শ্রাবণের পূর্ণিমার চাঁদটাকে সন্ধের আকাশে মেঘের গায়ে নির্লিপ্তভাবে শরীর এলিয়ে ঝুলে থাকতে দেখে নরেন কান থেকে বিড়িটা নামিয়ে মুখে নিয়ে ধরিয়ে এক লম্বা টান দিলে। তারপর ধোঁয়া ছেড়ে বললে,”কাইল ছুটোবাউর নাতির মুকে ভাত। গেরামের হক্কলরে যাইতে কইসেন। দুফুরে খ্যাঁটন আসে। ভালাই হইসে। একবেলা প্যাট ভইর্যা হরেক রকম খাইতে পারুম রে বৌ। ভরা শারবন মাস। ঠিক ইলিশ করবে, দেইখ্যিস। উই যে বচ্ছর ছুটোবাউ নাতির বিয়া দিলো, তহন খাইসিলাম ইলিশ। আহা, বড় সোয়াদ আসিল রে বৌ।
তুই তো পোয়াতি আসিলি, ভরা প্যাট বইল্যা গেলিনা। খাইতেও পাইলি না।“ নরেনের বৌ ময়না ভাতের হাড়িটা উনুন থেকে নামিয়ে নরেনের দিকে তাকায়। উনুনের আঁচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। গ্রামের নদীর পাশে একফালি জমি দখল করে নরেনের বাবা একখানা ছোট মাটি আর দরমা দিয়ে বাড়ি করে গিয়েছিল, তাতেই বৌকে নিয়ে থাকে নরেন। ঘরের দুহাত দুরেই একটা বটগাছ আছে। ময়নার চোখে উদাসীনতা দেখে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় গাছটার কাছে। মাথা তুলে গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। সঙ্গেসঙ্গে জলের ঘূর্ণির মতো বুক খালি করা এক শূন্যতাবোধ ওকেখামচে ধরে – বুকের একেবারে গহিন থেকে দলা-দলা কান্নারদীর্ঘশ্বাস ঠেলে এসে ফের বাতাসে মেশে – যেন তছনছ করাকূল-কিনারাহীন এক আবর্তে পড়ে রিক্ত-নিঃস্ব হওয়াটাই ওরনিয়তি। ময়নার উদাসীন চোখ নরেনকে আকুল করে তোলে। দিন, মাস, বছর মনে নেই কবে পেটে মুরগীর ঝোল- ভাত, মাছ গিয়েছে, গন্ধও পায় না আজকাল। সংসারে খালি অভাব আর অভাবের জন্য মেপে খেতে গিয়ে পেট ভরে না। মাঝে মাঝে সে স্বপ্ন দেখে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে ভগবান এসে তার সংসারের অভাব, কষ্ট সবকিছু জাদুকাঠি দিয়ে দূর করে দিচ্ছেন।
কিন্তু ভগবানের অত সময় নেই, তাই রোজ অভাব যাপন চলে ওদের। নরেনের জীবনে কোন গল্প নেই, শুধু রোজ বেঁচে থাকার পাঁচালিটুকু ছাড়া।
নরেন আবার তার বৌ এর দিকে তাকিয়ে দেখে। ছাব্বিশেই চেহারা শুকিয়ে বুড়োটে হয়ে গিয়েছে। বাচ্চাটা জন্মানোর পর বেশীদিন বাঁচেনি। অপুষ্টির জেরে ময়নার বুকে পরিমাণ মত দুধ ছিল না, আর কৌটোর দুধ কেনার মত ট্যাঁকের জোর নরেনের ছিল না। গায়ে গতরে খেতে পয়সা রোজগারের সদিচ্ছা নরেনের সেইভাবে ছিলও না। অভাব –অনটন, খিদের কষ্ট থাকলেও নরেন খেটে খাওয়া মানুষ হয়ে ওঠেনি। নরেনের বাবা গ্রামের নামকরা কুমোর ছিল। বাবার কাছ থেকে নরেন কাজ শিখে ছিল ঠিকই, কিন্তু মাসে ঐ আট কী ন’টা হাড়ি – কলসি বানিয়ে হাটে গিয়ে বেচে যা পয়সা আয় হত, তাই দিয়েই পুরো মাস চালিয়ে দিতো কোনরকমে। গরু বা কৌটোর দুধ তার কাছে তাই চরম বিলাসিতা ছিল। শুকনো বুক টানতে টানতেই ট্যাঁ ট্যাঁ করে চিৎকার করে উঠত ছেঁড়া কাপড়ের ন্যাকড়ায় জড়ানো প্রাণটা, কাঁদতে কাঁদতেই হেঁচকি উঠে যেত।
ময়না অল্প অল্প করে জল খাইয়ে দিত, যদি এতে পেটটা ভরে বাচ্চাটার। কুড়ি দিনের মাথায় মরেই গেল ময়নার বুক চুষতে চুষতেই, কোন শব্দ না করেই। ট্যাঁ ট্যাঁ করে করে বাচ্চাটাও ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল বোধহয়! ময়নাটাও শুকিয়ে যেতে শুরু করলো যেন আরও তারপর থেকে। বিছানাতেও আজকাল নরেনকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ময়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এতসব কথা মনে ভাবতে ভাবতেই আরও জোরে জোরে বিড়িতে টান দিলো নরেন। বৌটা আজকাল আর তার বশে নাই। আজকাল আবার হাটেও যায় বাড়ির উঠোনে ফলানো লাউ – কুমড়ো –পুঁই আর বনবাদাড় থেকে শাকসবজি তুলে নিয়ে বিক্রি করতে। কখনো কখনো গ্রামের বাবুদের বাড়িতে ফাইফরমাশও খেটে দিয়ে আসে। তাতে আজকাল ভাত, নুন, তেল, ডাল, আলু রোজ জুটে যাচ্ছে অবশ্য। নাহলে তো মাঝে মাঝে বাঁশের কঞ্চি আর কন্দ সেদ্ধ বরাদ্দ ছিল পাতে। নাহলে চেয়েচিন্তে ভাতের মাড় নিয়ে এসে তাতে নুন-লঙ্কা মিশিয়ে তাই খেয়ে থাকতে হত তাদের।
ইলিশ-নদী-সংসার কোনকিছুই আর ময়নাকে টানে না। মরে যাবার পর বাচ্চাটাকে নদীর চরায় পুঁতে আসার পর থেকেই অনুভূতিহীন মানুষে পরিণত হয়েছে সে। নরেনের সাথে তার মানসিক ব্যবধান বেড়েছে। “ইলিশ খাতি ইসসা করে তো কামে যাও না ক্যান? গেরামের জেলেদের লগেও তো যাতি পারো কামকাজে। পয়সা কামাইবা না, খালি খাতি ইসসা করে তুমার। ” মুসুর ডাল ধুতে ধুতে খরখরে গলায় ময়না মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে। খর খর খর খর – হঠাৎ শব্দে ময়না মুখ ফেরায়। নরেন শ্যাওলা পড়ে যাওয়া কুমোর চাকটা ঘোরাচ্ছে। “তুমি হঠাৎ অহন চাক নিয়া বসলা? আন্ধারে দ্যাখতে পারবা? আলো তো ত্যামন নাই।“ ময়না চোখ ভরা নির্বোধ দৃষ্টি দিয়ে নরেনের দিকে তাকিয়ে বলে। নরেন কোন কথা বলে না। এক তাল মাটি নিয়ে চাকে বসিয়েই চাক ঘোরাতে শুরু করলো।
ময়না জানে তার বরের গতর নাড়িয়ে খেটে রোজগারের স্বভাব নেই। মাথাও স্বাভাবিক মানুষের মত কাজ করে না। তবে বরটা তার খারাপ না। “আরে বানাইতেসো ডা কী?” ময়না কুপি হাতে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে। নরেন এখনও উত্তর করে না। চাকের সাথে সাথে তার হাত ঘুরছে। চোখে তখন তার মরা বাচ্চাটার মুখ ভাসছে। একটা শিশু শরীর নরেনের মাথায় ভর করেছে তখন। ময়না দেখছে চাক ঘুরছে, নরেনের হাত ঘুরছে তার সাথে। ময়না ফিরে যায় রান্নার জায়গায়। মাটির হাঁড়িতে তখন মুসুর ডাল সেদ্ধ গন্ধ ছড়িয়েছে। হাঁড়ি নামিয়ে একটা ডাব্বু হাতায় সামান্য তেল ঢেলে অল্প কালোজিরে, কুচোনো পেঁয়াজ আর লঙ্কা ফোঁড়ন দিলো। ফোঁড়নের ঝাঁঝালো খিদে বাড়ানো গন্ধে নরেন চাক ঘোরাতে ঘোরাতেই ময়নার দিকে ঘাড় ঘোরায়। বুকের ভেতর হঠাৎ যেন কিসের বান ডাকে। সংসারের নৌকাটা ভাসছে তার। ময়নাকে হঠাৎ লক্ষ্মী ঠাকুর লাগে নরেনের। কুমোর চাকে মাটির তাল রুপ নিচ্ছে লক্ষ্মীর সরার। বুকের ভেতর লক্ষ্মীর সরা বানানোর তৃপ্তিজাগে নরেনের।
ডেকে ওঠে ময়নাকে “ যাবিনি রে বৌ কাইল? চনা যাই। যাবি?” ফোঁড়ন সহ তেলটা সেদ্ধ মুসুরডালে ফেলতেই চিড়িক চিড়িক হাল্কা শব্দ আর ডালের গন্ধ বাতাসে ছড়ায়। কলাই এর প্যানে ডালটা ঢালতে ঢালতে ময়না বলে “ কুনোদিন বড়লোকের বাড়ি খাইতে যাই নাই। ত্যানাদের আদব কায়দা অন্যরকম। আমরা হইলাম ছুটোলোক। মনে বড় আশঙ্কা লাগে গো। থাউক গা। তুমিই যাও। আমারে বাদ দ্যাও।“ নরেন চাকের দিকেই দৃষ্টি রেখে জবাব দেয় “ তাইনেরা হইলেন বড়লোক, আর আমরা ছুটোলোক। কিন্তু বৌ , দুয়োজনের শ্যাসেই কিন্তু লোক কথাখান আসে। আমরা দুয়োজনেই তো দিনের শ্যাসে গিয়া লোকই তো। তাইতেই তো শান্তি পাই রে আমি। যাবি? চ না যাই!“ ময়না তাকায় নরেনের দিকে। দেখে বরটার গায়ে একফালি গামছা খালি। সারা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। উনুন ছেড়ে এগিয়ে এসে নরেনের পাশে উবু হয়ে বসে। হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় । শ্রাবনের আকাশের চাঁদ তখন গাঙপাড়ের এই নিরালা সংসারে একটুখানি শান্তি, একটুখানিদরদ, একটুখানি ভালোবাসা আলো ছড়াতে শুরু করেছে।