পরিবর্তন

পরিবর্তন

রিশান বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। এমন কোনো খারাপ অভ্যাস নেই যা ওর মধ্যে না আছে। বাবা মা বোঝাতে বোঝাতে হতাশ। ছোট বোনটাও সবসময় চিন্তত থাকে। কিন্তু রিশানের এতে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ও ওর মতো লাইফ লিড করে। খারাপ বন্ধুবান্ধব, সিগারেট, ইভটিজিং, এমনকি মদ গাজা পর্যন্ত খায় ও। ভার্সিটির এমন কোনো মেয়ে নেই যার সাথে ওর সম্পর্ক নেই। এত খারাপ হওয়া সত্বেও সব মেয়েরা ওর জন্য পাগল। কিছু ওর সুদর্শন চেহারায় কিছু ওর টাকায়। ও ও এর সুযোগ নেয়। কিন্তু ওকে কেউ নিজের মায়ায় বাধতে পারিনি। এমনই একদিন মদ খেয়ে মাতলামো করতে করতে যাচ্ছিলো রিশান আর ওর বন্ধুরা। এমন সময় কয়েকজন গুন্ডা টাইপ লোক এসে সবার সামনে রিশানের পেটে ছুরি মেরে দিল। ওর বন্ধুরা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। আর গুন্ডা গুলোও দাড়ালো না। কোনো লোকই ভয়তে রিশানের কাছে আসছেনা। ওদিকে রিশানের অবস্থা বেগতিক প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে। ওর চিৎকারে চারিদিক থেকে মানুষ জড়ো হয়ে গেছে কিন্তু কেউ কিছু করছে না।

এমন সময় মাথায় ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকা একটা মেয়ে এগিয়ে এল। রিশান তখনো বেহুশ হয়নি। মেয়েটা যে রিকশা করে যাচ্ছিল ঐ রিকশায়ই রিশানকে তুলে নিল। সবাই মানা করছিল মেয়েটাকে কিন্তু ও সবাইকে বলল। মনুষের জীবন বাচানো ফরজ কাজ তাই যাই হয়ে যাক মানুষটাকে বাচাবে ও। ওদিকে রিকশা চলতে শুরু করেছে। কিন্তু রিশানের রক্ত পড়া কমছেনা দেখে মেয়েটা রিকশার হুড তুলে মাথা থেকে ওড়নাটা খুলে ওর পেটে বেধেদিল। তখনই মেয়েটার চেহারা প্রথমবারের মত দেখতে পেল রিশান। ওর চোখ টা অবশ্য আগেই দেখেছিল ও। কিন্তু বেশিক্ষন হুশ রাখতে পারলনা ও।

হসপিটালে এসেই হুশ হলো জান্নাতের। তার মাথার কাপড় তো এই লোকটাকে বেধে দিয়েছে এখন কি করে রিকশা থেকে নামবে ও। রিকশা ওলার গলায় একটা বড় গামছা ঝুলতে দেখে ও বলল,

চাচা কিছু মনে না করলে গামছাটা কি দিবেন তড়হুড়ায় আমার ওড়নাটা ওনার পেটে বেধে দিয়েছি।
অবশ্যই মা এই লও। তোমার মতন ভালা মাইয়ার কাজে আসলে আমারই খুশি লাগব।
ধন্যবাদ চাচা।

বলে গামছাটানিয়ে মাথায় বেধে নিল জান্নাত। তারপর রিশানকে ধরাধরি করে ভিতরে নিয়ে গেল ও। রিশানকে দেখে রিসেপশনিস্ট এগিয়ে এল। ওকে এখানের সবাই কমবেশি চিনে। এটা ওর কাজিন ফারহানের হসপিটাল। ফারহানকে সাথেসাথে কন্টাক করা হলো। ফারহান ভাইয়ের অবস্থা দেখে তাকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরলে জান্নাত বেড়িয়ে গেল।

