” বাবা… ও বাবা ! এটা কিসের মূর্তি গড়ছো গো ? ”
– চৌকির ওপর তাতাই কখন এসে বসেছে অবিনাশ এক মনে মূর্তি গড়তে গড়তে তা খেয়ালই করেনি। অবিনাশ হেঁসে বললো ,
” এটা রাম-সীতার মূর্তি গড়ছিরে বাবা ! ”
তাতাই অবাক চোখে চেয়ে রইলো মূর্তির দিকে , বললো –
” বাবা রাম-সীতা কে ? ”
অবিনাশ একমনে মূর্তিটা দেখছিলো কোনো খুঁত রয়েছে কিনা । অন্যমনস্ক ভাবেই বললো , ” একটু পরে বলছি । ”
তাতাই এবার বাবার পাশে এসে দাঁড়ালো ।
” এরা কি ঠাকুর বাবা ? মায়ের ঠাকুরের তাকে তো এদের মূর্তি নেই ! ”
অবিনাশ তাতাইকে কোলে নিয়ে বললো ,
” চল রাত হয়ে গেছে এবার খেয়ে নিয়ে ঘুমোতে হবে । নয়তো তোর মা কিন্তু এবার রেগে যাবে ! ”
তাতাই আবার বলে ,
” বললে না তো এরা কি ঠাকুর ? ”
অবিনাশ কিছু একটা ভাবলো মনে মনে । তারপর বললো ,
” হ্যাঁ ঠাকুর । তোর মায়ের ঠাকুরের তাকে লক্ষ্মী- নারায়ণ এর মূর্তিটা দেখেছিস তো ! লক্ষ্মী- নারায়ণ এর আর একটা নাম হলো রাম – সীতা ! বুজলি ? ”
তাতাই কি বুজলো কে জানে ! কিন্তু বাবার কথা শুনে ঘাড়টা ওপর-নীচে দুবার নাড়িয়ে বুজিয়ে দিলো সে অনেক কিছু বুজেছে !
অবিনাশকে খেতে দিয়ে স্ত্রী চৈতি চার বছরের ছেলে তাতাইকে খাওয়াতে বসে। একটুকরো রুটি নিয়ে তরকারি মাখিয়ে বলে , ” হাঁ করো সোনা ! ”
তাতাই কোল থেকে উঠে ছুটে চলে যায়।
চৈতি বলে , ” দুস্টুমি করে না বাবাই ! খেয়ে নাও ! ”
তাতাই বলে , ” না , খাবো না ! আগে বলো পুকলুর মতো আমাকেও একটা ভালুক পুতুল কিনে দেবে ! ”
চৈতি বলে , ” ভালো ছেলেরা সবসময় বায়না করেনা ! এসো খেয়ে নাও …. এবার কিন্তু মার খাবি তাতাই আমার হাতে!”
অবিনাশ হাত ধুয়ে এসে তাতাইকে পেছন থেকে ধরে ফেলে ! চৈতির কোলে তাতাইকে বসিয়ে বলে ,
” তোকেও কিনে দেবো একটা ভালুক পুতুল ঠিক পুকলুর মতো যদি এখন সোনা ছেলে হয়ে খেয়েনিস ! আর মায়ের সব কথা শুনিস ! ”
তাতাই বলে , ” দেবে তো কিনে ? সত্যি বলছো ? ”
অবিনাশ বলে , ” একদম সত্যি ! এবার মেলায় গিয়ে কিনে দেবো ! ”
তাতাই খুব খুশি হয়ে খেয়ে নেয়।
রাতে ঘুমোনোর সময় তাতাই ঘুমিয়ে গেলে চৈতি অবিনাশকে বলে , ” কি দরকার ছিল তাতাইকে মিথ্যে আশা দেবার ! ওতো দামি পুতুল আমরা কিনতে কোথায় টাকা পাবো ! ”
অবিনাশ একজন মৃৎশিল্পী । মাটির পুতুল , খেলনা , মূর্তি তৈরি করে। স্ত্রী চৈতি আর ছেলে তাতাইকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। বিভিন্ন মেলাতে গিয়ে মাটির জিনিস বেঁচে যা আয় হয় তাই দিয়েই ওদের সংসার চলে। এইতো সামনের সোমবার অবিনাশ কলকাতা যাবে। ওখানে শিল্প মেলা শুরু হচ্ছে সোমবার থেকে। অবিনাশ অবশ্য মেলাতে নিজে একা যায়না সঙ্গে করে চৈতি আর তাতাইকেও নিয়ে যায়। ওদের একা ছেড়ে যেতে মন চায় না অবিনাশের ! অবশ্য যখন তাতাই ছোটো ছিল তখন চৈতি ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতে থাকতো অবিনাশ মেলায় গেলে । এখন তাতাই একটু বড়ো হয়েছে তাই ওদের সঙ্গে করেই নিয়ে যায় অবিনাশ !
