আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে এই ঘটনাটি আমি শুনেছিলাম আমার দিদিমার কাছে। দিদিমা বাংলাদেশে থাকতেন, সেবার দিন কয়েকের জন্য আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আমি তখন সদ্য মেট্রিক পাশ দিয়ে ঘরে বসা। বাবা আমায় এক সেলাই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। দুঘন্টা ক্লাস শেষে বাড়ি এসে মায়ের হাতে হাতে একটু কাজ গুছিয়ে দিই, ব্যাস এই ছিল আমার সারা দিনের কাজ।
সেই দিনটা আমার বেশ মনে আছে। কোন এক শনিবার সময়টা শ্রাবণ মাস । মা বাবা দুজনেই সেদিন গেছিলেন মেদিনীপুরে বাবার কোনো এক বন্ধুর বাড়িতে। দিদিমা বাড়িতে একা থাকবেন ভেবে আমি রয়ে গেলাম। সন্ধ্যে বাতি দেখিয়ে চানাচুর সহযোগে, চা খেতে খেতে এটা সেটা গল্প করছিলাম। কথায় কথায় যে রাত আটটা বেজে গেছে তা খেয়াল করিনি। খেয়াল হল তখন, যখন মুষল ধারায় বৃষ্টি নামল সাথে বজ্রপাত।
দিদিমার কোল ঘেঁষে বসে আছি। হঠাৎ দিদিমা বললেন -” দিদিভাই ভূতের গপ্প শুনবি.”
এরকম বাদলা মরশুমে ভূতের গপ্প জমে যাবে। “খুব শুনবো।”
মা রাতের জন্য গরম গরম খিচুড়ি, আর বেগুন ভাজা করে রেখেছিল। গল্প শোনার তাগিদে এক থালা খিচুড়ি প্রায় গোগ্রাসে গিললাম। দিদিমা ও এক সাথেই খেলেন।
যাই হোক, খাওয়া শেষে দিদিমা নিজের জন্য পান সাজাচ্ছেন, আমি ততক্ষনে রান্নাঘরের কাজ শেষ করে সদরে তালা দিয়ে দিদিমার ঘরে এসে বসলাম। মা বাবা সেইরাতে ফিরবে না ফলে আর কোনো কাজ নেই। ঘরে এসে দেখলাম, মশারী টানিয়ে বিছানার ভিতরে দিদিমা বসা ,আমি ঘরের আলো নিভিয়ে নীল রাতের আলো জ্বালিয়ে তাড়াতাড়ি করে দিদিমার বিছানায় ঢুকে পড়লাম। দিদিমা পান চিবোতে চিবোতে গল্পের শুরু করলেন। @অনি
“ঘটনাটা যখন ঘটেছিল তখন আমার নয় বছর বয়স। আমার বাবা ছিল সরকারী কর্মচারী। বাবার এদিক ওদিকে প্রায় কাজ পড়তো। জমি জরিপ বা খাজনার কাগজ পৌঁছে দিতে প্রায়ই বাবাকে এ গ্রাম সে গ্রামে যেতে হত।
সেইবার সরস্বতী পুজোর পর মা ভাই কে নিয়ে মামা বাড়ি গেছে। আমি বাবার সাথে বাসায় রয়েছি। তা বাবার একদিন কাজ পড়লো কুমুদপুরে, আমাদের ওখান থেকে কুমুদপুরে যাওয়ার আসার ট্রেন সারাদিনে তখন একবারই পাওয়া যেত, তাই বাবা যেদিন যাবে কাজ শেষ করে সেইদিন আর ফেরার ট্রেন ধরতে পারবে না। ওদিকে আমি ও বাড়িতে একা, অন্য উপায় নেই দেখে বাবা আমাকে ও সঙ্গে করে নিয়েগেল। কুমুদপুরে বাবার এক পুরোনো বন্ধু রফিক চাচা থাকতো , কাজ শেষ করে তার বাড়িতে রাত কাটিয়ে পরদিন ফিরবো এমন টাই ঠিক হলো।
কুমুদপুরে নেমে বাবা খানিক বিপদে পড়ল। যাকেই ঠিকানা দেখাচ্ছে তারাই জানিনা বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। শেষে এক বুড়ো ভ্যান চালকের সাহায্যে গন্তব্য স্থলে পৌছালাম। সেই ভ্যান চালক বাড়িটার সামনে নামিয়ে পয়সা না নিয়েই পালিয়ে গেল। এই জিনিসটা ভারী খটকা লাগলো আমাদের।
বাড়িটার মূল ফটক ভেজানো, বন্ধ ফটক দিয়ে সিমেন্ট ঢালাই রাস্তা ধরে কিছুদূর এগোনোর পর ডায়নে মূল বাড়ি। ছাদ ঢালাই করা সামনের অংশ আর পেছনে টিনশেড দেওয়া। এর পাশে একটা পুকুর,এখন পচা পুকুর বলাই ভালো।কচুরিপানা ভরা সবজে জল। বাড়ির পেছনের পুকুরপাড়ে অনেক গাছ গাছালি। জংলা গাছ,কিছু ফুলের গাছ,কয়েকটা নারকেল ,সুপারি গাছ আছে। শানবাঁধানো পুকুরপাড়, পুকুরের পাশ দিয়ে বাড়ির প্রবেশপথ। একতলা বাড়ি, তবে দোতলায় একটা ঘর আছে মনে হচ্ছে। পুরো কম্পাউন্ডটাই কোমর সমান পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির সামনে কাঠা খানেক জমি।
লোহার গেট খুলে যখন ভিতরে ঢুকলাম বাবা জিজ্ঞাসা করলো
“কেউ আছেন ? সরকারী কাগজ আছে ?”
কোনো সাড়া নেই, কিছুক্ষন বাদে ভিতর থেকে একজন পুরুষ মানুষের গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে “ভিতরে আসুন ।”
হঠাৎই যেন মনে হল দিনের আলো কমে গেছে, মেঘলা আকাশ বাতাসটা ও ভারী ভারী ঠেকছে। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললো
“মুন্নি বোধকরি পানী হইবে, তাড়াতাড়ি কাম গুছায়ে রফিকের বাসায় পৌছায়তে হইবে।”
আমি ও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। আবার ভিতর থেকে কেউ বলে উঠলো
“কই ভিতরে আসুন ।”
বাবার হাত ধরে এগোলাম, গাছটার তলা দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন কিরকম একটা বাতাসের অভাব অনুভব করলাম। বাড়িটার আশপাশে কী যেন একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে। দুজনে মন শক্ত করে বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। দুবার খটখট করে ও দরজা কেউ খুললো না।
বাবা আমি দুজনে মিলে নানা ভাবে চেষ্টা করছি, কিন্তু খোলার নামই নেই। বাবা বেশ রাগী গলায় বললেন
“দরজাটা খুলুন , এটা মশকরা করণের সময় নয়।”
ক্যাঁচ চ চ চ …. শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ভিতরটা ভীষণ জমাট বাঁধা অন্ধকার।
আবার ভিতর থেকে আওয়াজ আসলো
“আমি খুব অসুস্থ, পাশের ঘরে আছি একটু এদিকটায় আসুন।”
সেই জমাট বাঁধা অন্ধকারে অচেনা জায়গায় এগোনো মুশকিল। ঘরের দেওয়াল হাতড়ে সুইচ বোর্ড খুঁজে আলো জ্বালালাম। টিমটিমে বাল্বের আলো ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সেই আলোতেই মোটামুটি দেখা যাচ্ছে, সারা ঘরে ধুলোর পুরু আস্তরণ, মেঝেতে কালো দাগ সুস্পষ্ট।
ঘরের মধ্যে বাতাসটা ভীষণ ভারী লাগছে। এগোতে হলে যেন কিছু ঠেলে সরিয়ে এগোচ্ছি মনে হচ্ছে। বাইরের দিকের দরজা ছাড়াও ঘরের আরও দুটো দরজা। একটা বাঁ পাশের দিকে, একটা পিছন দিকে। পিছনের দরজা খুলে ভিতরে পা দিতে গিয়েই আঁতকে উঠলাম!! @অনি
শুধু কেউ যেন ডাকছে “নূরী নূরী ” কিন্তু কে কে ডাকছে? নিকষ আঁধারে মনে হচ্ছে দরজার ওপারে কিচ্ছু নেই। দরজা খুলতেই একঝাঁক বাদুড় উড়ে বেরিয়ে এল অতল অন্ধকারের ভিতর থেকে। ভয়ে দুই পা পিছিয়ে এলাম। ঘরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আবার দেওয়াল হাতড়ে আলো খোঁজার চেষ্টা করছি আমরা, একটা সুইচ টিপতেই নীল নাইট লাম্প জলে উঠলো, আলো কোথাও পড়ছে না, শুধু দেওয়ালে একটু জায়গায় পড়ছে, মনে হচ্ছে সর্বগ্রাসী শক্তি দিয়ে যেন আলোটা কেউ খেয়ে ফেলছে।
বাবা খুব সাহসী , কিন্তু বাবার হাতের তালু তখন ঘামতে শুরু করেছে। পাশের ঘরের দরজাটা খোলার আগে দুজনেই দুজনের দিকে তাকালাম। তারপর কিছু বিভীষিকা দেখার প্রস্তুতি নিয়েই বাঁ পাশের ঘরের দরজাটা খুললাম। কোনো শব্দ নেই, এতক্ষন যে আমাদের ভিতরে ডাকছিলেন তারও কোনো সাড়া শব্দ শুনতে পেলাম না।
বাবা আবার জিজ্ঞাসা করলো “আপনি কোথায়?”
না কোনো উত্তর পেলাম না। সেই ঘরের পাশ কাটিয়ে আমরা একটা সরু করিডরের মধ্যে এসে পড়েছি। করিডোরের আলো জ্বালিয়ে দেখলাম করিডরের পিছনের দিকে ছাদেওঠার সিঁড়ি। হটাৎ বৃষ্টি শুরু হল, দূরে কোথাও কড়কর শব্দে বাজ পড়লো। তার সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাড়িটার বাতি নিভে যায়। পুরো বাড়িটা আবার নিকষ কালো আঁধারে মুড়ে গেল। দিনের ম্রিয়মান আলোর এতটুকু ও ঘরে আসছে না।
এক বুক নিঃশ্বাস নিয়ে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললো
“মুন্নি আজ আর কাম হইবো না, পানী কম হইলে রফিকের বাসায় যামু গিয়া।”
হটাৎ কোনো একটা ঘরের ভিতর একটা করুন কান্নার সুর ভেসে আসছে, যেন ইনিয়ে বিনিয়ে কোন মহিলা কাঁদছে। বাবার মুখ তখন ভয়ে শুকিয়ে গেছে। আমি ও এক মনে দুর্গা মন্ত্র পাঠ করছি।
কান্নার শব্দটা ক্রমে বাড়তে লাগলো , আমরা আর করিডোরে দাঁড়াতে পারলাম না, এগোলাম সেইদিকে ,সেটা একটা শোবার ঘর । ঘরের বাতাস এত ভারী যে হাত দিয়ে সরিয়ে এগোতে হবে মনে হয়। এর মধ্যে একটা অস্বস্তিকর পোড়া গন্ধ নাকে এলো। কান্নার শব্দটা তখন ও আসছে।
হটাৎ খেয়াল হলো বাবা নেই আমার পাশে। ভয়ে গলা থেকে একটা আওয়াজ ও বেরোলো না। আবার সেই কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। মনের সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে বললাম
“আপনি কে ? কাঁদছেন কেন?”
কোনো উত্তর নেই।
হটাৎ বাবার গলার স্বর পেলাম ,”মুন্নি মুন্নি।”
দিকবিদিক না তাকিয়ে ছুটলাম সেই দিকে, এসে দেখি বাবা সেই ঘরেও নেই। ছাদের উপর থেকে আবার বাবার গলার আওয়াজ শুনতে পাই। করিডোরের মধ্যে দিয়েই লোহার ঘোরানো সিঁড়ি ছাদের দিকে উঠে গেছে। এক নিঃশ্বাসে ছাদে উঠে দেখি কোথাও বাবা নেই
, “বাবা, বাবা কোথায় তুমি ?”
আর পারছি না , বুঝতে পারছি জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি দুইজন আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম
“কে আপনারা ?”
গগনবিদারী অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো চারিদিক, আমি জ্ঞান হারালাম। কতক্ষন সেখানে পড়ে আছি জানিনা, জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমি আর বাবা সেই করিডোরে পড়ে আছি।
আমার সমস্তটা যেন গুলিয়ে গেল। বাবাকে ডাকতেই ধড়ফড় করে উঠে বসে বাবা বললো
“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এইখান থেকে বাহির হইতে হইবে।”
আমরা যে পথে এসেছিলাম সেই দরজা দিয়েই বেরলাম। প্রথমে আমি, কিন্তু বাবা? বাবা বেরোয় না কেন? এখন আরো ভয়ঙ্কর কিছু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
দু-পা ফিরে ঘরের মধ্যে উঁকি দিতেই দেখি কোথাও কেউ নেই।
আমি চিৎকার করে ডাকলাম -“বাবা ! কোথায় তুমি?”
উত্তর এলো -“আমি ছাদে!” মনে হচ্ছে যেন পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। সেই দুটো মানুষের অবয়ব এখন ও আমার চোখের সামনে ভাসছে।
-” মুন্নি ছাদে আয়।”বাবার গলায় ভয়ার্ত স্বর।
“আমি ছাদে যাবো না , তুমি এখানে এসো।”
আবার কেউ যেন বলে উঠলো “মুন্নি ছাদে আয়।” কিন্তু সেই কন্ঠস্বর বাবার না।
এই বাড়ির থেকে আমরা কি আর কোনোদিন বেরোতে পারব না? বাবা আবার ডাকলো, তবে এবারের কন্ঠস্বরটা খুব করুন, আমি সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বড় করে নিঃশ্বাস নিলাম। যাইই হোক আমার কোন ভাবে বাবার কাছে পৌঁছাতেই হবে।
কিছু বোঝার আগেই ছাদের দিকে এগোতেই একটা ছোট্ট মেয়ের আমায় জাপটে ধরে বলল “ওখানে যাস না, আর ফিরতে পারবি না আমার সাথে আয়।”
সত্যি কথা বলতে আমারই সমবয়সী একজন কে দেখে মনে শক্তি পেলাম। ভয়ের থেকে ও বেশী কিছু একটা অনুভূত হচ্ছে। সেই মেয়েটির পিছু নিলাম , অনেক গলি, ঘর পেরিয়ে সে আমায় নিয়ে আসলো একটা বড়ো হলঘরে।
সেই ঘরে আগে আমি আসিনি। মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে আলোকিত হয়ে উঠল ঘরটা। হলঘরটি সম্পূর্ণভাবে পুরোনো আমলের হলঘরে পরিণত হয়ে উঠল। সেখানে একজন নর্তকী নাচছেন। আর তাকে ঘিরে হলঘরটি জুড়ে নানান আমোদপ্রমোদের লোকজন বসে আছেন। দৃশ্যটি যেন প্রকৃতই সেইসময়েরই ঘটনাবলী।
উপরের ঘরের পাশে বারান্দায় তাকিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন ঘোমটাপরিহিতা মহিলা সেখানে দাঁড়িয়েই নীচের বাঈজিনাচের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
হঠাৎই উপস্থিত লোকের মধ্যে কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে কোলাহল শুরু হয়েছে। একটি বয়স্কা মহিলা চোখগুলো ঘোলাটে, চুলগুলো কেমন যেন বিন্যস্ত হয়ে রয়েছে।
আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে
“আয় নূরী মেরী জান, আয়।”
ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছি, সেই বৃদ্ধা হটাৎ রেগে গিয়ে হাতের কাছে রাখা একটা পাথরের ফুলদানি ছুড়ে মারে, কিন্তু অদ্ভুত ফুলদানির কোনো আঘাত তো দূর কিছুই আমাকে স্পর্শ করতে পারে না। বুঝতে পারলাম যা দেখছি সবই চোখের ভুল।
হলঘরের কোলাহল বাড়তে থাকে, একটি আকন্ঠ মদ্যপ অবস্থায় থাকা লোক আমার বয়সী সেই মেয়েটিকে নিয়ে টানাটানি করছে, সেই লোকটির পায়ের কাছে পড়ে কাকুতি মিনতি করছে একজন মহিলা, সম্ভবত মেয়েটির মা। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ওঠে “আমার নূরী কে ছেড়ে দিন জমিদার বাবু, ওকে যেতে দিন।”
পাশে দাঁড়িয়ে সবাই সেই উল্লাস দেখছে। ছোট্ট মেয়েটির অর্ধনগ্ন শরীরের উপর অকথ্য অত্যাচার চলছে, এমন সময় চারিদিকে আগুন ধরে যায়। দাউদাউ করে জ্বলছে নাচ মহল, ছোট্ট মেয়েটি তার মা ও আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রেহাই পেলোনা, সেই আগুনের এক ফোটা তাপ আমায় স্পর্শ করতে পারেনি। সেই ছোট্ট মেয়েটির ছায়া মূর্তি আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। আমি ধীর গতিতে এগিয়ে গিয়ে সেই নাচ মহলের পিছনের দরজা খুলতে দেখি বাবা সেইখানে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে, বুঝলাম বাবা ও সেই একই ঘটনার সাক্ষী। এখন যেন পথটা খুব সহজেই চিনতে পারছি,
নাচ মহল থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখি বাড়ির বাইরের সেই গেট।
আকাশের রোদের খেলা, বাড়ির বাইরে লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে থেকে একজন দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলেন “আল্লা তোমাদিগকে বাঁচাইছে, কাল রাতে আয়োনি দেইখ্যা আমি স্টেশনে খোঁজ করতে জানতে পারি ঠিকানা ভুল কইরা তোমরা রোশনি বাই এর কোঠির দিকে আইস। তাই লোক লইয়া আইয়া পড়ছি।”
স্থানীয় জনগন আমাদের দিকে অবাক হয়ে দেখছে। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি পোড়োবাড়ি বললেও কম বলা হবে। ভগ্নপ্রায় দশায় একটি বাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনে। অথচ কাল বিকেলে এর অন্য রূপ দেখেছি। কাল সারা রাত যে কি ধকল গেছে তা আমাদের চেহারায় ফুটে উঠেছে। রফিক চাচা এক বোতল জল আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন
“এ বাড়ি ছিল এই এলাকার জমিদার রুদ্র প্রতাপ চৌধুরীর প্রিয় নর্তকী রোশনি বাইয়ের। রুদ্র প্রতাপ অত্যন্ত নীচমানসিকতার মানুষ ছিলেন, অনেক মানুষের সর্বনাশ করেছেন। মদ গাঁজা মেয়েমানুষ কোনোটিই বাকি ছিল না। শহর থেকে নামকরা বাঈজি বায়না করা হতো। মুজরা বসতো এই কোঠিতে।
একদিন রোশনি বাইয়ের মাসতুতো বোনের মেয়ে নূরজাহানের ওপর জমিদার অকথ্য অত্যাচার চালায়, মেয়েটির মা অনেক অনুরোধ, উপরোধ করেও মেয়েকে বাঁচাতে না পেরে রাগের জ্বালায় পুরো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। সেই আগুনে পুড়ে মারা যায় সবাই। তবে রোশনি বাই, রুদ্র প্রতাপ ও সেই ছোট্ট নয় বছরের নূরজাহানের লাশ আজ ও পাওয়া যায়নি। আজও সেই লোভী কামাতুর আত্মা নয় বছরের মেয়ে দেখলে ভোগের বাসনায় ছলে বলে তাকে আটক করতে চায়। কিন্ত এই বাড়িতে যত দিন ওই ছোট্ট নূরজাহানের আত্মা আছে সে কারোর ক্ষতি হতে দেবে না। তোমরা ভাগ্যবান যে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছো। ”
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় ছাদের দিকে নজর পড়লো, দেখি সেই ছোট্ট মেয়েটি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, চোখের জলে গাল দুটো ভিজে যাচ্ছে তার। আমাকে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বাবা জিজ্ঞাসা করে
“কি দেখোস উপরে ? ”
তাকিয়ে দেখি কিছু নেই, সে সেখানে নেই, হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তার অবয়ব।
গল্প শেষ হতেই দিদিমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম, সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে গিয়ে দেখি দিদিমা ছাদে কার সাথে কথা বলছেন, মনে হয় মা ভোরেই ফিরে এসেছে। কিন্তু সারা বাড়ি ঘুরে বাবা কে দেখতে না পেয়ে ছাদে গিয়ে দেখি চিলেকোঠার ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে দিদিমা পাশে একটা ছোট্ট মেয়ে , তাকে কোনোদিন এ পাড়ায় দেখিনি।
দিদিমা ফিসফিসিয়ে বললেন
“নূরী এখন তুই যা, ওরা সবাই এসে পড়বে ,আমি আবার পরে আসবো।”
দেখতে দেখতে চোখের সামনে ছোট্ট মেয়েটির কোথায় যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।।
সমাপ্ত