হুশ ফিরলে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করল রিশান। পাশে কান্না ভেজা চোখে মা আর ছোটবোন বসে আছে। আর বাবা পুলিশের সাথে কথা বলছে। রিশানের হুশ ফিরতে দেখে মা বাবাকে ডাকল ওর ছোটবোন। বাবা মা এগিয়ে এল ওর দিকে। কিন্তু ওর সেদিকে খেয়াল নেই। ওর চোখ বারবার মেয়েটাকে খুজছে। বাবা বলল,
আরমান কে পুলিশ ধরে ফেলেছে। তুই চিন্তা করিস না।

আরমানের কথা শুনে বুঝতে পারল যে আরমানের গালফ্রেন্ড প্রিয়াকে ছিনিয়ে নেওয়ার প্রতিশোধ নিয়েছে আরমান। কিন্তু সেদিকে খেয়াল না দিয়ে আস্তে করে বলল,
ও কোথায়?
কে?
যে এখানে এনেছে আমাকে।
ও হ্যা ফারহান বলেছিল একটা মেয়ে নাকি নিয়ে এসেছিল তোকে। কিন্তু তোকে রেখে কোন ফাকে বেরিয়ে গেছে কেউ জানেনা।
এ পর্যায়ে রিশানের বোন রিশা বলল,

তবে ওর ওড়নাটা আমার কাছে আছে ফারহান ভাই দিয়েছে। ওটা দিয়ে নাকি তোর পেট বাধা ছিল।
আমাকে দিস তো ওটা।
কি করবি‌ ওটা দিয়ে?
যদি দেখা হয় ওকে দিয়ে Thanks জানাবো।
আচ্ছা আমি ধুয়ে রাখব।
হুম।

প্রায় এক সপ্তাহ পর রিলিজ হলো রিশান। আর একমাস পর থেকে কলেজে এল। এই একমাসে অনেক পরিবর্তন হয়েছে রিশানের। যদিও টোটালি বেড রেস্টে ছিল। কিন্তু বেশ চুপচাপ হয়ে গেছিলো।

কলেজে এসে আগের মত আড্ডা দেয় না। আগের বন্ধুদের সাথেও মেশেনা ও। আর মেয়েদেরও তেমন পাত্তা দেয়না ও। এই দুদিন রিশানের বিহেভিয়ারে সবাই অবাক হয়ে গেছে।

আজ দুদিন পর কলেজে এল জান্নাত। এমনিতেও এই কলেজ টা ওর বেশি ভালোও লাগেনা। আব্বুর বদলির কারণে মাঝের দিকে বাধ্য হয়ে এই কলেজে এসে ভর্তি হতে হয়েছে।

কলেজ ক্যাম্পাসে একাএকা বসে ছিল রিশান। হঠাৎ করে কলেজ গেটে তাকাতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো ও। গেট দিয়ে ঢুকছে ওর অতি প্রতিক্ষিত মানুষটা। আজও ওড়না দিয়ে মুখ বাধা। তবে চোখ দেখেই চিনতে পারল ও। দেরি না করে এগিয়ে গেল ওর দিকে।

অপরিচিত এককজনকে নিজের দিকে আসতে দেখে অসস্তি বোধ করল জান্নাত। রিশান ওর কাছে এসে বলল,
কি চিনতে পেরেছেন আমাকে?
না তো কে আপনি?
বাহ যার জীবন বাচাঁলেন তাকে ভুলে গেলেন।
ওহ আপনি । এখন কেমন আছেন।
জ্বি ভালো।
এই কলেজে পড়েন?
হ্যা ফাইনাল ইয়ারে। আপনিও কি…..
হ্যা সেকেন্ড ইয়ারে।
ওহ। আমি রিশান চৌধুরি। আপনার নাম জানা যাবে?
হুম জান্নাতুল ফেরদৌস জান্নাত।

