নায়ক

নায়ক

স্থান-বিহারের সামস্তিপুর শহর
সময়-বিকেল ৫টা।

হাবিলদার দীনেশ কুমার বসে ঠিক থানার বাইরে।যদিও ভেতরে বসার জায়গা আছে।বাইরে বসার কারণ ওঁর সাব, মানে সাব ইংস্পেক্টর অধীর বিশ্বাস।অধীর বাবু এই থানায় ট্রান্সফার হয়েছেন তা প্রায় মাস ছয়েক।আগে ছিলেন ওই বড়বাজারের কাছেই।অধীর বাবুর বড্ড বাজে স্বভাব আছে।ঘুষ নেন না, আর নিতেও দেন না! কী জ্বালা হয়েছে।হঠাৎ না, মনে হয় প্ল্যান করেই এই শাস্তি।নিজের বলতে শুধু মা, বাবা ছোটবেলায় মারা গেছেন।এমনই একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখেন বাবা শুয়ে, সাদা কাপড় দিয়ে মোড়া,অনেক লোক ।উনিও পুলিশ ছিলেন, একদিন ওই গুলি লেগে…সে যাকগে।

হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে যাবেন, দরজার কাছে দীনেশ দেখে স্যালুট করে বলে,

-সাব আজ যায়েঙ্গে তো?
একটু লজ্জা আর রাগ নিয়েই অধীর বাবু বলেন ওর বাং-হিন্দিতে,
-রোজ রোজ ঠিক নেহি লাগতা।ভাবী ভি উমিদ সে, কাহে ইতনা তকলিফ….!
ব্যাপারটা কিছুই না।দীনেশ খুব ভালোবাসে ফেলেছে ওঁর স্যারকে।আর বাড়ি ছেড়ে এতদূর এসেও কিন্তু অধীর বাবুর এখন বেশ মন ভালো থাকে।রোজ ডিউটি আসার সময় খাবার করে দেয় দীনেশের বউ।বলে,

-সাবজী কো জ্যারুর খিলানা।
সেই মত পুরো টিফিন বক্স খালি করে তবে যায়।আসলে এই ছয় মাসে অনেক গল্প শুনেছে দীনেশ ওর স্যারের বাবার।ঠিক ওঁনার মত হতে চায়।আজ দাবী হলো ফেরার পথে ওঁর বাড়ি খেতে হবে।সে কিছুতেই মানছে না।অনেক জেদ করার পর অধীর বাবু বলেন,

-ঠিক হ্যায় , কাল নেহি আওগে।এক বার চেক আপ কারাকে লেকে আও উসকো।
-স্যার, পাক্কা যায়েঙ্গে।

সেই মত ও বাড়ি চলে যায়।ঠিক ১১ টায় বেরোন অধীর।পুরোটা শহর হলেও, কিছু জায়গায় কাঁচা পাকা রাস্তা এখনো আছে।গাড়িটা দাঁড় করিয়ে একটু হাঁটতেই হবে।সেই মত দাঁড় করিয়ে নেমে হাঁটতে লাগলেন।হঠাৎ পেছন থেকে লাঠির একটা আঘাত…মাথা ধরে বসে পড়লেন।আবছা চোখে দেখলেন”একি! এত মুন্না” ।মুন্না এখানকার দালাল।তিন মাস আগে গ্রেপ্তার করেছিলেন উনি।রেহাই পায়, লোকাল কাউন্সিলর চেনে বলে।হাতে আজ বন্দুক, ট্রিগারে হাত।অধীর সার্ভিস রিভলবারটা বার করতে যাবে, খেয়াল হলো কানের পাশ দিয়ে গরম কী যেন লাল লাল!! অজ্ঞান হওয়ার আগের মুহূর্তে গুলির শব্দ…আর কিছু মনে নেই।

জ্ঞান যখন ফিরল, দেখলেন হাসপাতালে শুয়ে।এদিক ওদিক পুরো থানা।জিজ্ঞেস করলেন একজনকে,

-দীনেশ?
বউ ঢুকল ওঁর, সন্তান সম্ভবা।পরনে ছাপা একটা বেরং শাড়ি।যাকে জিজ্ঞেস করলেন, সে মাথা নীচু করল।অধীর বাবুর মনে পড়ল একটা কথা।

“স্যার, হামকো ভি শহীদ হোনা হ্যায়।আপকা পিতাজী জিতনা নেহি, উসসে বহত কম”।
পাশে রাখা মানিব্যাগ থেকে ছোট্ট তেরঙাটা বার করলেন।বাঁ হাত দিয়ে সামনে রেখে, স্যালুট করলেন একটা।
স্থান-শিমলা বর্ডারের কাছে

সময়-২ .৪৫

আজ নিয়ে ৭২ ঘন্টা এই গর্তে বসে মেজর রাজীব।পুরো নাম রাজীব সান্যাল।উত্তর কলকাতার ছেলে।গান বাজনা প্রাণ ছিল একসময়।ইচ্ছে ছিল নিজের এলবাম বের করার।কোথা থেকে আর্মির ভুতটা মাথায় চাপল।বাবা মা কিছুতেই রাজি ছিলেন না।দাদুর কথা বলতেই বাবা কেঁদে ফেলেন।দাদু ছিলেন কর্নেল।অনেক গল্প শুনে বড় হয়েছে রাজীব, তাই হয়তো এই পাগলামী। যাই হোক প্রথম প্রথম যখন ডিউটি থেকে ফিরত, সারাদিন গল্প করত বাবার সাথে।ওর বাবার বড্ড গর্ব অনুভব হতো।যে ভয়টা দিয়ে এক মাত্র ছেলেকে মানুষ করেছিলেন, আজ সেই ভয়টা আর নেই।কার্গিলের পর যখন বাড়ি ফেরে, ওঁর বাবা শুধু বলেন,

-আগে দাদুকে গিয়ে জানা এক্ষুনি।

সেই মত দাদুর সামনে সেদিন গর্বে স্যালুট ঠুকেছিল রাজীব।সেবার যখন বিয়েটা ঠিক হয় শ্রীনন্দার সাথে।একবার গিয়ে হাজির হয় তার বাড়ি।শ্রীনন্দাকে ডেকে বলেন,

-তুমি বিয়েতে হ্যাঁ করলে! আমি কিন্তু ছয় সাত মাস ও বাড়ি ফিরি না।থাকতে পারবে তো?
সে শুধু বলে,

-তার পরে এক দিন তো পাব।
আর দাঁড়ায় নি রাজীব।বাড়ি এসে হ্যাঁ বলে দেয় বাবাকে।সেই বৈশাখে বিয়ে হয়ে যায়।
আজ সমস্যাটা হলো , তিন দিন আগে যখন ফোন করে, শ্রী নিউজটা দেয়।বলে,
-তুমি কোনোদিন টিভিতে নাচের প্রোগ্রাম দেখতে?
অবাক হয়ে বলে,

-না
তারপর বলে,
-তাহলে ক্রিকেট?
-একদম।শচীন পাগল আমি!
-ধুর তাহলে ছেলে!!

এইটুকু বলেই চুপ করে যায় শ্রী।রাজীব চিৎকার করে ফেলে আনন্দে।ব্যাস তারপর থেকে সংযোগ হীন।খুব ইচ্ছে করছে এখন ওর শ্রী এর গলা শুনতে।আসে পাশে কিছু ক্ষণ পর পর এত গুলির আওয়াজ।ভালো করে ভাবতেও পারছে না।ধুর, বন্দুকটা নিয়ে আবার পজিশন নেয় রাজীব।পাশে থাকা লেফটেন্যান্ট অজিত কে আলতো করে শুইয়ে দেয় এবার।কিছুক্ষন আগেই গুলি লাগে যে,!বন্দুক চালানো শুরু করে রাজীব।আচমকা একটা গুলি ডান কাঁধ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল যেন।ছিটকে বসে পড়ল একটু।চোখটা সামান্য বন্ধ হচ্ছে..এই তো শ্রীকে দেখতে পাচ্ছে, বিয়ের সাজে, সেই বেনারসী তে।একটু দূরে পরে থাকা তার যন্ত্র তুলে খবর দেয় ও।না, বাঁচতে হবে ওকে, ও থেমে গেলে এত কোটি কোটি মানুষ আশ্রয়।হীন হয়ে যাবে এক নিমেষে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত