বিসর্জন

বিসর্জন

৷৷ এক৷৷

সকালবেলা মেজাজটা বিগড়ে গেল দিতির।বলা নেই কওয়া নেই নির্দিষ্ট দিনের পাঁচদিন আগেই শুরু হয়ে গেল ঋতুস্রাব।এইসময় ওর অসহ্য পেটের যন্ত্রণা হয়।মেজাজ ঠিক থাকেনা। তার উপর সকালবেলা শাশুড়ী মা অলোকা দেবী গোটা চারেক শক্ত শক্ত কথা শুনিয়ে দিলেন!আসলে আজ ওর শ্বশুর বাড়িতে কয়েকজন নিমন্ত্রিত অতিথি আসবেন।তাদের জন্য রান্না করতে হবে।এঁরা কেউই দিতির বিয়ের সময় আসেননি।নতুন বউ দেখতে আসবেন।যদিও বাড়িতে রান্নার লোক আছে তবুও বনেদি রায়বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী বাড়ির নিমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য রান্না বাড়ির বৌদেরকেই করতে হয়।তাদের জন্য রকমারী রান্না আবার নিরামিষ উনোনে পারুলবালা দেবী অর্থাৎ দিতির দিদি শাশুড়ির জন্য নিরামিষ রান্না করতে হবে। তিনি বিধবা, মাছ মাংসের ছোঁয়া পর্যন্ত খান না।ভোররাতে গঙ্গাস্নান করে এসে ঠাকুরের নামগান করেন। দিতির শাশুড়ি মায়ের রাগের কারণ হলো এই দুনিয়ার রান্না সব ওনাকে করতে হবে একা হাতে। দিতি কোনো সাহায্য করতে পারবে না। তারকারণ রজঃস্বলা‌‍‍‍ নারীদের বনেদী রায়বাড়ির হেঁশেলে প্রবেশের অনুমতি নেই। এই ক’দিন বাকিদের থেকেও দূরত্ব বজায় রাখতে হয়।কারণ ভুলবশত শাশুড়ি বা দিদি শাশুড়িকে ছুঁয়ে ফেললে বাড়িতে দক্ষযজ্ঞ বেঁধে যাবে।মাঝেমাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে দিতির। নিজেকে কেমন খাঁচায় বন্দী পাখির মত মনে হয়! যেন এই প্রাসাদপম বাড়িটার উঁচু পাঁচিলের ভিতর খোলা নীল আকাশের প্রবেশের কোনো অধিকার নেই!

৷৷দুই৷

ঘুম ভেঙে আড়চোখে একবার স্ত্রীর দিকে তাকালো নীলাদ্রি।বউয়ের মুখে জমে থাকা কালো মেঘের ছায়া চোখ এড়ালো না ওর।তিন মাসের বিবাহিত জীবনে এখনও পর্যন্ত স্ত্রীর মনের নাগাল পায়নি ও।দিতি শান্ত অথচ অসম্ভব দৃঢ়চেতা।ওর ব্যক্তিত্বের সামনে নিজেকে কেমন বেমানান লাগে নীলাদ্রির!না বিয়ের পর থেকে দিতির সাথে হয়ে আসা অন্যায় নিয়ে কোনোদিন স্বামীর কাছে অভিযোগ জানায়নি সে বাকি স্ত্রী দের মত।শুধু মাঝেমাঝে বড় বড় চোখ তুলে শান্ত ভাবে তাকিয়েছে নীলাদ্রির দিকে।উফঃ ! কি গভীর সেই চাউনি!অপরাধবোধে এমনিতেই মাথাটা নিচু হয়ে যায় নীলাদ্রির।না কখনও স্ত্রীর হাতে হাত রেখে বলা হয়ে ওঠেনি যে”দিতি তোমার পাশে আছি আমি!” এই রায় বাড়ির প্রতিটা নিয়মকে, বাবার কড়া শাসন,ঠাকুরদার চোখ রাঙানিকে মেনে নিতে বাধ্য হয় সে।রায়বাড়ির প্রাচীরের ভিতর কোথাও অলিখিত নিয়ম আছে যে এই বাড়ির ছোটরা বিনাবাক্যে বড়দের আদেশ মেনে চলে।কোনো কথা না বলে বাথরুমে ঢুকলো নীলাদ্রি।

