উঁচু একটা লোক। মুখে দাড়ি নেই কিন্তু গোঁফ আছে। শক্তপোক্ত শরীর। নেশা শুধু সারাদিন পাখি শিকার করা। কেমন যেনো পশু পাখিদের সাথে তাঁর বসবাস।
কথা বলে খুব কম। গম্ভীর স্বভাবের। বিয়ে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে। লেখাপড়া শেষ করে আর চাকরীর খোঁজ করে নি।
তাঁর একটাই সমস্যা নারীতে এলার্জি। তাঁর বয়স যখন এক বছর পেরিয়েছে সবে মাত্র। তাঁর পর থেকেই একমাত্র মায়ের স্পর্শ ছাড়া অন্য কোনো নারীর স্পর্শ সে সহ্য করতে পারে না। হাস্যকর বটে।
বাড়ির সবচেয়ে বড় ছেলে। ছোট দুই ভাই রয়েছে। তাঁরা দুজনেই কদিন হলো বিয়ে করেছে। অবশ্য কদিন বললে ভুল হবে। মেজো ভাইয়ের একটি ছেলে সন্তানও আছে।
সে ছেলের নাম আরাশ।
এখানেই সমস্যা তাল বেতাল। আরাশের দাদীমা মনে করছে তাঁর বড় ছেলে আজাদের সাথে থাকতে থাকতে আরাশেরও নারীতে এলার্জির রোগ ধরছে।
আরাশও চাচা পাগল একরকম বলা চলে। আর আজাদের একমাত্র সঙ্গী বা বন্ধু আরাশ। বাচ্চাদের কার না ভালো লাগে? কিছুদিন হলো প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে আরাশ।
চাচার সাথে দূর দূরান্তে যেতে কোনো ভয় করে না আরাশের। আর আজাদের সবচেয়ে বেশি পছন্দের কাজ হলো দূর দূরান্তে গিয়ে পাখি শিকার করা।
আজকেও চাচা ভাতিজা রওনা দিলো অনেক দূরে। সেখানে নাকি মেলাও হচ্ছে। ঘুরে বেড়ানো হবে এক অজুহাতে। নৌকা চলছে।
আরাশ তাঁর চাচার মাথার কিছু চুল ধরে বললোঃ-
– চাচাজান।
– জ্বী চাচাজান।
– তোমার মাথার চুল দেখি সব সাদা হয়ে যাচ্ছে। তুমি কী তাহলে বুড়ো?
আজাদ আরাশের কথা শুনে মুচকি হাসলো। তারপর বললোঃ-
– হ্যাঁ চাচাজান। আমি তো বুড়োই।
– তাহলে আম্মাজান কেনো কালকে আমাকে বুড়ো বললো? দেখো দেখো আমার মাথায় একটাও সাদা চুল নেই।
– তোমার আম্মাজান তোমার সাথে মজা করেছে। তুমি তো খুব ছোট। ছোটদের আদর করে বুড়ো ডাকা হয়।
এই কথা শুনে আরাশ চাচার থেকে একটু দূরে সরে বসলো গালে হাত দিয়ে। আজাদ বুঝতে পেরেছে আরাশকে বুড়ো বলাতে সে খুব অভিমান করেছে।
আরাশের মাথায় হাত বুলিয়ে বললোঃ-
– চাচাজান। আমি তোমার আম্মাজানকে আজকে বাড়িতে গিয়ে কড়া শাসন করে আসবো যেনো তোমাকে আর বুড়ো না বলে। ঠিকাছে এবার খুশি?
– না না আমি খুশি না। আমাকে তুমিও কথা পেঁচিয়ে বুড়ো বলেছো। এখন আমাকে গান শুনাতে হবে।
আজাদের সাথে গান যায় না। তাঁর মুখ থেকে কোনোদিন ভুল করেও মনে হয় না গান বেরিয়েছে। তবুও সে আরাশকে খুশি করতে গাইলো।
আরাশ শুনে খুশি হয়ে বললোঃ-
– চাচাজান। আমিও তোমার মতো গান গাইবো। আমাকে শিখাবে?
– তাই চাচাজান? আর কী কী আমার মতো করবে?
– এই ধরো, মেয়ে মানুষের ধারে কাছেও যাবো না। সারাদিন পাখি শিকার করবো। হুম আর কোনোদিন বিয়ে করবো না।
আজাদ স্থব্দ হয়ে আছে আরাশের কথা শুনে। এটুকু ছেলে কি না এসব বলছে।
আজাদ বললোঃ-
– ঘুঘু পাখিটা খাঁচা থেকে ছেড়ে দাও।
আরাশের খুব ভালো লাগে খাঁচা থেকে পাখি ছেড়ে দিতে। সেজন্যই সে চাচার সাথে আসে। পাখিদের মুক্ত করতে সে ভালবাসে। সে অধীর আগ্রহে বসে থাকে কখন চাচাজান বলবে খাঁচার পাখি ছেড়ে দিতে।
হঠাৎ আকাশে বজ্রপাত সৃষ্টি হলো। দেখতে না দেখতে অপ্রত্যাশিতভাবে বৃষ্টি আরম্ভ হলো। মাঝি নৌকা নদীর পাশে ঠেকিয়েছেন খুব দ্রুত।
ঝড়ের মতো বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। তাঁদের কোথাও আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায় নেই। সেই সময় কেউ খুব সুরেলা কন্ঠে পিছন থেকে ডাকছেঃ-
– এইযে মাঝি ভাই। আপনারা তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসুন। খুব ঝড়।
কথাগুলো স্পষ্ট বুঝতে পারলো না আজাদ। তবে বুঝতে পারছে কোনো মেয়ে মানুষ ডাকছে। স্বেচ্ছায় আশ্রয় দিবে। আর এই মুহূর্তে তাঁদের আশ্রয় খুব দরকার।
তিন জনই ভিজে গিয়েছে। আরাশ খুব ছোট। আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে আরাশের ঠাণ্ডা লেগে যাবে। সেজন্য তাঁরা তিনজন ডাকে সারা দিলো।
বাড়ির উঠোনে গিয়ে আজাদ দেখলো একটি যুবতী মেয়ে একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ব্যস্ত হয়ে। মেয়েটার যেনো খুব চিন্তা তাঁদের নিয়ে।
বারান্দায় উঠে আশ্রয় নিলো তিনজন। বাড়িতে আর কোনো জনমানব নেই বুঝতে পারছে আজাদ। মেয়েটাও হয়তো অস্বস্তি অনুভব করছে।
আরাশের ঠাণ্ডা লেগে গেলো। কাশতে আরম্ভ করলো। আরাশের কাশি শুনে মেয়েটা আবারো বললোঃ-
– এই বৃষ্টির পানিতে ছেলেটার ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আমার কাছে দিন ঘরে নিয়ে মাথাটা মুছে দেই।
আরাশ মেয়েটার কথা শুনে মাথা নাড়ালো। আরাশেরও তাঁর চাচার মতো নারীতে এলার্জি হচ্ছে। আজাদ মেয়েটার কাছে আরাশকে দিলো।
নাহলে ছেলেটার জ্বর আসতে পারে। আরাশের চোখমুখ দেখে মেয়েটা বললোঃ-
– আচ্ছা তুমি কী আমাকে ভয় পাচ্ছো?
আরাশ মাথা নাড়ালো। মেয়েটা আবারো বললোঃ-
– তোমার নাম কী হ্যান্ডসাম?
– আরাশ।
– আঁও, অনেক সুন্দর নাম। তোমার মতো। নামটা কে রেখেছে? তোমার মা নিশ্চয়?
– না, চাচাজান।
মেয়েটা আরাশের মাথায় তোয়ালে দিয়ে পানি মুছতে মুছতে বললোঃ-
– তুমি কিন্তু বেশ সার্থপর। আমার নামটাও জিজ্ঞেস করলে না।
– আমি আমার চাচাজানের মতো হবো। আমার চাচাজান মেয়েদের ধারে কাছেও যায় না। তাঁদের সাথে কথাও বলে না।
– ওমা তাই? আচ্ছা ঠিকাছে তোমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে অবিরত। মাঝি ভাই আর আজাদ বারান্দায় বসে আছে। আরাশ চাচাজানের কাছে এসে বললোঃ-
– চাচাজান। খালামণী আমাকে হ্যান্ডসাম বললো কেনো? হ্যান্ডসাম কী?
– যারা দেখতে সব দিক থেকেই সুন্দর হয় তাঁদের হ্যান্ডসাম বলে। কিন্তু উনি তোমার খালামণী কবে থেকে?
– বুঝো না কেনো। খালামণী বললে তো আর আমার পিছনে লাইন মারতে পারবে না। তখন আমি তাঁর ছেলের মতো হয়ে যাবো না?
আজাদ পুরো আশ্চর্য হয়ে গেলো। মুচকি হাসলো। কোনো উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললোঃ-
– তোমার খালামণীর কাছে যাও তাহলে এখন। বারান্দায় খুব ঠাণ্ডা বাতাস। তোমার জ্বর আসবে।
আরাশ আবারো ঘরে ঢুকতেই মেয়েটা বললোঃ-
– তুমি তো বেশ পাজি। আমার কথা তোমার চাচাজানের কাছে কী বলেছো?
– একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম।
– আচ্ছা, তুমি এক কাজ করো, বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পরো। বৃষ্টি আজকে থামবে বলে মনে হয় না।
– দাঁড়ান আমি চাচাজানের কাছে জিজ্ঞেস করে আসি। আচ্ছা খালামণী আপনার নাম কী?
– ওমা! খালামণী? খালামণীর নাম ইলমা।
আরাশ আজাদের কাছ থেকে অনুমতি শুয়ে পরলো। কিন্তু ঘুম আসছে না। বাইরে বৃষ্টির গতি বেড়েই চলেছে।
মোমবাতি জ্বালানো হয়েছিলো বারান্দায় কিন্তু বাতাসের কারণে বারবার নিভে যায়। সে জন্য অন্ধকারেই মাঝি ভাই আর আজাদ বাইরে বসে আছে।
অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করেছে ইলমা আরাশের সাথে। তাঁর চাচার গল্প শুনে কেমন যেনো তাঁর প্রতি ভালো লাগা সৃষ্টি হলো ইলমার মনে।
জানালার ফাঁক দিয়ে অন্ধাকারের মধ্যে আজাদের মুখটা চুপি চুপি দেখতে অদ্ভুত ভালা লাগা কাজ করছে। এই ভালো লাগার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
ইলমা সেটা ভেবেও দুঃখ পাচ্ছে। সকাল হলো। ফজরের আযানের পরপর ঝড় থেমেছে। সারা রাত জেগে ছিলো আজাদ আর মাঝি ভাই।
ইলমাও ঘুমুতে চেষ্টা করে নি। আরাশের ভাবতেই খারাপ লাগছে আর কোনোদিন ইলমার সাথে দেখা হবে না।
ইলমারও আরাশকে ছাড়তে একদম ইচ্ছে হচ্ছে না। আরাশ যেনো তাঁর শত জনমের আপন। নৌকার কাছে এসে পৌঁছেছে তিন জন।
ইলমা পিছনে ফিরে সেই কখন থেকে তাকিয়ে আছে। একটা ঝড় তাঁর মন উথালপাতাল করে দিয়েছে। একটু একটু করে মাঝি বাড়ির দিকে নৌকা ঘুরাচ্ছে।
আরাশের মন খারাপের রাস্তা যেনো আরো চওড়া হচ্ছে। আজাদ খুব ভালো করে তা বুঝতে পারছে। কিন্তু তাঁর যে কিছু করার নেই।
ক্ষণিকের জন্য কারো বাড়িতে আশ্রয় নিলেই কী আর কেউ আপন হয়ে যায়? কিন্তু মন এই কথাটা মানছে না। আরাশকে নিয়ে বাড়ির লোকের কোনো চিন্তা নেই।
জানে আজাদের সঙ্গে থাকলে কোনো ঝড়ই আরাশকে কিছু করতে পারবে না। কিন্তু ফুটফুটে ছেলেটার হঠাৎ খুব মন খারাপ হলো। কারো সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না। আজাদও চিন্তিত আরাশকে নিয়ে।
এভাবে চলতে থাকলে ছেলেটা একরকম বোবাই হয়ে যাবে। কিছুদিন কেটে গেলো। আজাদের পাখি শিকার করাতে মন নেই। মন সেই অচেনা অজানা মেয়েটার হাসির কাছে বন্ধি। কোনো মেয়েকে তাঁর ভালো লাগবে সে স্বপ্নেও ভাবে নি। কোনো কাজেই আর মন বসানো যাচ্ছে না।
এরকম একটা মেয়েকে ঘরের বৌ করে তুললে ভালই হবে। আজাদ নিজেও জানে না কেনো এসব চিন্তা করছে। আরাশ আজকে বায়না ধরেছে সেই খালামণীকে সে দেখতে যাবে।
আজাদ অনেকবার ভেবেছে এটা ঠিক না। কিন্তু মনও চাচ্ছে। প্রাণটা যেনো একটু শান্তি পেতো তাঁকে একবার নয়নে জোড়ালে।
একমাস পার হয়ে গিয়েছে প্রায়। চাচা ভাতিজা আবার রওনা দিলো সেই ঝড়ের সময় আশ্রয় নেয়া বাড়ির উদ্দেশ্যে। এ কেমন মায়া? তাঁরা বুঝতে পারছে না। ইলমাও কী ভেবে যেনে ঘাটের কাছে এসে পথ চেয়ে থাকে। আরাশ আসবে। সেই মানুষটা আসবে।
কিন্তু দিন যায়, আসে না। আজকে ইলমার বিয়ে। তাঁর মন কাঁদছে। তাঁর মনের অদ্ভুত ভালো লাগার কোনো মূল্য নেই।
