আবারও বলতে শুরু করল..
-আসলে এই নিয়ে তিনবার আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।প্রতিবারই বিয়ের আগে সবকিছু ঠিকঠাক থাকে।কিন্তু যখন বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে তখনই আমাকে নিয়ে বিপত্তি দেখা যায়।আমার কোনো না কোনো সিরিয়াস টাইপের অসুখ ধরা পড়ে।
-বাহ বেশ ইন্টারেস্টিং তোহ..
-বিশ্বাস হচ্ছে না তাইতো?
আমার মেডিকেল রিপোর্ট গুলা আপনাকে দেখাতে পারলে ভালো হতো।এর আগের বার আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল একজন ব্যাংকারের সাথে।তো সবকিছু ভালোই ছিল।শুধু বিয়ের দুইদিন আগে থেকে শুরু হল প্রচন্ড বমি।সারা গা হাত একদম হলুদ হয়ে গেল।তারপর ডাক্তারি পরিক্ষায় ধরা পড়ে জন্ডিস।দুইমাস ট্রিটমেন্টে ছিলাম।পাত্রপক্ষ এটা শোনার পর আর আগাতে সাহস পায় নি।আর প্রথমবার কি হয়েছিল সেটা বলি শোনেন…
-না থাক।বাদ দাও।তোমাকে বরং আমার লাইফের স্টোরি বলি..
-তুমি তো জানো আমি একজন অনাথ।আমার চাচা আমাকে মানুষ করেছেন।আমার যখন ছয় বছর বয়স তখন একদিন আমি আর আমার বাবা মা একসাথে চিড়িয়াখানায় গেছিলাম।তো চিড়িয়াখানা দেখে বের হবার পর আমার খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা হল।রাস্তার অপরপাশে ছিল আইসক্রিমের দোকান।বাবা রাস্তা পার হয়ে আমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে ফিরছিলেন এসময় একটা মালবাহি পিকআপ ভ্যান নিয়ন্ত্রন হারিয়ে আমার বাবাকে চাপা দেয়।বাবা ওখানেই মারা যায়।আর মা?..নিজের চোখের সামনে নিজের স্বামী মারা যাওয়ার শোকটা নিতে পারেন নাই।তিনি আস্তে আস্তে কেমন জানি হয়ে যান।কারও সাথে কথা বলতেন না ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করতেন না।আর আমাকে একদমই সহ্য করতে পারতেন না।তিনি ভাবতেন,ওইদিন যদি আমি আইসক্রিম খাওয়ার বায়না না ধরতাম তবে বাবার এক্সিডেন্ট হয়ত হোত না।মা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।তাকেও মেন্টাল হাসপাতালে রেখে আসা হয়।বাবা মারা যাওয়ার চার বছরের মাথায় মাও আমাকে ছেড়ে চলে যান।
-ওহহ সো স্যাড।
-আরেকটা ঘটনা বলি।আমার ভার্সিটি লাইফের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল জাবেদ।চারটা বছর আমরা একসাথে ছিলাম।কত হাজারো স্মৃতি কত সুন্দর সুন্দর মুহুর্ত আমরা একসাথে কাটিয়েছি।কিন্তু ফাইনাল ইয়ারে ব্যাচ টুরে বিছানাকান্দিতে যেয়ে আমার লাইফের আরেকটা অঘটন ঘটে।আমরা সেখানে ছবি তোলা নিয়ে সবাই ব্যস্ত ছিলাম।নৌকায় ফেরার পথে হঠাত খেয়াল করি আমাদের মধ্যে একজন কম আছে।জাবেদকে কোথায় দেখা যাচ্ছে না।চারদিকে হইচই পড়ে যায়।সবাই মিলে খোজাখুজি শুরু হয়।দুই ঘন্টা পর ওর লাশটা ভেসে ওঠে।চোরাবালিতে ও আটকে গেছিলো আমরা কেও খেয়ালই করি নি।আমার বেস্ট ফ্রেন্ডেরর দিকে খেয়াল না রাখার দায়টাও পুরোটাই আমাকেই দেওয়া হয়।…
তনু খুব মনোযোগ দিয়ে সবকিছু শুনছিল।এতক্ষণ পর ও বাস্তবে ফিরে আসল।এবং বলল..
-কিন্তু এতে তো আপনার কোন দোষ ছিল না।ওগুলো ছিল দুর্ঘটনা যা যে কারো সাথেই হতে পারে।
-এক্সাক্টলি।তোমার সাথেও যা যা হয়েছে সেটারও কোন ভিত্তি নাই।তোমার সাথে বিয়ে ঠিক হবার পরে তোমাকে নিয়ে বিভিন্ন কথা আমার কানে আসে।তুমি অপয়া,এটা সেটা।কিন্তু আমি তো জানি তুমি আমার চেয়ে বেশি হতভাগা নও..
-হুমম।তবে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন? আপনার আমার একটা দিকে মিল আছে।নিয়তি আমার ক্ষেত্রে চায় না যেন আমি কাওকে আপন করে নিজের কাছে পাই।আর আপনার ক্ষেত্রে নিয়তি চায়না যে আপনি আপন করে কাওকে পাবার পর তাকে বেশিদিন নিজের কাছে রাখেন।বিষয়টা সাইকোলজিক্যাল দিক থেকে অনেকটাই সিমিলার।তাইনা?
-হা ঠিক বলেছো।আচ্ছা আমাদের বিয়ে তো এই মাসের বিশ তারিখ ঠিক হয়ে আছে।তোমাকে যদি আমি আজকে মানে এই মুহুর্তে বিয়ে করি তাহলে কি তোমার কোন সমস্যা আছে?
-তনু বেশ অবাক হলো।সে বলল ‘তা নেই।কিন্তু এখন কেন?’
-কারণ তুমি আর আমি দুজনই হচ্ছি নেগেটিভ ক্যারেক্টার।আর নেগেটিভ নেগেটিভে মিল হলে কি হয় জানো? পজেটিভ..সো আর দেরি নয়।এখনই চল।
তনু আর কিছু বলার সুযোগ পেল না।রাতুল ওর হাতটা শক্ত করে ধরে জোরে জোরে হাটছে।একটু পরেই ওদের বিয়ে হবে।সেই সাথে তনুর নামের সাথে যোগ হওয়া “অপয়া” টাইটেলটাও চলে যাবে।তনু মনে মনে ভাবছিল, ‘আল্লাহ যেন তাকে রাতুলের সাথে সারাজীবন থাকার তৌফিক দান করেন।রাতুলের ‘হতভাগা’ নামটা যেন তনু রাতুলের সাথে সারাজীবন থেকে এভাবেই রাতুলের মত করে ঘোচাতে পারে”