৷৷ তিন৷৷

আত্মীয়রা চলে যেতে রাতে ছাদে দাঁড়িয়েছিল দিতি। পশ্চিম আকাশে হালকা মেঘ জমেছে। এই বদ্ধ অট্টালিকার নিয়মের বেড়াজালে ছাদটুকুই যা দিতিকে খোলা নিঃশ্বাস নিতে সাহায্য করে। ইতিহাসে এম.এ করার পর তড়িঘড়ি নীলাদ্রি রায়ের সাথে বিয়েটা হয়ে যায় দিতির।বনেদি বাড়ি আর সুপাত্র পেয়ে তাকে হাতছাড়া করতে চাননি দিতির বাবা।দিতির ইচ্ছে ছিল ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করবে।পুরানো ভারতের গৌরবময় ইতিহাস তাকে বরাবরই টানে।দু এক ফোঁটা বৃষ্টি গায়ে পরাতে নীচে নেমে এলো সে। ভোরবেলা উঠতে হবে।এই বাড়ির নিয়ম হল রাত দশটার মধ্যে সবাইকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে।

‌ বেশ রাতের দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেল নীলাদ্রির।পাশ ফিরে দেখলো দিতি নেই।ভাবল বাথরুমে গেছে।কিন্তু সেখানেও দেখলো নেই।এই ব্যাপারটা এর আগেও বেশ কয়েকবার হয়েছে।তখন অতটা পাত্তা দেয়নি নীলাদ্রি।কিন্তু আজকের ঘটনাটা বেশ ভাবালো ওকে।মাঝরাতে কোথায় যায় দিতি?!ওকে জানতেই হবে।তবে কি লুকিয়ে কারোর সাথে দেখা করতে যায়?কোনো গোপন প্রেমিক কি আছে তার সহধর্মিনীর?একই বিছানায় পাশাপাশি শুয়েও কোনোদিন দিতির মনের নাগাল পায়নি ও।এই জন্যই কি দিতি নিজেকে একটা মোড়কের মধ্যে আবদ্ধ রাখে?হয়তো জোর করেই এই বিয়েটা দেওয়া হয়েছে!নাঃ! আর ভাবতে পারেনা নীলাদ্রি!যন্ত্রনায় মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে।এমন সময় দরজায় হালকা আওয়াজ হতেই ঘুমের ভান করলো ও। দিতি ফিরে এসেছে।

৷৷চার৷৷

ধুস!আজ সবটা কেমন ঠিকঠাক হলো না!সারাদিন মানুষটা তো তারই জন্য অপেক্ষা করে থাকে!সত্যিই তো এই এত বড় বাড়িতে কঠোর অনুশাসনের মাঝে হয়ত দিতি পাগলই হয়ে যেত যদি না এই মানুষটার সান্নিধ্য পেত।বেশ অনেক কথাই মনে পরে যাচ্ছিল দিতির।যখন নতুন বউ হয়ে এই বাড়িতে এসেছিল।আস্তে আস্তে বিছানা ছাড়ল।পাশ ফিরে দেখে নিল গভীর ঘুমের দেশে নীলাদ্রি।তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।তাড়াহুড়োতে খেয়াল করলো না দিতি যে আজ আরো একজোড়া চোখ তার পিছু নিয়েছে!রান্নাঘর থেকে ভাতের থালা আর বাটিগুলো নিয়ে নিচের তলার একেবারে পূবের ঘরের দিকে হাঁটা লাগালো সে।চোখ বড় বড় হয়ে গেল নীলাদ্রির!এ কোথায় যাচ্ছে দিতি!এত তার পিসি ঠাকুমার ঘর।কৌতূহল চাপতে না পেরে দরজার আড়াল থেকে ভিতরে উঁকি মারলো নীলাদ্রি।ভিতরের দৃশ্য দেখে একই সাথে সে অবাক হল আবার তার চোখে জলও চলে এলো।মেহগনি পালঙ্কের পাশে রাখা সেগুন কাঠের টেবিলটার উপর ভাতের থালা রাখা, রকমারি তরকারি সাজানো পাশে। আর সেই ভাত গোগ্রাসে মেখে খাচ্ছেন পারুলবালা দেবী! তৃপ্তিতে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে! “আঃ!