আন্তরিকতার খাতিরে কথা বললেও খুবই অসস্তি বোধ করছিল জান্নাত। তাই কথা না বাড়িয়ে ক্লাস আছে বলে চলে এল ও।
রিশান জান্নাত কে দেখে অসম্ভব খুশি হলো। কলেজ লাইব্ররি তে গিয়ে জান্নাতের ব্যাপারে সব জেনে নিল ও। বাড়িতে ফিরে মা-বাবাকে সব জানালো ও। আর এটাও বলল ও জান্নাত কে বিয়ে করতে চায়। মি: আর মিসেস চৌধুরি ভাবলেন। বিয়ে দিয়ে হয়তো ছেলেকে পরিবর্তন করতে পারবেন। তাই একটা নির্দিষ্ট দিনে ছেলেকে নিয়ে জান্নাতদের বাড়িতে গেলেন তারা। গিয়েই বুঝলেন বেশ ইসলামিক মাইন্ডেড ফ্যামিলি জান্নাতরা। জান্নাতের মা নেই। বাবা আর ফুফুর হাতে মানুষ। ওনারা জান্নাতের বাবাকে সব বললেন। সব শুনে তিনি ভেতরে গিয়ে আবার ফিরে এলেন। এসে রিশানকে উদ্দেশ্যকরে বললেন,
আমার মেয়ে তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চায়।
আচ্ছা চলুন।

না যেতে হবেনা এখানেই বোসো।
বলে তিনি বসার ঘরের পর্দাটা ঠিক করে টেনে দিলেন।
জান্নাত পর্দার ওপাশ থেকে সবাইকে সালাম দিল। সবাই সালামের উত্তর নিলে ও বলা শুরু করল,
দেখুন আমি জানিনা আল্লাহ কার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। কি উদ্দেশ্যেইবা সেদিন আপনার সাথে এভাবে দেখা হয়েছে। কিন্তু কিছু কথা বলতে চাই আপনাকে। আমি স্বামী হিসেবে এমন একজনকে চাই যে রোজ পাচঁ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে মসজিদে গিয়ে। এবং আল্লাহকে ভয় করে সমস্ত খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। প্রতিদিন একবার করে হলেও কোরআন পাঠ করে। কোনোদিন বেগানা নারীকে স্পর্শ করা তো দুর কথাও বলেনি। আর হ্যা সবথেকে বড় কথা সে যেন নবীর সুন্নত গুলো পালন করে। আমি আপনার ইতিহাস সম্পর্কে জেনেছি। সব জেনে আপনার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার ছিলনা কিন্তু আপনি আমাকে দেখে ফেলেছেন। তাই ভাবলাম আপনাকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। আপনাকে আমি একবছর সময় দিলাম যদি এই একবছরে নিজেকে বদলে আল্লাহর নিকট নেক মনে তওবা করেন তাহলে আপনাকে বিয়ে করতে আমার কোনো আপত্তি নেই। এই একবছর আপনার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ থাকবেনা।
সব শুনে রিশান একটু ভেবে উত্তর দিল,
আপনার সব শর্তে আমি রাজি আছি।
বলে পরিবার সহ বেড়িয়ে এল ও।

বাসর ঘরে বসে আছে জান্নাত। রিশান রুমে ঢুকে সালাম দিল ওকে। সালামের উত্তর নিল জান্নাত। পরে ওকে নিয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ল রিশান। নামাজ শেষে বিছানায় এসে বসল দুজন। রিশানের মুখে দাড়ি খুব সুন্দর লাগছে জান্নাতের। কিছুক্ষন মন্ত্রমুগ্ধের মত দুজনদুজনার দিকে তাকিয়ে থাকল। একটুপরে জান্নাত বলল,
আচ্ছা তোমার কষ্ট হয়নি এত বছরের অভ্যাস বদলাতে।

সত্যি বলতে প্রথম দিকে খুব কষ্ট হতো । পরক্ষনেই তোমার কথা মাথায় আসত। কিন্তু তবুও হাপিয়ে উঠছিলাম। কিন্তু যখন আল্লাহকে ভালোবাসতে শুরু করলাম তখন আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেল।
ধন্যবাদ আমার ইচ্ছা গুলো পুরণের জন্য।

তোমাকেও ধন্যবাদ আমাকে সঠিক পথে আনার জন্য। আর বাবা জানতে চাইছিল হানিমুনে কই যাবা।
একটু মুচকি হেসে জান্নাত জবাব দিল,
হানিমুন নয় আমি তোমার সাথে হজ্ব করতে যেতে চাই।
আলহামদুলিল্লাহ অবশ্যই।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত