ঝিন্টি

ঝিন্টি

“তোমাদের চাঁদা দিতে হবে কেন? তোমরা সরস্বতীর স্তব জানো ?”, না চাইতেও আমার গলায় বেশ একটু বিরক্তি ফুটে উঠল । সামনের ছেলেটির বয়েস বেশী নয়, একটু সলজ্জ হেসে বলল, “হ্যাঁ স্যর জানি ।” তারপর গলা সোজা করে, আকাশের দিকে মুখ তুলে আওড়ে গেল আগাগোড়া শ্লোকটা । বেশ বলল কিন্তু, চিকণ গলায় এখনও ভাঙ্গন ধরেনি – যুবক হয়ে ওঠার সামান্য বাকি আছে, শুনতে খারাপ লাগল না, বললাম- “তা বেশ, পুজোটা হচ্ছে কোথায় ? “

– এই তো সামনের গলির মোড়ে স্যর । আপনার বারান্দা থেকেই দেখা যায় ।
– তাই নাকি ? তা কত দিনকার পুজো ?
– অনেক দিনের স্যর, এ পাড়ার সিনিয়াররাও একসময়ে করতেন, এখন আমরা করছি ।
এ পাড়ার ইতিহাস আমি জানি না । এই দুমাস হল এখানে ভাড়া এসেছি, পাড়াটা নিয়ে একটা মিশ্র মতামত পেয়েছিলাম- কেউ বলেছিল ভাল, কেউ বলেছিল দোষ আছে । দোষ আর কোথায় নেই । এখনকার দিনে দোষহীন পাড়া খুজে পাওয়া যায় না- মোটে আমল দিই নি সে সব কথায় । মানিব্যাগ থেকে একশ টাকার দুটো নোট বার করলাম । ছেলেমেয়েগুলোর দিকে চেয়ে দেখলাম – এতটা ওরা আশা করে নি, বোঝাই যাচ্ছে । শ্লোক বলা ছেলেটি পরিস্কার অক্ষরে বিল ভরল, নেমপ্লেট দেখে আামার নামটা লিখে বিলটা বাড়িয়ে দিল । আমি বল্লাম, ” যেতে বললে না তো ?” এবার সমস্বরে সবাই এমন নেমতন্ন করতে শুরু করল, যে আমি নিজেই হেসে উঠলাম ।

সরস্বতী পুজো আমিও করেছি এককালে । বড় হতে গেলে বাংলার ছেলে পিলেকে ওটা করতে হয়, সবাই করে । প্রথম সার্বজনীন কাজ, প্রথম বড় হয়ে ওঠার আনন্দ ।

এখন তো কাজের চাপে মনেও থাকে না কবে বাগদেবী এলেন আর চলে গেলেন, বাচ্চাদের এই দঙ্গলটা সেই পুরোন স্মৃতি উসকে দিয়ে গেল । মফস্বলে শীতের আয়ূ অনেক বেশী, সকালের নীলচে আকাশে বেলা অবধি আলস্যের কুয়াশা – কিন্তু রশদ তলানীতে, তাই বাজারে বেরোলাম । রাস্তায় পড়েই দেখলাম ঠিকই বলেছিল ছেলেগুলো, গলির মোড়ে একটা বাঁধানো চাতাল আছে, ওখানেই প্যাণ্ডেল হবে মনে হয় । রাস্তায় অঘোরবাবুর সাথে দেখা হয়ে গেল । এই পাড়ায় সামান্য যে কয়েকজনকে আমি চিনি তার মাঝে একজন হলেন এই অঘোরবাবু – প্রবীণ লোক, হাঁটুর ব্যথায় খুঁড়িয়ে হাঁটেন, সামান্য ঝুঁকে । ব্যাগ হাতে তিনিও বাজারে চলেছেন । শালের ভেতর থেকে হাত বার করে ডাকলেন, ” ভটচাজ্যি ও ভট্চাজ্যি মশাই” । ভদ্রলোক পণ্ডিত মানুষ, অনেক খবর রাখেন- আমার বাসার একদম উল্টো দিকেই তার নিজের বাড়ী । সত্যি কথা বলতে কি অঘোরবাবুর এক দূরসম্পর্কের ভাই আামার কলিগ, ওর থেকেই এই ভাড়া বাড়ীটার খবর পেয়েছিলাম । উনার বাড়ীটা অবশ্য অসাধারণ । সামনে বিশাল একখানা লন, লন না বলে বাগান বললেই হয় – কি ফুল যে তাতে ফোটে না তা আমার জানা নেই । ভদ্রলোক সরকারী হর্টিকালচার ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন তো , একজন পুষ্প-বিশারদ বললে ভুল হবে না ।