জানে না সে আজাদের ঠিকানা। তাছাড়া জানলেই বা কী? চাচা ভাতিজা ইলমার বাড়ির সামনে এসে ঘাটে দাঁড়াতেই বুঝলো এই বাড়িতে কারো বিয়ে হচ্ছে।
আজাদের মন মোচড় দিয়ে উঠলো। কে যেনো বুকে তীর মেরেছে। সামনে এগুতেই শানাই এর শব্দ! বাড়ির উঠোনে যেতেই কয়েক জন লোক এসে স্বাগত জানালো। তাঁরা হয়তো ভেবেছে এরা দুজন বর যাত্রী। আজাদ একজনকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পায় আজকে ইলমারই বিয়ে! ইলমার মা বাবা ছোট থাকতে মারা যায়। চাচার কাছেই মানুষ। এই মুহূর্তে ইলমার সাথে দেখা করা খুব কঠিন বিষয়। কিন্তু আরাশ মানছেই না।
সে খালামণীর সাথে দেখা করবে। ছোট ছেলের কান্নাকাটি দেখে এক লোক ইলমার কাছে আরাশকে নিয়ে গেলো। আজাদ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটা সহ্য হচ্ছে না আজাদের। ইলমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তাঁর চোখের সামনে।
কেনো তাঁর খারাপ লাগছে? বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছে। আরাশকে দেখে ইলমা অবাক হলো। মুখের কথা হারিয়ে ফেলেছে।
এমন ভাবে জড়িয়ে কান্না করছে যে ইলমাকে সাজানোর জন্য যারা এসেছিলো তাঁরা কক্ষত্যাগ করেছে।
কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে ইলমা বললোঃ-
– আজকে তো কোনো ঝড় নেই। তাহলে হঠাৎ কেনো আসলে?
– খুব মন খারাপ হচ্ছিলো তোমার জন্য। চাচাজানকে নিয়ে তাই চলে আসলাম।
আরাশের কথা শুনে ইলমা হেসে দিলো। তারপর বললোঃ-
– আমার জন্য মন খারাপ করার কী আছে? আমি তোমার কে?
– জানি না।
বলে আরাশ চুপ হয়ে থাকলো। ইলমা এখন কী করবে বুঝতে পারছে না। আরাশ আবারো বললোঃ-
– আচ্ছা খালামণী, তুমি এভাবে বৌ সেজেছো কেনো? তোমার কী আজকে বিয়ে? ইলমা উত্তর দিতে পারলো না। তাঁর আগেই বাইরে হৈ চৈ আরম্ভ হলো।
পর্যাপ্ত পরিমাণে যৌতুক নে দেয়ায় পাত্রের বাবা তাঁর ছেলেকে এই বিয়ে করাবেন না। খবরটা শুনে ইলমা খুশি হলো। অনেক খুশি। যেনো আরেকবার পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে। কিন্তু ইলমার চাচা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। একটা কলংকের দাগ লেগে গেলো ইলমার গায়ে।
আবার মেয়েটার বিয়ে হবে কী না তা ভেবে রীতিমতো কান্না করে চলেছে ইলমার চাচা। আজাদ ভদ্র লোকের কান্না থামালো।
নিজের পরিচয় দিয়ে বললোঃ-
– আমি ইলমাকে বিয়ে করবো। যদি আপনাদের কোনো আপত্তি না থাকে। ইলমার বাবা আজাদের বংশের ব্যাপারে জানেন।
তাছাড়া আজাদ বিয়ে করেছে এর থেকে খুশির সংবাদ আর কিছু হতে পারে না তাঁর পরিবারের কাছে। অদ্ভুত ভাবে বিয়েটা হলো।
ইমার খুশির যেনো শেষ নেই। এই ছোট্ট ছেলেটাকে সে প্রতিদিন কাছ থেকে দেখবে। তাঁর সাথে খেলা করবে। এর থেকে আনন্দের কিছু আর হয় না।
নৌকা চললো আজাদদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আরাশ বারবার ইলমার আঁচল টান দিয়ে শরীরের চাদর বানাচ্ছে। কারণটা খুব স্পষ্ট। শীত এসেছে। খুব ভালোভাবে ভালো সময়ে প্রচণ্ড শীত এসেছে। আজাদ চিন্তায় আছে। গভীর চিন্তায়। শরীর লোম সব দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েদের স্পর্শ সে সহ্য করতে পারে না। একদম অসহ্য লাগে। তবুও সে আজ থেকে একজনের স্বামী। সুখে দুঃখে তাঁর পাশে থাকতে হবে সারাজীবন। সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব।
আরাশ ইলমার কুলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছে। মাঝি নৌকা চালাচ্ছে। আজাদ এক-পা দু-পা করে ইলমার সামনে এসে বসলো। ইলমার যেনো হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসছে। লজ্জায় ঘোমটাটা আরো লম্বা টানলো। ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। তিনজন একসাথে থাকলে বাতস কম লাগবে গায়ে। আজাদ ইলমার পাশে বসলো। কোনো কথা নেই। ইলমার ইচ্ছে হচ্ছে লোকটার কাঁধে একটু মাথা রাখতে কিন্তু মাঝি ভাইয়ের জন্য লজ্জা লাগছে। বাড়ির কাছে এসে পৌঁছালো নৌকা।
আরাশকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো আজাদ। আরাশ উঠেই বাড়ির উপর এক দৌড়। আজাদের মনে মনে ভয় হচ্ছে। যদি নতুন বৌকে মেনে না নেয় তাহলে অনেক বড় অসম্মান হয়ে যাবে। কিন্তু ঘটলো বিপরীত। আরাশের মা যেনো খুশিতে আত্মহারা। যে ছেলে মেয়েদের থেকে একশো হাত দূরে থেকে এসেছে প্রায় বত্রিশ বছর ধরে।
সে ছেলে যে বিয়ে করেছে তাতেই অনেক। সবাই ধুমধাম করে বৌকে বরণ করলো। এবার যেনো ইলমার খুশির অন্ত নেই। রাত হয়ে পরেছে। আজকে আজাদের বাসর রাত। বাড়ির পিছনে তাঁর পাখিদের রাখার জায়গা। অর্ধেক রাত পর্যন্ত সে পাখিদের সাথেই কাটালো। তারপর বাসর ঘরে যখন ঢুকলো, কিছুটা অবাক হলো।
আজকে রাতে ইলমা গায়ে কম্বল দিয়ে গভীর ঘুমে। আজাদ ভাবলো শীতটা হয়তো বেশিই পরেছে। দরজায় খিল দিয়ে ইলমার পাশে শুয়ে পরলো। না কম্বল সে গায়ে দেয় নি। ফযরের আযান দিয়েছে। আজাদের উঠতে হবে। কিন্তু শীতের পরিমাণ এতো বেশিই যে আর উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু এ কী? আজাদ খেয়ালই করে নি যে তাঁর গায়ে কম্বলই নেই। তার চেয়ে বড় কথা ইলমার গায়েও নেই! আজাদের হাতদুটো ইলমার বাহুডোরে বন্ধি। আজাদ বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। ইলমা চোখ খুলে বললোঃ-
– হাপাচ্ছেন কেনো? কিছু বলবেন?
– না, আসলে আপনার চুলগুলো খুব সুন্দর।
ইলমা হেসে বললোঃ-
– আর কিছু সুন্দর না?
– না চোখ দুটোও ভালো।
– আর?
– আর কী?
– আচ্ছা থাকুক। আর কিছু বলতে হবে না। তবুও তো বোবা মানুষটা কথা বললো।
আজাদ একটু চুপ করে থেকে বললোঃ-
– আমি বোবা না।
ইলমা হাসছে। মানুষের হাত পা এতো শক্ত হয় তাঁর জানা ছিলো না। আজাদ কেনো যেনো কাঁপছে।
মেয়েদের স্পর্শ তাঁর গায়ে যেনো চারশো চল্লিশ ভোল্টের কারেন্ট। ইমা ঠোঁট মুখ বাঁকা করে বললোঃ-
– সামান্য হাত ধরলাম আর এতেই এতো কাঁপাকাঁপি? জড়িয়ে ধরলে তো মরেই যাবেন।
বলেই ইলমা হেসে দিলো। একটু একটু করে তাঁদের কথা বাড়বে।
একসময় খুব কাছাকাছি থাকবে দুজনে। ভালই লাগছে আজাদের । ঘরে লক্ষ্মী বৌ আর শীতের ছোঁয়ায়। আজাদের চুপ করা দেখে ইলমা বললোঃ-
– এতো কিপটা কেনো আপনি? সামান্য কথা বলতেও যেনো উনার খুব সমস্যা হুহ।