সোমবার খুব ভোরে বাড়ি থেকে বেরোলেও ওদের পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। বিশাল বড়ো মাঠে মেলা বসেছে ! শত শত দোকানি এসেছে মেলায় তাদের বিক্রির সামগ্রী নিয়ে ! চারিদিকে এত আলো , মানুষের হট্টগোল !
চৈতি অবাক চোখে দেখছিলো চারপাশটা ! অবিনাশ বললো , ” তাতাই এর হাতটা শক্ত করে ধরে , তুমি আমার হাতটা শক্ত করে ধরো! শুনেছি এত বড়ো মেলায় বাচ্চা চুরি হয়ে যায় ! ”
চৈতির বুকটা ধক করে ওঠে ! ছেলেকে শক্ত হাতে ধরে স্বামীর হাত ধরে এগিয়ে যায় চৈতি। ওদের দোকানটা মাঠের দক্ষিণ দিকে।দোকানটার পাশে অনেক গুলো শাড়ির দোকান ! চৈতি একটু একটু পড়াশোনা জানে , ক্লাস সিক্স অবধি পড়েছিল। পাশের দোকানটার সামনে ঝোলানো একটা পেল্লায় পোস্টার ! চৈতি বানান করে করে পড়লো , ” নকশিকাঁথা , কাঁথাস্টিচ এর সম্ভার ! ”
না এমন শাড়ির নাম কখনো শুনেনি চৈতি। মেলা বেশ কয়েক দিন ধরেই চললো। একদিন ওরা সবাই মিলে মেলার বাকি দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলো। অবিনাশের দোকানের মুখোমুখি একটা পুতুলের দোকান , ছোটো বড়ো টেডি বিয়ার থেকে তুলা দিয়ে তৈরি হাতি , বাঘ , জিরাফ সব আছে দোকানে ! তাতাই হাঁ করে চেয়ে থাকে দোকানটার দিকে! ঠিক পুকলুর ভালুক পুতুলের মত কত পুতুল আছে দোকানটায় ! মায়ের কাছে বায়না ধরায় মা ওকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলো দোকানে । তাতাই এর পছন্দের একটা পুতুলের দামও জিগেস করেছিল । কিন্তু দামটা শুনে মা খালি বলেছিল বাড়ি ফেরার সময় কিনে দেবে পুতুলটা । তাতাই বাড়ি ফেরার দিনটার আপেক্ষায় থাকে !