এখন সারাদিন ওই নিয়ে থাকেন । অঘোরবাবুর ছেলে বাঙ্গালোরে পাকাপাকি সংসার পেতেছে — বুড়ো-বুড়ির নিঃসঙ্গ পরিবার, খোলামেলা জীবন যাপন । মালি আছে, বৌদিও মাঝে মধ্যে হাত লাগান গার্ডেনিং এ – আর অঘোরবাবু হলেন ডিরেক্টর । পায়ের ব্যথা, নিজের হাতে বড় একটা কিছু করতে পারেন না । কদিন আগেই একবার ওদের বাড়ী গিয়েছিলাম, লনে হলুদ লাল গোলাপের আকার দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম । তারপর মাঝারী পাতার একটা গাছে অদ্ভুত বেগুনী লাল রং এর একটা ফুল দেখলাম, প্রচুর ফুটেছে – আমি জম্মে এরকম সুন্দর ফুল দেখিনি । হ্যাঁ করে দেখছিলাম । অঘোরবাবু বুঝিয়ে দিলেন এটা হল বার্লেরিয়া ক্রিসটালা, ইংরেজীতে বলে রেড এ্যামারানথ্ সংস্কৃতে বিখ্যাত কুরবক কিম্বা বাংলায় ঝিন্টি বলতে পারো । আমি আরও হাঁ হয়ে গেলাম, মানে কালিদাসের সেই বিখ্যাত কুরবক ! কি অপূর্ব । মনে মনে বললাম সাধে কি মহাকবি এই ফুল অলকার সুন্দরীদের চুলে দিয়েছেন । অঘোরবাবু সস্নেহে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন – ” ভট্চাজ্যি, এরাই এখন আমার ছেলে মেয়ে বুঝেছ ? “ ছেলে মেয়েই বটে । কোন পাহাড়ের এত্তসব ফুল, সময়ে অসময়ে ফোটাতে বাবা মায়ের মত যত্ন তো করতেই হবে ।

“কিন্তু এত দামী সব ফুল, চুরি টুরি হয় নাঃ ? যা দিন কাল ! ” আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি । অঘোরবাবু একটু গম্ভীর হয়ে যান – ” নাঃ সেরকম হয় না, দেখছ তো পাঁচিল দিয়ে দিয়েছি ।” বৌদি এতক্ষণ চুপকরে শুনছিলেন, হঠাৎ মুখ খুললেন তিনি, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন ” চুরি করলে তো শান্তি পাই ।” অঘোরবাবু ভীষণ বিরক্ত হয়ে বৌদিকে থামিয়ে দিলেন- ” যা বোঝ না তা নিয়ে কথা বোল না । ভট্চাজ্যি এই প্রথম বার আমাদের বাড়ীতে এসেছে – এখনই ওকে কি সব বোঝাচ্ছ ।” তাঁর কথাবার্তায় এমন কিছু ছিল যাতে আমি আপাততঃ জানার ইচ্ছেতে ইতি টানলাম । বৌদিও চোখ মুছতে মুছতে উঠে গেলেন চা বানাতে ।

সেই হল প্রথম অঘোরবাবুর বাড়ীতে আমার যাওয়া । আজ আবার তার সাথে বাজারে । মোড়ের চাতালটার পাশ দিয়ে যাবার সময় জিগেস করলাম, দাদা এখানেই কি পুজোটুজো হয় নাকি ? অঘোরবাবুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল –” হ্যাঁ ওই সরস্বতী পুজো করে পাড়ার ছোটরা । তা তুমি জানলে কি করে ? নিশ্চয় চাঁদার জুলুম ।” আমি লজ্জা পাই- “না না ছোট ছোট ছেলে জুলুম করবে কেন, বরং আবদার বলা যায় । ” অঘোরবাবু মুখে একটা প্রশান্তির ছায়া পড়ল, “অনেক দিনের পুজো, আমরা ছোটবেলা থেকে দেখছি । পাড়ার বড়রা পেছনে থেকে ছোটদের দিয়ে পুজোটা করায়, এই আরকি । ” তারপর চুপ করে বোধহয় নিজের ছোটবেলার কথা ভাবতে ভাবতেই হাঁটতে লাগলেন বাজারের দিকে।

তার পরদিন হঠাৎ আমার দিদি মেয়েকে নিয়ে আমার নতুন বাসায় এসে হাজির হল । সরস্বতী পূজোর দিন পাঁচেক তখনও বাকি । ভাই এর সংসার একবার না দেখলে তার চলছিল না । দিদি বয়েসে আমার থেকে খুব বড় নয়, কিন্তু এতটাই গিন্নি বান্নি যে আমি খুব ভয় করি তাকে । আমার ঘর গোছানোর কিছুই তার ভাল লাগে না – প্রথম দিন বাথরুমের মগ থেকে ঝুলঝাড়া অবধি বদল করে ফেলল । রান্নার মাসিকে রান্নার তালিম দিল, কাজের মাসিকে সায়েন্টিফিক ফ্লোর ওয়াশিং শেখাল, আমাকে হোম ম্যানেজমেন্টের একটা রিওরিয়েন্টেশন করিয়ে খান্ত হল । মেয়েরা কখনও শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে না – কারণ তারা পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি পরিবেশের খবর রাখে- সত্যি বলতে কি সেটা তাদের রাখতে হয় । রাখতে হয় তাদের নিজেদের স্বার্থে আর বোধহয় আমাদের মত অপদার্থদের স্বার্থে । তাই অবাক হয়ে পরদিন শুনলাম দিদি বলছে, তোর এখানে তো আসা যাবে না রে – পাড়াটার বদনাম আছে । আমি হাসব কি কাঁদব ভেবে পেলাম না – মানে ? কি বদনাম ?

– যা বুঝছি জায়গাটা ভাল নয় ।
– কেন বলোতো ? অপদেবতা টেবতা নাকি চোর ডাকাত ? আমি এই কমাসে কিছুই শুনিনি আর তুমি পাড়ায় পা দিয়েই সব জেনে ফেল্লে । যত্তসব ।
– এই সামনের বাড়ীর বুড়োটার সাথে মিশিস না ।
– কে ? অঘোরবাবু ?
– হ্যাঁ হ্যাঁ ওই ওই….কিছু একটা ব্যাপার আছে, খবর পেলাম ।
– তুমি নাঃ- একটা যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছ দিদি, মানুষ মঙ্গল গ্রহে চলে গেল আর তুমি এসব কুসংস্কার ছড়াচ্ছ ।
” হ্যাঁ বলবিই তো, তুই ছোটবেলা থেকে একটু বেয়াড়া ধরণের ” -দিদি ধমকে ওঠে,- “শোন গুরুদেবকে ফোনে বলেছি একটা কবজ দিতে, চোখ কান খোলা রাখিস, বুঝলি ?”

দিদির আবার গুরু আছে । তার আবার কবজ দেওয়ার হ্যাবিট আছে । প্রচণ্ড হাসি পেল – ভয়ে হাসতে পারলাম না । শুধু ঘাড় নাড়লাম ।

দিদি চলে গেল তবে একটা সন্দেহ উসকে দিয়ে গেল । যতই আমি নাস্তিক হই, হাজার হোক মানুষ তো । ব্যাপারটা জানতে হবে– সামান্য ভুল বোঝা থেকে কত বড় বড় যুদ্ধ লেগে যায় তো একজন ফুল বিশারদ অঘোরবাবু ! আমার দোতলার বারান্দা থেকে অঘোরবাবুদের লন ভালোই দেখা যায় । বুড়োবুড়ীর সংসারে কারণে অকারণে আমার চোখ চলে যেতে লাগল । কি করেন ভদ্রলোক যাতে এমন বদনাম ? সেদিন ওনার মিসেস কি বলার চেষ্টা করছিলেন সেটাও বোঝার ব্যর্থ চেষ্টা করি । ভুল তো কোথাও হচ্ছেই– তবে কি জন্যে এটা ভুতুড়ে দেখাচ্ছে সেটা বার করাটা বেশ একটা চ্যালেঞ্জিং । কিন্তু একটা বাগানের মধ্যে গাদা গাদা ফুল, মালি কাজ করছে , মালিক এসে বসছে, বস্তা বস্তা সার আসছে, ঝারির জলে গাছ ভিজছে এসবে কি ভুতুড়ে জিনিস থাকতে পারে তা আমার মাথায় ঢুকলো না ।
সরস্বতী পুজোর তখন ঠিক দুদিন বাকি । জানলার ফাঁকে চোখ রেখে অনেক রাত অবধি জেগে থাকলাম ।

