মাতৃরূপেণ

মাতৃরূপেণ

“ট‍্যাক্সি, ট‍্যাক্সি!” “হ‍্যা দাদা আলিপুর যাবেন? একটু তাড়াতাড়ি চলুন, বড্ড দেরি হয়ে গেছে।” ঈশান ড্রাইভারকে ডেকে বলল,” একটু জলদি চালাবেন দাদা।” “আজ পুরোনো কথা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আজ কতদিন পর আমি ভীষন খুশী রে ঈশান।আজ মনে পড়ে যাচ্ছে কীভাবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিকে খুঁজে পেয়েছিলাম। আজ সবটা বলব, আজ আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় দুটো মানুষের দেখা হওয়ার দিন যে। আমি জানিনা আজ যেখানে তোকে নিয়ে যাব, সেখানে গিয়ে তুই কী ভাববি! বা আমার সব কথা শুনে কী ধারণা পোষণ করবি। তুই বলেছিলি যে আমার অতীত তোর কাছে তেমন ভাবনার বিষয় নয়, কিন্তু আমার মতে সেটা তোর জানা প্রয়োজন।” কথাগুলো বলে একটু চুপ করল মোহর। ঈশান উত্তর দেয়,”আমি জানতে চাই না তবে তোর যখন বলার ইচ্ছে আমি নিশ্চয়ই শুনব।”

প্রসঙ্গত পাঠকদের জানিয়ে রাখি মোহর ও ঈশান, দুজনের চাকরি সূত্রে আলাপ, বন্ধুত্ব,ভালো লাগা। বেশ কিছু দিন আগে ঈশানই উদ‍্যোগ নিয়ে এই ভালো লাগা বা ভালোবাসাকে সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধার প্রস্তাব দেয়। তারপর থেকেই মোহর একটু চুপচাপ হয়ে আছে। অনেকদিন পর গতকাল ঈশানকে ফোন করে, তার সাথে দেখা করতে বলে সে আর বলে কিছু বলার আছে তার।

মোহর বলতে থাকে। মধ‍্য কলকাতার অন‍্যতম একটা কেন্দ্রবিন্দু,যেখান থেকে একদিকে কলেজ স্ট্রিট,আর অন্য দিকে হাতিবাগান, মাঝখানে বিধান সরণির ফুটপাতে বেড়ে ওঠা আমার শৈশব। আমি সীমা। মোহর নামটা মামনির দেওয়া, হুমম সেই মামনি, যার কথা তোকে অনেক বলেছি। মামনি আমার জন্মদাত্রী মা না হয়েও আমার কাছে তার চেয়ে অনেক বেশি।আমি আমার মা বাবার পঞ্চম সন্তান। বিধান সরণির ফুটপাতের একফালি জায়গা ছিল আমাদের ঘর, বাড়ি,যা ভাবিস। ছোটোবেলার সবটা না হলেও বেশ খানিকটা মনে আছে আমার। রোজ ভোরে ঘুম ভাঙত আমার মায়ের গোঙানির শব্দে। অস্ফুট স্বরে কিছু বলতে চাইত মা,বাবা অস্রাব‍্য কিছু গালমন্দ করে চুপ করিয়ে দিত। এখন বুঝি ফুটপাতে টিভি থাকে না, ফোন থাকে না, এন্টারটেইনমেন্ট কীসে হয়,যার ফসলই হয়ত ছিলাম আমি। তবে শুধু এন্টারটেইনমেন্ট নয় পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি মানেই ভিক্ষার হাতের সংখ্যা বাড়া, তাতে পেটের সংখ্যাও বাড়ে,তবে পেট!! কতদিন যে পেটপুরে খাইনি তা দিন গুনে বলতে পারব না, তবে কদিন খেয়েছি তা আজও মনে আছে।

