“ও বৌদি!ও মাসিমা!ও দিদিভাই! দূরে দাঁড়িয়ে কি ভাবছেন?চট করে চলে আসুন,ঝট করে কিনে ফেলুন,হরেকমাল ৩০ টাকা”
পাড়ার মোড়ে মাইক বাজতে শুনেই বউ মেয়েদের ভিড় ভ্যান ঘিরে।রকমারি রঙের ঘরের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিসের ভারে ভ্যানওয়ালা প্রায় ঢাকাই পড়ে গেছে।সেখান থেকেই মুখ তুলে চাহিদা মতো জিনিস নামিয়ে দিচ্ছে হাত বাড়িয়ে।সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর লেপা বউটা বহুক্ষণ এটা সেটা নেড়ে চেড়ে ঘোমটা টানা আঁচলের খুঁট খুলে হিসেব করে।শেষমেশ ছোটো বালতি আর গামলাটাই বাদ দেয় বাছাই করা জিনিসের থেকে।শাশুড়ি পুজোর কাজের জন্য নিতে পাঠিয়েছিল।হয়তো একটু মুখ ঝামটা শুনতে হবে বাড়ি ফিরে,এই বেড়ে পাকামির জন্য।সদ্য বিয়ের গন্ধ গা থেকে না মোছা বউটা এক জোড়া বাহারী ছবিওয়ালা কাপ নেয়,দুজনে একসাথে বসে একই রকম কাপে রোজ চা খাবে সকালে।এমনিতেও লোকটা একটা হাতল ভাঙা কাপে রোজ এ হাত ও হাত ফুইয়ে ফুইয়ে গরম সইয়ে নিয়ে চা খায়।এবার থেকে আমেজ করে খাবেখন একটু।শাশুড়ি করুক হ্যাটা,এটুকু তো সওয়াই যায়,এটুকু তো করাই যায়।
ভ্যান ওয়ালাকে তারস্বরে মাইক বাজানো কম করতে বলে লোকটা ঠিকানা খুঁজে চলে একে তাকে প্রশ্ন করে।খুঁজে পায় কমলার আস্তানা,বস্তির ছোট্ট একটা কুঁড়ে।কমলা মালসা পুড়িয়ে সবে খেতে বসার জোগাড় করেছে ছেঁড়া তাপ্পি লাগানো আসন পেতে।হবিষ্যান্নের হাজারো নিয়ম,শাউরি বেঁচে থাকতে বলতো সেসব হামেশাই।একবসাতে খেতে হবে,খাওয়ার মাঝে কেউ ডাকলে কিংবা এঁটো পাতে চুল বা কাঁকর পড়লে খাওয়া পন্ড।হকারদের মাইকের আওয়াজে অতিষ্ঠ কমলা দরজা আঁটতে যায় খেতে বসার আগে,পাছে কেউ ডেকে খাওয়া ভন্ডুল করে।তখনই দরজার কাছে এসে লোকটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে যায় একটা বড় প্যাকেট।আহা কি সুন্দর বাস্না!কি সুবাস,গোবিন্দভোগ চাল,মুগের ডাল,আলু,সব্জি,আর… আর একটা বড় ঝর্ণা ঘি এর বোতল।বোতল টা খুলতেই ঘর টা গন্ধে ম ম করে,শুকনো চোখ দুটো জলজল করে ওঠে।এই এক সেদ্ধ ভাত মুখে রোচে না মোটে, আজ সবে ৬ দিন, গলা দিয়ে নামতে চায় না,পেটের খিদে পেটেই মরে।