তোর রাঁধার হাতটা বড় ভালো রে নাটবউ!কতদিন পরে খাচ্ছি এইসব! মাছভাতের স্বাদ তো প্রায় ভুলতেই বসে ছিলুম!সেই কোন কচি বয়সে বিধবা হলুম।দাদা বৌদি নিয়ে এসে তাদের সংসারে ঠাঁই দিলো।বনেদি কায়স্থ বাড়ির বিধবা!কত নিয়মকানুন।সাদা থান, ছোট চুল,নির্জলা একাদশী,নিরামিষ খাবার মশলা ছাড়া!জানিস বউ যখন বৌদি সবার খাওয়ার শেষে ভাত নিয়ে খেতে বসত তখন মাছের গন্ধে, পাঠার মাংসের ঝোলের গন্ধে খিদেটা জেগে উঠত!জিভের আগায় জল আসতো।বড় কষ্টে নিজেকে শাষন করতুম।কারোর কাছে চাইতে সাহস হত না যে।বাবা ছিলেন দোর্দন্ড‍্যপ্রতাপ মানুষ, দাদাও তাই।তুই নিশ্চই আগের জন্মে আমার মেয়ে ছিলি নাটবউ!” স্বস্নেহে বিধবা চির দুঃখী মানুষটার দিকে তাকাল দিতি!মৃদু শাসনের সুরে বলল”খেতে খেতে এত কথা বলো না তো তুমি কেউ শুনে ফেলবে!তাড়াতাড়ি খাও। এমন সময় বৈঠকখানার পেল্লায় ঘড়িটা ঢং ঢং করে জানান দিল রাত বারোটা বাজে।

দরজার আড়াল থেকে দুজন অসম বয়সী মহিলার কথোপকথন শুনে লজ্জ্বায় মাথা নামিয়ে নিল নীলাদ্রি।ছিঃ ছিঃ! এমন স্ত্রীর সম্পর্কে সে এতদিন ধরে কি ভাবছিল!এতটা ছোট মন তার! না অনেক হয়েছে সবার চোখ রাঙানি!আর কোনো অন্যায় নিয়ম চলতে দেবেনা সে রায়বাড়ির মধ্যে।দিতির যোগ্য স্বামী তাকে হয়ে উঠতেই হবে।ক্ষমা চাইতে হবে স্ত্রীর কাছে।আর শুধু মুখে নয় এরপর সব অন্যায় নিয়মের প্রতিবাদ করে তবেই সে দিতির পাশে গিয়ে দাঁড়াবে।মাথা উঁচু করে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলবে দিতি পেরেছে রায়বাড়ির অচলায়তন ভাঙতে।তার স্বামীর মধ্যে বিবেকবোধ জাগাতে সক্ষম হয়েছে সে!না এইবার আস্তে আস্তে যেন দিতির মনের নাগাল পেতে শুরু করেছে নীলাদ্রি!স্বামী স্ত্রীর মিলিত প্রয়াসে বিসর্জন হবে রায়বাড়ির সমস্ত কুপ্রথার!নতুন ভোরের আলো প্রবেশ করবে এই অচলায়তনে!

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত