— ও ঘরে ল্যান্ড ফোনটা বেজে যাচ্ছে একটু ধর না! আমার হাত জোড়া।
— হ্যাঁ যাচ্ছি।
— হ্যালো কে বলছেন?
— এতক্ষণ লাগে একটা ফোন রিসিভ করতে! সকাল সকাল চর্ব্য চোষ্য খেয়ে কি পড়ে পড়ে মোষের মতো ঘুমোচ্ছিলি? সকালে উঠে পদ্মাসন করেছিলি একবারও?
— স্যার আপনি??
— হ্যাঁ আমি। অত আকাশ থেকে পড়ার কি হল? সক্কাল হতে না হতেই তো বাংলা ভাষার প্রতি প্রীতি নিয়ে লম্বা স্টাটাস দিয়ে দিলি। তার কতটুকু অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিস শুনি! তুইও ওই দেখোনদারীদের দলে নাম লেখালি! ওরে ভালোবাসা আসে ভেতর থেকে। তাকে জিইয়ে রাখতে হয় নিজের মধ্যে। ওই ভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে দেখাতে চাইলেই বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা হয় না। কাজে করে দেখাতে হয়। পদ্মাসনের কথা কেন বললাম জানিস! আমি দূর থেকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোদের মেরুদন্ডটা দিন দিন কেমন ন্যুব্জ হয়ে যাচ্ছে। কবি কবেই বলে গেছেন, “ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা…” কোথায় সেই অদম্য প্রাণশক্তি? তোরাই তো কেমন আধমরা হয়ে গেছিস। মুখে যত বড় বড় কথা কাজের বেলায় লবডঙ্কা। এতদিন শুধুই ভস্মে ঘি ঢেলে এলাম।
— না স্যার মানে…..
— কি মানে… মানে করছিস? তোদের মধ্যে যে বীজ বপন করেছিলাম হিসেব মতো তো এতদিনে মহীরুহ হয়ে অন্যদের ছায়া দেওয়ার কথা। তবে কেন আমার শিক্ষা এমন ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে? কেন চারিদিকে এত হাহাকার? যেটুকু আলো আছে তোদের ভেতরে সেটুকু জ্বেলে অন্ধকারে থাকা মানুষগুলোকে পথ দেখাতে পারছিস না! তোদের একদিন বলেছিলাম না যে, কোনোকিছু নিয়ে আফসোস করবি না। আফসোস মানেই হতাশা আর হতাশা মানেই অন্ধকার। যা শিখে উঠতে পারিস নি সেগুলো নতুন করে শেখার চেষ্টা কর। কিন্তু যা শিখে এসেছিস সেগুলোই ছড়িয়ে দে অন্যের মাঝে। অন্যের মা যদি নিজের মায়ের থেকে বেশি স্মার্ট হয় তাহলে কি নিজের মায়ের জন্য হীনমন্যতায় ভুগবি নাকি মাকে মায়ের মতো করেই ভালো বাসবি? জানবি অন্যদের মা তাদের কাছে যতটা দামি তোর মাও তোর কাছে ততটাই দামি। তাই নিজের মাকে ভালোবাসার সাথে সাথে অন্যদের মাকেও ভালোবাসতে হবে। আপন করে নিতে হবে। অবশ্যই মায়ের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে। তবে তোর মধ্যে কিসের এত হীনমন্যতা? আশা করি যা বলতে চাইলাম বুঝতে পেরেছিস। তাই সময় নষ্ট না করে কাজে লেগে পর। দুদিনের জীবন যতটুকু পারিস কাজ করে রেখে যা। কে বলতে পারে আমার এই কথাগুলো একদিন তুই অন্যদের বলবি না! শিক্ষা যে শুধু আত্মস্থ করার নয় তাকে ছড়িয়ে দেওয়াও যে আমাদের কর্তব্য। সে যেভাবে যেমন করে পারি না কেন।
— হ্যাঁ স্যার আপনার প্রতিটা কথা আমি বুঝতে পেরেছি। আমি আর অযথা সময় নষ্ট করব না। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন স্যার আপনার দেওয়া শিক্ষার যথাযথ ব্যবহার আমি কার্য ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারিনি। আর এ ভুল হবে না স্যার। আমি বুঝতে পেরেছি আমাকে কি করতে হবে….
—কি রে আপন মনে কি বিড়বিড় করে যাচ্ছিস? কত বেলা হল ওঠ।
— তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম! কিন্তু স্যারের কথাগুলো তো এক বর্ণও মিথ্যে নয়। আচ্ছা মা, মানদা মাসি আজ কাজে এসেছে?
— হ্যাঁ, মানদা আসবে না কেন? এসেছে তো।
— একটু ডেকে দেবে! বলো আমি ডাকছি।
— পাগল একটা! কখন যে কি মাথায় চাপে। আচ্ছা ডাকছি। মানদা, একবার এঘরে একটু আসো তো!
—হ্যাঁ বৌদিমণি বলো কি হয়েছে…
— মানদা মাসি আমি ডাকছিলাম তোমাকে। আচ্ছা তুমি কদিন আগে বলছিলে না, তোমার ছেলে আর ওর কতগুলো বন্ধু সারাদিন বস্তির আশেপাশে খেলা করে পড়াশোনা করে না!
— হ্যাঁ দাদাবাবু বড্ড বেয়াদপ হচ্ছে দিন দিন। সারাদিন দস্যিপনা করে বেড়ায়। কথা শোনেনা কারোর।
— ওদের সবাইকে কাল থেকে সকালে আমাদের বাড়িতে আসতে বোলো তো। আমি আজ বেলায় গিয়ে দোকান থেকে কিছু শ্লেট পেন্সিল বই কিনে আনব। অক্ষর জ্ঞান না হলে ওরা ভালোবাসবে কি করে আমাদের মাতৃভাষাকে। আর মা, জানোতো সেদিন নবীন কাকা বলছিল যে প্রাইমারি স্কুলে একজন পার্ট টাইম টিচার লাগবে। ভাবছিলাম যতদিন না এস এস সির রেজাল্ট বের হয়ে কোথাও জয়েন করছি, ওই স্কুলেই পড়াই। তাহলে সকালে ওদের পড়িয়ে বেলায় স্কুলে ভর্তি করে দিতে পারব ওই দস্যিগুলোকে। ওরা আর এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াবে না। শিক্ষার আলো যতটুকু পায় ততই তো দেশের লাভ তাই না!
—সত্যি বাবু তুই এতকিছু ভাবিস ওদের জন্য! আজ আমি বড্ড খুশি হয়েছি রে। আর তোর বাবা আমাকে বলতে পারবে না যে, ‘ছেলেকে আদর দিয়ে বাঁদর বানাচ্ছ’। এবার একটু মানুষ হতে বলো। আমার গর্ব হচ্ছে যে আমার ছেলে প্রকৃত অর্থে মানুষ হয়েছে। বাকি টাকা উপার্জনের জন্য যতটুকু শিক্ষার প্রয়োজন জানি আমার বাবুর সেটা আছে।
— জানিনা মা, তোমার বাবু কতটা মানুষ হতে পেরেছে। তবে আজ এটুকু বুঝলাম প্রকৃত শিক্ষা কখনো বিফলে যায় না। তাই তো স্যারের শিক্ষা অবচেতনে আমার মনে থেকেই গেছিল। হয়তো আমি তার সন্ধান পাচ্ছিলাম না তাই আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার এত বছর পরেও স্বপ্নে এসে স্যার সব মনে করিয়ে দিলেন। আর কোনো আফসোস করব না স্যার। কথা দিলাম আপনার শিক্ষাকে চিরদিন জিইয়ে রাখার চেষ্টা করব নিজের মধ্যে।
— এই বাবু কি হল তোর, আপন মনে আবার কি বিড়বিড় করছিস? তোর শরীর ঠিক আছে তো!
— কিছু না মা। আমার শরীর একদম ঠিক আছে। আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। তুমি তাড়াতাড়ি টিফিন দাও। খেয়ে কমল কাকুর দোকানে যাব শ্লেট পেন্সিল বই কিনতে।
(শেষ)