তাতাই প্ৰথম দিন থেকেই দেখেছে ওই পুতুলের দোকানেও একটা ওর মত ছোট্ট ছেলে আছে। তাতাই যখন ওর মায়ের সাথে সেদিন গেছিলো তখন ছেলেটা তাতাই এর দিকে চেয়ে হাসছিলো। আজ মেলায় ভিড় বেশ কম । এখন তো দুপুর হয়তো সন্ধ্যের পর ভিড় বাড়বে। হঠাৎ সামনের পুতুলের দোকানের ছেলেটা ওর মাকে কি বলে তাতাইদের দোকানের সামনে এগিয়ে আসে! তাতাইকে বলে , ” এই আমার নাম শিবু । তোমার নাম কি ? খেলবে আমার সাথে?” সেই শুরু তারপর থেকে তাতাই আর শিবু খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। দুজনে একসঙ্গে চোর-পুলিশ নয়তো কাটাকুটি খেলে দোকানের ভেতর ! অনেক গল্প করে , একসাথে এটাওটা কিনে খায় ! শুধু তাতাই আর শিবু না , ওদের মা-বাবারও খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে ! শিবুরা থাকে নদীয়ার হরিহরপুর গ্রামে। ওর বাবা – মা নিজেরাই পুতুল তৈরি করে মেলায় বিক্রি করে। অনেক রাতে তাতাই ঘুমিয়ে গেলে চৈতি অবিনাশকে বলে , ” হ্যা গো আমার খুব ইচ্ছে শিবুকে কিছু একটা কিনে দেবো ! শিবু আমাদের দোকানের নেতাজীর মূর্তিটার দিকে প্রায়ই দেখে ! ওর নিশ্চয় ওটা খুব পছন্দ হয়েছে ! ওটাই দেবো আমি শিবুকে ! কিন্তু ভয় লাগে মাটির কম দামি খেলনা দিলে যদি ওর বাবা – মা খারাপ ভাবে ! ”
অবিনাশ বলে , ” খারাপ ভাববে কেনো ! চৈতি উপহারের মান দাম দিয়ে নয় , ভালোবাসা দিয়ে মাপা হয় ! ”
দেখতে দেখতে বাড়ি ফেরার দিনটা চলে আসে। তাতাই আর শিবুর খুব মন খারাপ আজ সকাল থেকে ! যাওয়ার সময় শিবুর মা অরুণা তাতাই এর হাতে একটা বড়ো লাল রঙের টেডি বিয়ার দিয়ে বলে , “এটা আমার তরফ থেকে তোমার জন্য উপহার।”
তাতাই এর মা বলে , ” এসবের কি দরকার ? এত দামি পুতুল …! ”
শিবুর মা বলে , ” আমি আমার ছেলেকে দিয়েছি তোমার এত আপত্তি কিসের ! ”
চৈতি আর কিছু বলতে পারেনা । শুধু যেটা এতক্ষন শাড়ির আঁচলে আড়াল করেছিল সেটা শিবুর হাতে দিয়ে বলে , ” এটা তোমার এই মাসির তরফ থেকে তোমার জন্য উপহার ! ”
শিবুর হাতে একটা বড়ো নেতাজীর মাটির তৈরি মূর্তি ! শিবু এক ছুটে মায়ের কাছে গিয়ে আনন্দে চিৎকার করে বলে , ” মা দেখো সেই নেতাজীর মূর্তিটা ! যেটা তোমার কাছে কিনবো বলে চেয়েছিলাম ! মাসি কি করে বুজলো মা আমার এটা পছন্দ ? ”
চৈতি আর অরুণা মিটিমিটি হাসছে ! হয়তো মনে মনে বলছে মায়েরা এমনই হয়। ছেলেদের সব কথা নিজে থেকেই বুজে যায় !
তাতাই মা – বাবার হাত ধরে বাড়ির পথে এগোচ্ছে । তাতাই হাতের পুতুলটার দিকে দেখছে আর হাসছে। মনে মনে ভাবছে কত্ত দামি উপহারটা দিলো আমাকে কাকিমা।
শিবু মাকে বলছে , ” মা বাড়ি ফিরেই এই মূর্তিটা তুমি আলমারিতে ভালো করে রেখে দেবে ! কতো দাম এটার ! ভেঙ্গে গেলে আর তুমি কিনে দেবেনা ! ”
——- সমাপ্ত ——–