রাতে এই জায়গাটাকে এরকম ভাবে আগে কখনও দেখিনি । এমনিতেই শহরের এই অংশটা একটু নির্জন । রাত আটটা নটার পর লোক থাকে না । রাত বারটায় পুরো পরিবেশটাই কেমন নিশুতি হয়ে যায় । অঘোরবাবুর বাগানের নাম না জানা বাহারী ফুল সব রং ছেড়ে কালো কালো ঝাঁকড়া গাছে পরিণত হয় – বাড়ীর ছাত পেরিয়ে ছোট,বড়,মাঝারী গুল্ম সত্যিকারের অপদেবতার মত ঝিরঝিরে বাতাসে দোল খায় । শীতের কুয়াশা টিমটিমে রাস্তার আলোটাকে চাপা দিয়ে আরও অপার্থিব করে তোলে চারদিক । তবুও এসবের নাম ভুত নয় । পুরোটা পণ্ডশ্রম হল, সকালে ঘুম ভাঙ্গল না- অফিসে যেতে দেরী হয়ে গেল । সেদিন ওপরওয়ালার গালাগালি খেয়ে ভুত ধরার চিন্তা মাথা থেকে যখন বাদ যায় যায়, ঠিক তখনই অঘোরবাবুকে বিকেলের পায়চারী করতে দেখে আর থাকতে পারলাম না । একদম সরাসরি জিগেস করে বসলাম প্রশ্নটা ।

– দাদা একটা কথা বলবো ?
অঘোরবাবু মাথা ঝুঁকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “বলো ভটচাজ্যিবাবু তোমার আবার হঠাৎ অনুসন্ধিৎসার কারণ কি — নতুন ফুল দেখলে নাকি ? ” অনুসন্ধিৎসা কথাটা বেশ টেনে টেনে বললেন- একটু কৌতূক মাখানো । বললাম, ” নাঃ ঠিক তা নয় — বলছিলাম কি, বাগানটা নাকি ভুতুড়ে ? অঘোরবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন । আমাকে একবাব ভাল করে দেখলেন আপাদমস্তক, তারপর বললেন, ” কেন? তুমি কি কিছু দেখেছ ? ” আমি আরও কাচুমাচু হয়ে যাই, “না মানে শুনেছি বলতে পারেন । ”
-ওঃ তা কি শুনলে ?
– এই বাগানে ভুত আছে ।
অঘোরবাবু হেসে উঠলেন – ” তুমি ভুতে বিশ্বাস করো ?”
– না, তা অবশ্য করি না ।
– তবে ?

বুঝতে পারছিলাম আমি যেটা করছি এটাকে এেঁড়ে তক্ক বলে । নিজেরই খারাপ লাগছিল । অঘোরবাবু আবার বললেন, ” ভুতে যদি বিশ্বাস করতে, তবে তো বুঝতে কোথাও না কোথাও তাকে থাকতে হবে । আর রাস্তা ঘাটে না থেকে যদি বাগানে ফুল দেখে সে সময় কাটায় তাহলে আপত্তি কি ? ঠিক নাঃ । “ কিন্তু কিছুই ঠিক ছিল না । সেই বেঠিক জিনিষটাই এমন ভাবে ঘটল যাতে আমার সব বিশ্বাস এক ঝটকায় উড়ে গেল । ঘটনাটা ঘটল তার পরের দিন

– সরস্বতী পুজোর আগেরদিন রাতে ।
সন্ধ্যে থেকেই মায়ের একটা ফোন আসছিল, কিন্তু বার বার কানেকশান কেটে যাচ্ছিল – দেখলাম ঘরের ভেতরে একেবারে টাওয়ার নেই । তাই একটু বারান্দায় যেতেই হল । তখন রাত দশটা এগারোটা হবে । চারদিকে কুয়াশা খুব ভারি না হলেও এসময়ের তুলনায় বেশি । কেউ বাঁশে বোমা পেরেক মারছে, ঠক ঠক ঠক….। পাড়ার সেই সরস্বতী মণ্ডপে প্যাণ্ডেলের কাজ চলছে মনে হয় । রাত্রির স্তব্ধতা ভেঙ্গে শব্দটা চারদিকে ঘুরছে, কিছুক্ষণ বাদে বাদে ফিরে আসছে । রেলিং এ হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সেই দিকে অনেকক্ষণ চেয়েছিলাম । হঠৎ মনে হল সে দিক থেকে কারা আসছে, গলা শোনা যাচ্ছে তাদের । প্রথমে খুব আস্তে, ক্রমশঃ গলাগুলো স্পষ্ট শোনা গেল । রাস্তার কিছুটা অংশ কুয়াশায় ঢাকা – মনে হল তার পেছনেই কারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এদিকে আসছে ।

