আজ থেকে প্রায় বছর সাতেক আগে আমার প্রথম প্রেমের বিচ্ছেদ ঘটেছিল। সেই সময় পরিস্থিতি বুঝবার মতন বুদ্ধি তেমন একটা হয় নি আমার, আবার কষ্ট লুকিয়ে হাসবার মতন ক্ষমতাও সেই সময় ছিলো না। বিচ্ছেদক্ষণে মেঘের গর্জনের ন্যায় হৃদয় ধরাস্ করে উঠেছিলো, মুখবিবর কালো মেঘাবৃতাম্বরের ন্যায় মলিন হয়েছিল, চোখ থেকে অশ্রুবারি ঝরছিল। কয়েকদিন অভুক্ত থেকে, অনিদ্রিত থেকে ক্রমাগত কান্না করেছিলাম।
অতঃপর, বেশ কিছুদিন পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলো। মনের মেঘ কিছু কাটলো। কান্নার বিরতি ঘটলো, তবে সমাপ্তি নয়; তার জন্য নিশিক্ষণ নির্বাচন করা হলো। প্রতি রাতেই বালিশে মুখ লুকিয়ে কান্না করতাম, বালিশ ভিজাইতাম, কান্না করতে করতে একসময় চোখে ক্লান্তি চলে আসতো, এরপর শান্তিতে ঘুমিয়ে পরতাম।
এরপর ধিরে ধিরে পরিবর্তন হলাম। হৃদয়ের কম্পনরোধ হতে সময় লাগলো তিনমাস। মুখের মলিনতা বিলীন হতে সময় লাগলো পুরো একটা বছর। ধীরে ধীরে বর্ষার মেঘ, শরতের শিউলি হয়ে হাসতে থাকলো আমার মন। অশ্রুবারিধারাও নিঃশেষ হয়ে গেলো। তবে অশ্রু কিন্তু শুকিয়ে যায় নি, অশ্রুক্ষরনের কারণটা নির্জীব হয়েছিলো মাত্র।
এভাবেই পাঁচটি বৎসর কেটে গেলো। ইতিমধ্যে শোকগুলি সব আনন্দে পরিনত হলো। সেগুলি আর কান্নার কারণ রইলো না। মনমধ্যিখানে কালো মেঘের চিহ্ন খানিও রইলো না,ঝকঝকে নীলাকাশের আবির্ভাব হলো। আর সেই নীলাম্বুরের মধ্যবিন্দু হলো লাল, দিপ্তীময়, তেজী সূর্য।
হ্যাঁ, হৃদয়ের চিত্রপটে চিত্রিত হলো আরেক বিনোদিনী কণ্যার; আমার পরিণত প্রেম। পূর্বপ্রেমে প্রেমান্ধ হয়ে রুপ, গুন দেখেছিলাম; এতে রূপে, গুনে মোহিত হয়ে প্রেমান্ধ হলাম। এই বিনোদিনী কণ্যার রূপ বর্ণনা করবার সাধ্য আমার নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি যে, অতিমাত্রায় স্নিগ্ধতায় ভরপুর তার মুখবিবর। চক্ষুদ্বয়ের কথা বলতে পারব না, কারণ বহুবার চেষ্টা করেও তার দিকে তাকাতে পারি নি। চিত্র দেখে বুঝেছি তা অতীব মায়াবী; এক স্বচ্ছ দীর্ঘিকায় ভাসমান একাকী পঙ্কজ স্বরূপ।
আগেই বলে রাখি, আমার এই পরিণত প্রেম একতরফা গোপন প্রেম নয়; তাই এই প্রেমকে প্রণয় বললেই ভালো হয়। গত বছর পর্যন্ত তার আর আমার কিছু সময় ভালোই কেটেছে। মনাকাশে কদাপি কিয়ৎ মেঘাচ্ছন্নতা বিরাজ করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে নি। বিপদ ঘটলো তখন, যখন মনোমধ্যে বিরাজিত সুপ্ত থাকা অবিশ্বাসের তীর প্রকাশিত হলো। প্রণয়-ভ্রূনের জন্মাবার পালা আসতেই তার মধ্যে অবিশ্বাসের ভ্রুণ জন্ম নিলো। প্রণয়ের কথা শুনা মাত্র, সে আমায় ছেড়ে যেতে উদ্যত হলো। কিন্তু আমি যে তাকে বিনা বাঁচি না, তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আমার জীবন পরিসর। এসব বুঝিয়ে তার যাওয়ার পথ অবরুদ্ধ করলাম। কিন্তু আমার প্রতি তার অবিশ্বাসের বিষ স্থায়ীভাবে গেঁথে গেছে তার মনশ্চক্ষুতে। আর ক্ষণে ক্ষণে সেই অবিশ্বাসের উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে আছড়ে পরতে থাকলো আমার উপর।
তবুও তাকে আটকে রাখার চেষ্টা আরো বহুবার করেছি কিন্তু সফলতা আসে নি, তবে লাঞ্ছনা এসেছিলো অনেক। অতঃপর বুঝেছি আমার মধ্যে তার সুখ নেই, তাই তার সুখকে প্রাধান্য দিয়ে বিদায় দিলাম তাকে। এই যে বুঝলাম, এটাই আমার কাল হলো। এই যে পরিস্থিতি বুঝে, বাস্তব গ্রহন করলাম এতেই সর্বাপেক্ষা বিপদ এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। না বুঝলে আগের মতই কান্না করে ক্ষান্ত হতাম হয়তো, কিন্তু এবার যেহেতু বুঝলাম সেহেতু কান্নার অবকাশ রইলো না। রোজ নিদ্রাহীনতায় ভুগছি, হৃদয়ের অন্তঃস্থলে ক্লান্তি আসতেছে; তবু বড় হয়েছি বলে, কষ্ট লুকাবার ক্ষমতা হয়েছে বলে অশ্রুক্ষরণ করতে মানা, মুখবিবর ফ্যাকাসে করতে মানা। কারো স্কন্ধে যে মুখ লুকিয়ে কান্না করবো, তেমন কেউ নেই। ক্রমেই মৃত্যুমুখে ঢলে যাচ্ছি, বাঁচবার মতো আর শক্তি নেই। দাঁড়িয়ে আছি তাসের ঘরের মতন, কোনদিন বিখরাইয়া যাবো বলতে পারি না। তাছাড়া কবিগুরু বলেছেন–
“যে শোকে রোদন নাই, সে শোক তো যমেরই দূত”।