পাঁচ বাড়ি কাজে যাওয়া থেকে ছুটি এ কদিন,হরেকরকম টিফিনের ও বালাই নেই।রান্নার কাজ যে বাড়িতে, সে বাড়ির দাদাবাবু মানুষ ভালো,খবর পেয়ে তাই ঠিক হবিষ্যির যোগানে এত কিছু দিয়ে গেল।ঘি এর কৌটোর ওপরে চকচকে প্লাস্টিকের কাগজ টা সরিয়ে বুক ভরে ঘ্রাণ নেয়,চামচে করে লোভী চোখে পাতের এক কোণে বড় একদলা ঘি ঢালে।নতুন কড়কড়ে সাদা থানের আঁচলে কপালে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মোছে কমলা,উনুনের ধোঁয়াতে ঘরটা গুমোট হয়ে গেছে।হাতপাখাটা হাত বাড়িয়ে আয়নার সামনে থেকে আনতে যায়,বেড়ায় ঝোলানো আয়নার সামনে ছোট্ট সিঁদুর কৌটোর দিকে চোখ চলে যায়।গ্রাস মুখে তোলার আগেই,খানিকক্ষণ স্থির হয়ে থেকে পাতের কোণ থেকে ঘি এর দলাটা তুলে ফেলে দেয় মাটিতে।মনে পড়ে যায়, লোকটার কথা,বুকের ব্যামো ধরেছিল,বড় স্বোয়াদের জিভ ছিল তেনার।কতদিন কমলার কাছে আবদার করেছে গত শীতে একটা ঘি এর কৌটো আনার জন্য।কমলা ঘন ঘন হাঁপ ধরা দেখে ভেবেও ছিল,করুক গে ডাক্তার বারণ,এ লোক আর বেশীদিন নেই লক্ষণেই ডাক দিচ্ছে বুকের ভেতর।সামনের মাস পড়লে যা হোক দাম,একটা ঘি এর কৌটো আনবেই।বড্ড তাড়া ছিল লোকটার।পরদিনই,ঠিক তার পরদিনই যেতে হলো।এ খাওয়া রোচে না মুখে,এই তো শোকের চিহ্ন,এ কদিন বই তো নয়,একটু কষ্ট হোক না কেন।কমলা মুখ বুঁজে কোনক্রমে গিলতে থাকল এক সেদ্ধ ভাত।শেষ কাজ টুকু তো,হোক কষ্ট,এটুকু তো সওয়াই যায়,এটুকু তো করাই যায়।
মাইক বাজাতে বাজাতে ততক্ষণে ভ্যানওয়ালা এগিয়ে চলে রকমারি জিনিসের পসরা সাজিয়ে।প্রতিটা পাড়ার এ মাথা ও মাথায় লোক বুঝে আধঘন্টা, পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে বিক্রি করে।বাজার আজকাল মন্দা,লোকে তেমন হকারদের থেকে কিছু কেনেনা, ওই গরীব গুর্বো বাড়ির ঝি বউরা একটু আধটু যা ভিড় জমায়।তাও বেশীরভাগই জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে চলে যায়।রফা করার উপায় খোঁজে কম দরে আরও,সুবিধে না করতে পেরে গজগজ করে চলে যায়।দুই বিনুনী বাঁধা মেয়ে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে একটা সুন্দর কাজ করা আয়না পছন্দ করে, যাতে ওপরে গোলাপকাটা নকশা করা,একপিস মালই পড়ে রয়েছে কদিন।ভাঁজ করা তিনটে ময়লা দশ টাকার নোট ধরিয়ে সে মেয়ে আয়না হাতে রওনা দিতে গেলে ভ্যানওয়ালা পিছু ডাকে, ‘ও, দিদিমণি, ওটা বিক্কিরি না আছে’। মুঠো খুলে তিরিশ টা টাকা ফিরিয়ে দেয়, ফিরিয়ে দেয় খরিদ্দারকে এই প্রথম।অল্পবয়সী বউটার কোনো শখ আহ্লাদ বায়না নাই,ফাটলধরা ভাঙা কাঁচে ই মুখ দেখে,সিঙ্গার করে,চুল বাঁধে।কদিন ধরেই মন হচ্ছে,এ আয়নাটা ওরে দিতে,ব্যবসায় এমনকি ক্ষতি হবে আর এতে।হলে হোক একটুআধটু লস,এটুকু তো সওয়াই যায়,এটুকু তো করাই যায়।
হ্যাঁ সত্যি এটুকুই তো করার।এটুকু তো করাই যায়, এটুকু তো সওয়াই যায়।
কারণ, এটুকুই তো ভালোবাসা।আর বেশী কিছু নয়।ব্যস এটুকুই।