ইশার আজ কলেজে প্রথমদিন৷ স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশীই টেনশন হচ্ছে আজ ওর৷ সাথে ভয়ও পাচ্ছে৷ আর পাবে নাই বা কেন৷ ভরতির দিন ইউনিয়নের ছেলেদের যে রূপ ও দেখেছে তাতে ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক৷ বাবার বয়সি বয়স্ক মানুষদেরও রেহাই দিচ্ছিল না৷ তাদের ওপরও হাত তুলতে ওদের এতটুকুও বিবেকে বাঁধছিল না৷ এসব দেখে তো ইশা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল৷ ওর শুধু মনে হচ্ছে আজ কী হবে কে জানে৷ তার উপর এত বড়ো বিল্ডিং-এ ওর ক্লাসরুম কোথায় সেটাই বুঝতে পারছে না৷ ভরতির দিন এতটাই নার্ভাস ছিল যে ঠিক করে খেয়াল পর্যন্ত করেনি কোথায় কী আছে৷ আর কাউকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেও পারছে না৷ এমন সময় ও লক্ষ্য করে ওর দিকে একটা ছেলে এগিয়ে আসছে৷ ছেলেটা ওর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল- কোন ডিপার্টমেন্ট তোমার? তুমি তো মনে হয় নতুন ভরতি হয়েছ এই কলেজে৷ ইশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আসতে আসতে বলল- হ্যাঁ, আমি নতুন ভরতি হয়েছি এই কলেজে৷ মাইক্রোবায়োলজি অনার্স৷
-ওহ আচ্ছা৷ তোমার ক্লাসরুম চারতলায়৷ এখান থেকে সোজা গিয়ে ডানদিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাও৷ কথাটা শেষ করেই ইশার প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই ছেলেটা গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল৷ ইশা চুপচাপ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে ওর ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়াল৷ প্রথমদিন সেরকমভাবে পড়াশুনা হল না৷ ওদের ডিপার্টমেন্টে তিনজন শিক্ষক আর দুইজন শিক্ষিকা আছে৷ আজকে সব শিক্ষক-শিক্ষিকারা সবার সাথে কথা বলে জানতে চাইল কে কোন স্কুল থেকে এসেছে৷ তারপর সবাই যে যার মতো বেরিয়ে গেল৷ ইশার বেশ ভালই লাগল৷ এখন আর ওর ভয় টেনশন দুটোই নেই৷ কিন্তু মনের ভিতর একটা বিষয়ে খুব খচখচ করছে৷ যে ছেলেটা ওকে সাহায্য করল তাকে তো ধন্যবাদটাও দেওয়া হল না৷ আবার কখনো দেখা হবে কিনা কে জানে৷
যদি দেখা হয় তাহলে ভাল হয়৷ ওর এই ইচ্ছেটা যে এত তাড়াতাড়ি পূরণ হবে ও ভাবতেই পারেনি৷ পরেরদিন কলেজে ঢোকার সময় ওই ছেলেটাকে কলেজের গেটের সামনে দেখতে পেল৷ ও ছেলেটাকে দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল৷ একটা অচেনা ছেলের সাথে নিজে থেকে কীভাবে কথা বলবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না৷ এমন সময় হঠাৎ করে ছেলেটা ওর সামনে এসে ওকে জিজ্ঞেস করল- কী ব্যাপার আজকেও ডিপার্টমেন্ট খুঁজে পাচ্ছ না? ছেলেটার কথায় ওর হাসি পেলেও ও কিছু বলল না৷ শুধু কালকের জন্যধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেল৷ এরপর থেকে রোজই ওদের দেখা হত কিন্তু কেউই কোনোদিন নিজে থেকে এসে কথা বলেনি৷ একদিন কলেজে এসে ইশা জানতে পারল আর কিছুদিন পর কলেজে ফ্রেশার্স তাই এই কদিন ক্লাসের পর রিহার্সাল হবে৷ যারা যারা অংশগ্রহণ করবে তারা যেন ক্যাণ্টিনে দেখা করে সিনিয়রদের সাথে৷ ইশা ভাল নাচতে পারে আর ও নাচ শেখে তাই ও নাচ করবে ঠিক করল৷ ওর কয়েকজন বান্ধবী গান করবে৷ তাই ক্লাস শেষের পর ওরা ক্যাণ্টিনে গেল৷ ওখানে গিয়ে সেই ছেলেটাকে দেখতে পেল৷ ওখানেই ও জানতে পারল ছেলেটা বায়োকেমিস্ট্রি অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র৷ ওর নাম নীলাদ্রি সেন৷ ও এই অনুষ্ঠানে গান করবে৷
নীলাদ্রির সাথে কথা বলে ইশার ভালই লাগল৷ সেদিনের পর থেকে রোজই ওদের রিহার্সাল হত৷ ইশাও অপেক্ষা করত কখন ওর নীলাদ্রির সাথে দেখা হবে আর সারাদিন কী কী হয়েছে সব নীলাদ্রিকে বলবে৷ নীলাদ্রিরও ওর বকবক শুনতে ভাল লাগত৷ যেদিন ইশা চুপচাপ থাকত সেদিন নীলাদ্রি পাগল করে দিত ইশার কিছু হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করে৷ ওদের এই দুষ্টু-মিষ্টি বন্ধুত্বটা বেশ চলছিল৷ দেখতে দেখতে অনুষ্ঠানের দিন চলে এল৷ সকাল থেকে সবাই খুব ব্যস্ত৷ যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু হল৷ প্রথমেই নীলাদ্রির একার একটা গান তারপর একটা গান ইশার বান্ধবীরদের সাথে৷ এরপর ইশার নাচ আর নীলাদ্রির গান দিয়ে প্রথম বর্ষ এবং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের পালা শেষ৷ এদের পর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের পালা৷ নীলাদ্রি ভেবেছিল ওদের অনুষ্ঠানের শেষে ইশাকে ওর মনের কথা বলবে৷ তাই অনুষ্ঠান শেষে ইশাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলেছে৷ ইশা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে কিন্তু নীলাদ্রি আসছে না৷ অনেকবার ফোন করেছে কিন্তু নীলাদ্রি ধরেনি৷ ভিতরের আওয়াজের জন্য মনে হয় শুনতে পাচ্ছে না- ইশা বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব ভাবছিল ঠিক তখন ওর বান্ধবী টিনা এসে ওকে জিজ্ঞেস করল- কী রে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? অনেক রাত হয়েছে এবার বাড়ি চল৷
-হ্যাঁ, যাব৷ নীলাদ্রি আমাকে দাঁড়াতে বলল তাই…
-ওহ তাই বল৷ কিন্তু তোর ও (নীলাদ্রি) তো এত তাড়াতাড়ি আসবে বলে মনে হয় না৷
-কেন রে টিনা? এরকম কেন বলছিস?
-আরে ও তো আজকে গান করে পুরো বিখ্যাত হয়ে গেছে৷ সবাই ওর অটোগ্রাফ চাইছে, ওর সাথে ফটো তুলছে৷ ওর কী তোর কথা এখন মনে আছে? টিনার কথাগুলো শুনে মুখে কিছু না বললেও ওর মনে মনে বেশ রাগ হল৷ এমন সময় ওদের ক্লাসের অভিক এসে ওর নাচের প্রশংসা করায় ও তখনকার মতো টিনার কথাগুলো ভুলে গেল৷ অভিক ইশাকে বাড়ি ছেড়ে দেবে বলায় ইশা রাজি হয়ে যায়৷ একেই অনেক রাত হয়ে গেছে তার উপর অভিকও ওদের বাড়ির কাছেই থাকে তাই ইশা আর বারণ করল না৷ টিনাও চলে গেল৷ নীলাদ্রি বাইরে এসে কাউকে না পেয়ে ইশাকে ফোন করবে বলে ফোন বার করে দেখে ইশার অনেকগুলো মিসডকল রয়েছে৷ ইস্ ও নিশ্চয় অনেকবার ফোন করে আমাকে না পেয়ে বাড়ি চলে গেছে- মনে মনে এইসব ভাবতে ভাবতে ইশাকে ফোন করল৷ কিন্তু ইশা ফোন ধরল না৷ কালকে তো কলেজে দেখা হবে এই ভেবে নীলাদ্রি বাড়ি চলে গেল৷ পরেরদিন ইশা কলেজ এলেও নীলাদ্রির সাথে কথা বলল না৷ নীলাদ্রি বুঝতে পারে ইশার কালকের জন্য রাগ হয়েছে৷ ও অনেকবার ইশার সাথে কথা বলতে চায় কিন্তু ইশা ওকে এড়িয়ে চলে যায়৷ এইভাবে দেখতে দেখতে একমাস পার হয়ে গেছে৷
এই একমাসে নীলাদ্রি নানাভাবে ইশার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু ইশার রাগ কিছুতেই কমেনি৷ এমনকি ইশার বান্ধবী টিনার সাথে মিথ্যে প্রেমের নাটক করেও কোনো লাভ হয়নি৷ ওদের রাগারাগির পর্ব যেন শেষ হয় না৷ তা নীলাদ্রি ঠিক করেছে দোলের আগে ওদের কলেজে যেদিন প্রি-হোলি পালন হবে সেদিন ইশা না চাইলেও ও জোর করে ইশাকে রঙ লাগিয়ে দেবে আর নিজের মনের কথা বলে দেবে৷ এরমধ্যে একদিন টিনা ইশাকে বলল- এই তুই এতো ন্যাকামো করছিস কেন বল তো৷ নিজেও তো মনে মনে সারাদিন নীলাদ্রিদার নাম জপ করিস তাহলে ওর সাথে কথা বলতে কী প্রবলেম তোর৷ নীলাদ্রিদা এতবার তোর কাছে এসে ক্ষমা চাইছে তাও তোর রাগ কমছে না৷ এই কথা শুনে ইশা মুচকি হেসে টিনাকে বলে- আমি তো ওর উপর রাগ করিনি৷ আমি তো জানতামই না ও আমাকে এতটা ভালবাসে৷ ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে টিনা বলে- এখন তো জেনে গেছিস এবার ওর সাথে কথা বল৷ না হলে ওর সাথে প্রেমের নাটক করতে গিয়ে আমার না ব্রেকআপ হয়ে যায়৷
-কেন রে ওটা তো একটা মিথ্যে প্রেম৷ আমি তো জানি৷
-তুই জানিস৷ রহিদ তো আর জানে না৷ ও আমাকে ভুল বুঝছে৷
-আচ্ছা ঠিক আছে আমি ওকে বলে দেব৷ আর তো কটা দিনের ব্যাপার তারপর তো সব ঠিক হয়ে যাবে৷
-তার মানে তুই দোলের দিনের প্ল্যানটা জানিস ?
-হ্যাঁ, আমাকে অভিক বলেছে৷ আর তুই চিন্তা করিস না আমি কাউকে বুঝতে দেব না৷ কিন্তু সময়টা বলে দিস৷ ও আমাকে সেটা বলতে পারেনি৷
-খুব শখ না৷ যা বলব না৷
-বলিস না৷ তোর নীলাদ্রিদা বলতে বললে তো বলবি৷ এই বলে ইশা কলেজ থেকে বেড়িয়ে গেল৷ আজকে ওর পড়া নেই তাই সোজা বাড়ি যাওয়ার জন্য বাসে উঠে গেল৷ দেখতে দেখতে সেই দিনটা এসে গেল যে দিনটার জন্য ও আর নীলাদ্রি দুজনই অপেক্ষা করেছিল৷ নীলাদ্রি সকাল থেকে খুব ব্যস্ত৷ অনেকবার টিনাকে দিয়ে ইশাকে ফোন করে জেনে নিয়েছে ও আর কতক্ষণে পোঁছাবে৷ নীলাদ্রি আজকে বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবী পড়েছে৷ ইশাও আজকে বাসন্তী রঙের শাড়ী পড়েছে৷ টিনার সাথে কথা বলতে বলতে নীলাদ্রি খেয়াল করে গেট দিয়ে ইশা ঢুকছে৷ ওকে দেখে নীলাদ্রি তো চোখ ফেরাতেই পারছে না৷ ইশা এসেই ওর কিছু বন্ধুদের সাথে কথা বলতে লাগল৷ এবার আর নীলাদ্রি নিজের রাগটা কনট্রোল করতে না পেরে আবিরের থালা থেকে দু হাতে আবির নিয়ে ইশার গালে মাখিয়ে দিয়ে বলল- ইশা তুমি আমার জীবন সাথী হবে ? আমি তোমাকে খুব ভালবাসি৷ নীলাদ্রির কথা শুনে আশেপাশের সবাই খুশিতে একসাথে হাততালি দিয়ে উঠল৷ তারপর সবাই সবার পছন্দের মানুষকে রঙ লাগাতে লাগল৷ নীলাদ্রি এবার ইশার কাছে এসে বলল- হে ভগবান, আমার গালটা মনে হয় ফাঁকা থেকে যাবে৷ এমন সময় ইশাও ওর গালে অনেকটা আবির লাগিয়ে বলল- তোমার প্রার্থণা ভগবান শুনেছে৷ এবার খুশি তো? ভীষণ খুশি বলেই নীলাদ্রি গান শুরু করল-
“ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান-
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান-
আমার আপনহারা প্রাণ আমার বাঁধন-ছেড়া প্রাণ৷৷
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান-”
ওর গান শেষ হলে সবাই মিলে ইশাকেও গান করতে বলল৷ ইশা বলল- আমি গান গাইব কিন্তু আমার সাথে সবাইকে গাইতে হবে৷ সবাই ওর কথায় রাজি হয়ে গেল৷ ইশাও গান শুরু করল-
“বাতাসে বহিছে প্রেম/ নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিল পিছে/ বসন্ত এসে গেছে
মধুর অমৃত বাণী/ বেলা গেল সহজেই
মরমে উঠিল বাজি/ বসন্ত এসে গেছে
থাক তব ভুবনের/ ধুলি মাখা চরণে
মাথা নত করে রব…
বসন্ত এসে গেছে
বসন্ত এসে গেছে৷৷”
সবাই ইশার গান শুনে ভীষণ খুশি হয়েছে৷ নীলাদ্রি এবার ভাবল এখানে আর বেশীক্ষণ থাকলে ওদের আজকের দিনটাই একসাথে কাটানো হবে না৷ তাই ও ইশার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে ওর বাইকে বসিয়ে দুজনে বেরিয়ে গেল৷ তারপর সারাদিন দুজনে খুব মজা করে কাটালো৷ সন্ধেবেলা নীলাদ্রি ইশাকে বাড়ি পৌছে দিয়ে নিজের বাড়ি চলে গেল৷ নীলাদ্রিও আজ খুব খুশি৷ ওর মনের মানুষকে আজ নিজের করে পেয়েছে৷
হঠাৎ ঢং ঢং আওয়াজে নীলাদ্রি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত বারোটা বেজে গেছে৷ তাই মেয়েকে বলে- নাও মামণি, এবার চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়ো৷ অনেক রাত হয়েছে৷ কালকে আবার তাড়াতাড়ি উঠতে হবে৷
-গল্পটা তো পুরোটা শোনা হল না বাপি৷ এরপর কী হল তুমি বলবে না ?
-আবার একদিন বলব বাকীটা৷
-ঠিক আছে বাপি৷ গুড নাইট৷ মেয়ের গায়ে চাদরটা ভাল করে দিয়ে নীলাদ্রি বিছানা থেকে নেমে ইশার ছবির সামনে এসে দাঁড়াল৷ নিজের মনেই বলে উঠল-এতক্ষণ ধরে মেয়েকে তোমার কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিল তুমি যেন আমার সামনেই আছ৷ ও পুরো তোমার মতোই৷ সারাক্ষণ বকবক করে আমাকে পাগল করে দেয়৷ কালকে দোল৷ এরকম একটা দোলেই তোমাকে নিজের করে পেয়েছিলাম৷ তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ছে৷ তুমি কেন যে আমাদেরকে একা করে দিয়ে চলে গেলে কথাটা বলেই নীলাদ্রির চোখে জল চলে এল৷ পরেরদিন সকাল থেকে নীলাশা খুব ব্যস্ত৷ ওর অনেক বন্ধু আজকে আসবে৷ ওরা সবাই মিলে রঙ খেলবে৷ নীলাশা আজকে হঠাৎ এক অদ্ভুত বায়না ধরেছে৷ নীলাদ্রিকে আজ গান গাইতে হবে৷ কিন্তু ওর আজকে গান গাইতে একটুকুও ইচ্ছে নেই৷ মেয়েকে কিছুতেই বুঝিয়ে পারছে না৷ শেষমেশ অনেক বুঝিয়ে ওকে নীচে পাঠানো গেছে৷ নীলাদ্রি হাতে করে একটু আবির নিয়ে ইশার ছবিতে দিল৷ আজ ওর ভীষণ ইশার কথা মনে পড়ছে৷ এরপর চুপচাপ চেয়ারে বসে ও গুনগুন করে গান গাইছিল৷
“দিন রজনী কত অমৃতরস…”
পরিচিত ধীর পায়ের চলনে নীলাদ্রির গুনগুনানিতে ছেদ পড়ে৷ শব্দটা যেন ইতস্তত করেও শেষমেশ ওর পিঠ ঘেঁষে দাঁড়ালো,
আস…আসবো?
-এসেই তো পড়েছো৷
ঘাড় না ফিরিয়েই নির্বিকার জবাব দেয় নীলাদ্রি৷
-দাদা৷
আগন্তুকের স্বরটা কেমন কাঁদো কাঁদো ঠেকল!
এবার খানিকটা বাধ্য হয়েই নীলাদ্রিকে মুখ ফেরাতে হলো… দেখল টিনা দাঁড়িয়ে আছে৷ সেই কলেজ জীবন থেকেই টিনা নীলাদ্রিকে দাদার মতো শ্রদ্ধা করে৷ নীলাদ্রিও টিনাকে বোনের মতোই ভালবাসে৷ অনেকদিন পর নীলাদ্রিকে দেখে টিনা বলল- একি অবস্থা করেছ নিজের৷ ইশা তোমাকে দেখে রেগে যায় না? প্রশ্নটা করেই টিনার চোখ যায় দেয়ালে টাঙানো ইশার ছবির দিকে৷ যেটাতে নীলাদ্রি আজকে সকালেই একটা নতুন মালা পড়িয়েছে৷ এতদিন পর এখানে এসে এরকম কিছু আশাই করেনি টিনা৷ ওর নিজের সমস্ত দুঃখ এক ঝটকায় ভুলে গিয়ে নীলাদ্রিকে জিজ্ঞেস করল- কী করে হলো এসব? কবে হলো? তুমি আমাকে একবারও খবর দাওনি কেন?
-আরে আগে তুই বস৷ এতগুলো প্রশ্ন একবারে করলে উওর দেব কী করে৷ তুই এতদিন এখানে ছিলিস না তাই আর তোকে জানানো হয়নি৷ এই একবছর আগে এরকমই একটা দিনে ও আমাদেরকে ছেড়ে চলে যায়৷ ওসব কথা এখন থাক৷ তোর খবর বল৷ এই মুহুর্তে ওর রহিদের সাথে ডিভোর্সের কথাটা বলতে ভাল লাগল না৷ তাই ও চুপ করেই রইল৷ এমন সময় নীলাশা নীচ থেকে উপরে এল ওর বাবাকে ডাকতে৷ ওকে দেখে টিনার আর বুঝতে বাকী নেই যে ও ইশার মেয়ে৷ নীলাশা এসেই ওর বায়নার কথা বলল৷ টিনাও শুনে বলল- হ্যাঁ, নীলাদ্রিদা অনেকদিন তোমার গান শুনিনি৷ আজকে একটা গান করো৷
-টিনা তুইও একথা বলছিস৷ তুই বুঝতে পারছিস না কেন আমি গান গাইব না বলছি৷ আমার সব গান হারিয়ে গেছে৷
-নাহ, তুমি হারিয়ে দিচ্ছ তোমার গানকে৷ তুমি জানো না তোমার গানেই যে ইশা বেঁচে থাকে৷ তুমি গান করো৷ আর কারোর জন্য নয় তুমি তোমার ছোট্ট ইশার জন্য গান করো৷ প্লীজ, গান করো৷ টিনার সাথে নীলাশাও বলতে শুরু করেছে৷ এবার নীলাদ্রি রাজি না হয়ে পারল না৷ ও ওদের সাথে নীচে এল৷ সবাই গোল হয়ে বসেছে ওর গান শোনার জন্য৷ নীলাদ্রি আজ অনেকদিন পর গান ধরেছে-
“আজি দখিন-দুয়ার খোলা-
এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো৷
দিব হৃদয়দোলায় দোলা
এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো৷৷
নব শ্যামল শোভন রথে এসো বকুলবিছানো পথে,
এসো বাজায়ে ব্যাকুল বেণু মেখে পিয়ালফুলের রেণু,
এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো৷৷
এসো ঘনপল্লবপুঞ্জে এসো হে, এসো হে, এসো হে৷
এসো বনমল্লিকাকুঞ্জে…”
(সমাপ্ত)