দেখতে লাগলাম এত রাতে কারা আসে – নিশ্চয়ই ওই বাচ্চাগুলো । ভাবলাম, ছেলেগুলোর বেশ উৎসাহ আছে তো – ছোটবেলায় এটাকে বলতাম এনথু, সরস্বতী পুজোর আগের দিন রাত বারোটায় আমাদের আরও প্রোগ্রম থাকত অবশ্য – যার মধ্যে একটা হল লোকের বাড়ীর ফুল চুরি । মনে পড়ে গেল সেই দিন গুলোর কথা । আওয়াজটা ক্রমশঃ কাছে আসতে লাগল, বেশ কাছে – পরিস্কার একটি ছেলে ও একটি মেয়ের গলা, ছেলেটি কিছু বলছে, মেয়েটি শুনে হাসছে – অথচ এই শব্দের দূরত্বে তাদের দেখতে পাওয়া উচিত কোন সন্দেহ নেই । আবার ভাল করে দেখলাম- কিজানি কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেছে নাকি ! রাস্তার উল্টো দিকটা দেখলাম -নাহ্ সেখানেও কেউ নেই । এবার একদম আমার বারান্দার তলায় গলা দুটি শোনা গেল, ছেলেটি মেয়েটির নাম ধরে একবার ডাকল- মেয়েটির নাম বোধহয় ঝিন্টি….. ক্রমশঃ দুটি অদৃশ্য অবয়ব অঘোরবাবুর বাড়ীর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগল । আর প্রচণ্ড বিস্ময়ে আমি দেখলাম অঘোরবাবুদের মস্ত গেটটা একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে । তারপর স্বর ফিকে হয়ে এল । রেলিং ধরে আমি তখন ঘামছি- ভীষণ মাথা ঘুরছে মনে হল উল্টে পড়ে যাব – টলতে টলতে ঘরে ঢুকে এলাম ।

বিছানায় শুয়ে আর জ্ঞান ছিল না- সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গল দেখি পঞ্চমীর সকালের আলো জানলা দিয়ে আমার গায়ে পড়েছে । কাল রাত্রের অভিজ্ঞতার ঘোর এখনও কাটে নি – অঞ্জলী দিতে গেলাম তৈরী হয়ে । অনেককে দেখলাম, কিন্তু অঘোরবাবুদের কোথাও পেলাম না । পাড়ার একজন বয়স্ক লোকের সাথে বেশ আলাপ জমে গেল । কিছুক্ষণ এটা সেটা বলে অঘোরবাবুর প্রসঙ্গ তুলতেই ভদ্রলোক গলা নামিয়ে বললেন, “সেকি মশাই আপনি জানেন না, অঘোরবাবুর মেয়ে তো সরস্বতী পুজোর দিনই আত্মহত্যা করে । তারপর থেকে ওনারা এদিন কোথাও বেরোন না ।” একটু থেমে ভদ্রলোক আবার মুখ বিকৃত করে বললেন- “ আর বলবেন না মশাই, বড়লোকের মেয়ে, কে একটা ফালতু ছেলের সাথে প্রেমটেম করে…. ব্যাপার বুঝলেন না.. এই তো করে, বাপ মা রাজী না হলেই দুজনে একসাথে……” ভদ্রলোক একটা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গী করলেন । স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম কিছুক্ষণ, তারপর আমার চোখ গেল প্রতিমার দিকে । এত ফুলের মালা বাগদেবীর গলায়– তবু সব মালা ছাপিয়ে কি করে ওপরে উঠে এল ওই একটা বেগুনী-লাল ফুলের মালা । ঠিকই তো, ওটা বার্লেরিয়া ক্রিসটালা ওটা কুরবকের মালা, ওটা নিশ্চয় ঝিন্টি ফুলের মালা । সেদিকে তাকিয়েই ভদ্রলোককে ধরা গলায় বললাম, “কি নাম ছিল মেয়েটির জানেন ?” ভদ্রলোক বললেন – ” অদ্ভুত নাম ছিল মশাই, ঝিন্টি না কি যেন ।” আমার চোখ তখনও দেবী প্রতিমার দিকে — মনে হল দেবী যেন হাসছেন, তিনি তো শুধু বিদ্যার দেবী নন, প্রেমেরও দেবী।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত