সমস্ত অনুভূতিগুলো জট পাকিয়ে আসছে। ভয়, আনন্দ নাকি দুঃখ? দুঃখ কিসের ? আজ যে ওর মুক্তি। আজ তো আনন্দের দিন। তবু ভয় করছে কেন? এত ভাবার সময় কই? আজ শনিবার। মা এর জলদি ছুটি। মা আসার আগে ওকে বেরিয়ে যেতেই হবে। রাধা দি আজ ছুটি নিয়েছে। মা এর ঘরে ঢুকে আলমারিটা খোলে চয়নিকা।
এমন সুযোগ বারবার আসেনা। সকালেই যখন জানতে পারলো রাধাদি দুপুরে থাকবে না তখনই phone করেছে জয়কে। এই সুযোগ বাড়ি থেকে পালানোর। জয়ের সাথে নতুন জীবন শুরু করার।জয়কে ছাড়া ও বাঁচবে না। কিন্তু মা কখনো মানবে না। মা কিছুই বোঝেনা। মা বোঝেনা ও কত একলা। সেই ছোটবেলা থেকে ও একলা। বড্ড একলা। জ্ঞান হওয়ার পর ও দেখেছে। মা খুব ব্যস্ত। ঘুম থেকে জেগেই ও দেখতো রাধাদির মা ওর জন্য ব্রাশ আর পেস্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে। ওকে রেডি করে দিত স্কুলের জন্য। আর মা তখন নিজে রেডি হতো অফিসে যাওয়ার জন্য। এভাবেই দিন শুরু, আর দিনের শেষে সারাদিনের ক্লান্তির হিসেব নিয়ে মা এর সাথে খেতে বসতো সে। ওই খাওয়ার সময়টুকুই দেখা হতো মা এর সাথে। তারপর মা ঘুমিয়ে যেত ওর পাশে। ও কত কথা জমিয়ে রাখতো মা কে বলবে বলে। কিন্তু মা এর আর জেগে থাকার ক্ষমতা থাকতোনা। পরের দিন একই রুটিন আবার।
চয়নিকার কান্না পেত, অভিমান হতো। অভিমানগুলো জমে পাহাড়। অনেক ছোটবেলায় মা ওকে অফিস ট্যুর এ সাথে নিয়ে যেত। ও বোকার মত ভাবতো বেড়াতে যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে সেই ও আর রাধাদির মা ঘুরতে যেত, মা খুব কম সময়। তারপর ও বড় হলো। মা তখন চাকরি বদলে এই স্কুলের চাকরি নিলো। মা তখন সময় ছুটি পেলো, ব্যস্ত হয়ে গেল চয়নিকা। স্কুল টিউশন কলেজ । চয়নিকা বুঝতো মা এখন তাকে চায় , তার সময় চায়। কিন্তু চয়নিকা তখন নিজের জগৎ বানিয়ে নিয়েছে বন্ধুবান্ধব আর সোশ্যাল মিডিয়ায়। আর মা এর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করতোনা, কিছুটা অভিমান আর কিছুটা অনভ্যাস এর জন্য। তারপর ওর জীবনে এলো জয়। জয় কে নিয়ে জগৎ বানিয়েছে ও। ওর সমস্ত একাকীত্ব আর চাওয়া পাওয়াদের জয় বোঝে। ওরা দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক। ও জয়কে বিয়ে করবে, ওরা একসাথে ঘর বাঁধবে। ওর মা যেমন বাবা কে ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল ও কখনো ছেড়ে যাবে না ওর জয় কে। ওর মা খুব স্বাধীনচেতা, তাই শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পারেনি। এ কথা শুনেছে ও। কি করে পারবে থাকতে, ওর মা এর যা উড়নচন্ডী স্বভাব। এই তো এখন আবার কিসব সমাজসেবা করে। ঘরে থাকতে যার এত কষ্ট সে ঘর করবে কি করে। চয়নিকার বাবা কে একটু একটুও মনে নেই। ওর মা ডিভোর্স দেয়ার পর ওর বাবা আত্মহত্যা করে নেয়। ছিঃ। মা একটা অমানুষ। শুধু নিজের জেদ আর ego র জন্য তার বাবার পরোয়া করেনি।
আলমারি খুললো চয়নিকা। মা এর গয়নাগুলো চাই তার। আর কিছু টাকা। ওরা দিল্লী চলে যাবে। কিছু না কিছু কাজ জুটবেই। যতদিন না জোটে ততদিন চালাতে হবে তো।
মা এর আলমারিতে হাতড়াতে গিয়ে ও পেলো একটা লাল বেনারসি। এটা কি মা এর বিয়ের? এত যত্ন করে এটাকে রেখেছে ! শাড়িতে জড়ানো একটা চিঠি।
চিঠিটা খুললো ও।
“স্বর্ণাভ,
আজ তোমায় লিখছি আবার। কতদিন পর বলতো। সেই কলেজ এ চিঠি চালাচালি। কত সুন্দর ছিল সেসব দিন। একসাথে গঙ্গার ধার, চিনে বাদাম। মনে আছে তোমার? দেখো দেখি কী লিখতে কী লিখছি। আমার সমস্ত রাগ অভিমান সব তোমার ওপরেই। কিন্তু তোমায় না বলে কাকে আর বলি বলো তো সব।
শুধু তোমার সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলাম এক রাতে। তুমি ছিলে তোমার মা বাবার একমাত্র সন্তান। তাঁরা আমায় মেনে নেননি প্রথমে। তারপর তোমার জেদের কাছে ওঁরা হেরে গেলেন। এত জেদ এত ব্যক্তিত্ব তোমার ছিল, সেই তুমিই কি করে পারলে আমার গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারন করে তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রে সামিল হতে? একবারও মনে হলো না যে আসছে সে তোমারও?শুধু পারিবারিক ঐতিহ্য? মা বাবার অমতে আমায় বিয়ে করার মাশুল কেন আমার সন্তানকে দিতে হবে বলো তো? সন্তান সম্ভাবনার সমস্ত খুশী এক মিনিটে শেষ হয়ে গেছিলো তোমার একটি কথায়
‘মনিকা, তোমায় বলা হয়নি । তোমার USG করার সময় জানতে পেরেছি তোমার গর্ভে একটি মেয়ে। আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ছেলে প্রথম। আর তুমি জানোই তোমায় বিয়ে করে মা বাবা কে কতটা কষ্ট দিয়েছিলাম।এখন না হয় ওনাদের এই নাতি পাওয়ার ইচ্ছেটা পূরণ করলাম’
তোমার কথা শুনে অবাক হলাম। তোমায় চিনতে কষ্ট হচ্ছিল। তবু বললাম যে আসছে আসুক, পরে আবার দেখা যাবে। কিন্তু তুমি দৃঢ় স্বরে বললে “abort করতেই হবে”
বিশ্বাস করো এক মুহূর্তে পা এর তলার মাটি সরে গেছিল। আমার সন্তান , আমার চিনি কে বাঁচাতে আর কি করতে পারতাম বলো? বাপেরবাড়ির পাট চুকেছে আগেই। শ্বশুরবাড়ি হারালাম। অনেক কষ্টে একটা কাজ জোগাড়। ডিভোর্স এর কাগজটা হাতে পেয়ে আরেকবার ভেঙে পড়া। তুমি কি করে পারলে এটা? পরে অনেক পরে বুঝেছি কতটা মানসিক চাপ ছিল তোমার ওপর। মা বাবা নাকি স্ত্রী। কিন্তু যখন বুঝলাম তখন তুমি আর নেই। আমারও চাপ কম ছিল কি। তুমি আর মেয়ে, সুখী গৃহকোণ আর ন্যায়ের জন্য লড়াই। তবু হার তো মানিনি জীবনের থেকে।
জানো , চিনি পুরো তোমার মত দেখতে। ওর রাগ কথা বলা তোমার মত। অভিমানী তোমার মতোই। ওকে সময় দিতে পারিনি কখনো বেশি। ও খুব অভিমান করেছে । কিন্তু কী বলে ওর মান ভাঙাবো বলো। সেই তো উঠে আসবে তোমার কথা। ও ভাববে তুমি কত কাপুরুষ। কিন্তু আমি জানি তুমি নয় কাপুরুষ। পরিস্থিতি তোমায় বাধ্য করেছিল। জন্মদাতা জনমদাত্রীর কথাও যে ভাবতে হয় আমাদের।
চিনি বড় হয়ে গেছে স্বর্ণ। ওর প্রেমিক আছে । ওদের আমি দেখি রাস্তায় । তোমার আমার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। ও আমায় বলেনি কিছুই। বলেনা। বড্ডো অভিমানী যে। আমি ওদের বিয়েতে বাধা দেবনা। কিন্তু তার আগে চিনি কে নিজের পা এ দাঁড়াতে হবে। নয়তো, ভয় করে স্বর্ণ, এমন না হয় যে অন্য চয়নিকা কে জন্ম দেয়ার জন্য struggle করতে করতে আমার মতো ওর জীবন শেষ না হয়ে যায়। মায়েদের ,মেয়েদের স্বাধীন হওয়াটা বড্ডো জরুরী যে।
আমি আজ ক্লান্ত, একা। চিনি ওর জগতেই ব্যস্ত। কাকে আমি বলতাম বলো এসব। তাই এ চিঠি পৌঁছবেনা জেনেও তোমাকে লিখলাম।
ইতি
চিনির মা।
(হ্যা, এটাই আজ আমার পরিচয় । আমি তোমার “মেয়ে”র মা) ”
চিঠিটা ভিজে গেছে চিনির চোখের জলে। আজ তার নতুন জন্ম হলো।
বিছানায় খুলে রাখা মা এর শাড়িতে মা এর গন্ধ। ছোটবেলার “মা” হীন দুপুর গুলোর মতো মা এর শাড়ি টা জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। মা এর গন্ধ সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে ও।
“আমায় ক্ষমা করো মা। আমার জন্য তুমি সব ত্যাগ করেছ। এত বদনামের ভাগী হয়েছ। আমায় কখনো জানতে দিলেনা মা। তোমার চিনি তোমার স্বপ্ন পূরণ করবেই মা। সে দেখিয়ে দেবে সে কোনো ছেলের থেকে কম না। তার জয় কে নয়, তার জীবনযুদ্ধে জয় এর জন্য তোমায় চাই মা। শুধু তোমায়। “