ঘুম থেকে উঠে মা রোজ একটা বাটি নিয়ে পাঠিয়ে দিত ভিক্ষা করতে। আমার বাবা কাজ করত মাল বওয়ার, আর মাও কোথাও একটা যেত, কিন্তু কী কাজ জানিনা ঠিক‌। আমি যেতাম ভিক্ষা করতে কখনো কখনো একা আবার কখনো আমার ছোট্ট ছয়মাসের বোনটাকে কোলে করে। আমার বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। এভাবেই শুরু হয় আমার বড়ো হওয়া। আমাদের ফুটপাতে একটু এগোলেই একটা মেয়েদের স্কুল, আগে নাম জানতাম না সে স্কুলের, এখন জানি বেথুন স্কুল। কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো মেয়েদের স্কুল , মামনির কাছে অনেক গল্প শুনেছি এই স্কুলের। মামনি আমার জীবনের পুরোটা জুড়ে আছে। আজও মনে আছে আমার যেদিন মামনির সাথে প্রথম দেখা হয়, রোজকার মতো সেদিনও গেছি ওই স্কুলের সামনে ভিক্ষা করতে, বেশির ভাগ লোকই দূর দূর করে, কেউ এক-দুটাকা দেয়ও। হঠাৎ একটা শাড়ি পরা মহিলা আমায় ডেকে বলল, “খেতে দেব পেটপুরে, তার বদলে তোকে একটা কাজ করতে হবে।” আমি বললাম,”কী কাজ?” সে বলল,”রোজ একঘণ্টা করে গল্প করবি আমার সাথে।” আমি বললাম,”ওমা আমার ভিক্ষার কী হবে?বাড়ি গেলে মা পেটাবে আমায়।” সে বলল,”ভিক্ষার টাকা দেব আমি তোকে।” আমি ভেবে দেখলাম, খাবার পাবো, ভিক্ষাও পাবো। রাজি হয়ে গেলাম। পরদিন আমিও একই সময় হাজির। দেখি ওরনা ঢাকা সেই মুখ, আমি এগিয়ে যেতেই অনেক খাবার দিল আমার হাতে। আমিও মনের আনন্দে ধরে নিলাম তার হাত। সেদিন জানতাম না মহানগরীর ফুটপাতে ঈশ্বরের দেখা মিলেছিল সেদিন।

তারপর হেদুয়ার একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। মামনি কীসব বই কাগজ বের করল। সেই দিনই হল আমার হাতেখড়ি। মামনি আমার প্রথম দিদিমণি। তারপর মামনি টাকাও দিল আমায়। এরপর থেকে রোজ আমি নিয়ম করে হেদুয়া যাই, মামনিও আসে। মামনি নিজেই আমায় একদিন বলেছিল,”তুই আমায় কী বলে ডাকবি?আমি বলি,”দাঁড়াও ভেবে বলি,” কেন জানি না মা বলতে ইচ্ছে হয়,আর তো কোনো ডাক জানিও না।” তখন তো মামনিই বলেছিল,”আচ্ছা আমি বলি, আমি তোর মামনি, মামনি বলে ডাকবি কেমন।” আমিও সেই দিন থেকেই মামনি বলে ডাকি তাকে।

খুব জোরে একটা ব্রেক দিল ট‍্যাক্সিটা, একটু থামল মোহর, দেখল চোখের কোণায় অল্প জল। ট‍্যাক্সিটা সিগন্যালে আটকালো, একটা বাচ্চা মেয়ে ট‍্যাক্সির জানলায় এসে বলল,”অনেক দিন কিছু খাই না দিদি, দুটো খাবার দাও।” মোহর বলল,” খাবার তো নেই।” ১০০টাকা বের করে বলল, “যাবি আমার সাথে?” মেয়েটা টাকাটা নিয়েই দৌড় দিল। মনে মনে বিড়বিড় করল মোহর কিন্তু শুনতে পেল ঈশান, “তুমি না থাকলে আমার পুরো শৈশব এভাবেই তো কাটার কথা মামনি।” মোহর আবার বলতে শুরু করল। মামনির কাছেই আমার প্রথম ছড়া শেখা, গান শেখা, ইংরাজি পড়া। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন আসত মামনি কেন রোজ ওড়নায় মুখ ঢেকে আসে, কোনো দিন মামনির মুখ দেখতে পেতাম না আমি।

একদিন এসে হঠাৎ মামনি বলল, “বেড়াতে যাবি সীমা?” আমি তো এককথায় রাজি। ঠিক হয়, পরের রোববার বেড়াতে যাব আমরা। শনিবার দেখা হতেই মামনি বলল,”চল আমার বাড়ি।” সবকিছু আজও ছবির মতন মনে আছে। আমিও চললাম, কোনোকিছু না ভেবেই। আমায় চান করিয়ে, পরিস্কার করে, সাজিয়ে নতুন জামা দিয়েছিলে মামনি। জীবনে প্রথম অত সুন্দর নতুন জামা পেলাম আমি। মামনির সুন্দর ঘর, সোফা, সেই সোফায় দাঁড়িয়ে কী লাফিয়েছিলাম আমি।

মামনি এসে নতুন জামা পড়িয়ে দিয়েছিল। সেদিন জামা পড়াতে গিয়ে মামনির ওরনাটা সরে যায়। সেই প্রথম মুখটা দেখতে পাই আমি। দেখেই ছিটকে আসি। কোঁচকানো চামড়া, বিভৎস ক্ষত বিক্ষত মুখ। আমার শিশু মন আতকে ওঠে। আমি চিৎকার করে লাফ দিয়েছিলাম সোফা থেকে। চিৎকার করে বলেছিলাম,”তুই মানুষ না?” ভয়ে রাগে কী হয়েছিল আমার সেদিন জানিনা। কোনো মতে দরজা খুলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়তে লাগলাম,পেছন থেকে মামনি চিৎকার করে বলছিল,”যাস না, যাস না সীমা, আমি তোর মামনি, আমি ভূত নই রে, আমি মানুষ, আমি মানুষ,যাস না মা।” সেদিনের পর আরও সপ্তাহ কেটে যায়। আমার ঘুমের মধ্যে রোজ ওই বিভৎস চেহারা ভাসতে থাকে। মাঝে মাঝে আতকে উঠতে থাকি। কিন্তু সপ্তাহ খানেক যেতে না যেতেই আমার মামনির কথা মনে আসতে থাকে। মামনির চেহারা নয়,তার চোখ,তার গল্প বলা, আমায় আদর করা, খাইয়ে দেওয়া, সব চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

একদিন আবার চলে যাই ওই স্কুলের সামনে। ছুটির ঘণ্টা বাজতেই বের হয় মামনি। মামনি দেখতে পায় আমায়। মামনি তাও দৌড়ে চলে যেতে থাকে, আমিও দৌড়ে মামনির হাতটা ধরি। কেন এমন করেছিলাম কেন ভয় পাইনি আজও জানিনা। শুধু এটুকু বুঝি যে যদি সেদিন ওই হাতটা না ধরলে আজ এইদিন আসত না আমার জীবনে।

পরের রবিবার মামনির সাথে ঘুরতে বেরোনোর কথা আমার। আমরা প্রথমেই চলে যাই কাছেই জোড়াসাঁকোয়, মামনি বলেছিল আমায় ওটা রবিঠাকুরের বাড়ি। মামনি প্রশ্ন করে আমায়,” বলত সীমা রবিঠাকুরের কোন্ কবিতাটা আমি পড়িয়েছি তোকে?” আমি খানিকক্ষণ মাথা চুলকে উত্তর দিই,”কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ি।” মামনি বলে,” বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি,,তারপর তুই বল…”। এভাবেই গোটা কবিতাটা বলতে বলতে ঠাকুর বাড়ি ঘুরতে থাকি আমরা। আজ জোড়াসাঁকোয় গেলে আজও সেই দিনটার কথা বড়ো মনে পড়ে। তারপর সেখান থেকে মেট্রো রেলে করে সোজা চলে যাই ময়দানে। সেই প্রথম আমার মেট্রো চড়া, সে কী ভয় আমার, তোমার কোলে মাথা গুঁজে রেখেছিলাম। তারপর ময়দানে প্রচুর বেলুন কিনেছিলাম আমরা।

তারপর ভিক্টোরিয়া, যাদুঘর সব ঘুরে তারামণ্ডলে গিয়ে আমার প্রথম আকাশ দেখা। কল্লোলিনী কলকাতাকে মামনির হাত ধরেই আমার প্রথম দেখা। মামনি ছিল আমার ছুটির ঘণ্টা আর আমি মামনির ফটিক। ফেরার সময় মামনি হঠাৎ বলেছিল,”সীমা তুই আমার কাছে থাকবি??” আমিও কিচ্ছু না ভেবেই হ‍্যা বলেছিলাম। সত্যি বলতে মামনির কাছে থাকতেই ভালো লাগত আমার, পেটপুরে খাবার পেতাম, জামাকাপড় পেতাম,পড়তে পারতাম,হয়ত স্বার্থপর ছিলাম, কিন্তু শিশুমন তো ভালোবাসা বোঝে। মামনি আমার মা-বাবার কাছে প্রস্তাব দেয়, ওরা না করে কারণ আমার ভিক্ষার টাকায় একবেলা হলেও খেতে পেত ওরা। আমি তখন জানতাম না, মামনি কী বলেছিল ওদের, কিন্তু ওরা রাজি হয়ে গেছিল। পরে জানতে পারি মামনি মাসে মাসে টাকা পাঠাত তাদের। মামনি দত্তক নেয় আমায়, নাম দেয় মোহর।

মামনির আদরে বড়ো হতে থাকি আমি। বেথুন স্কুলে ভর্তি হই। তারপর মাধ‍্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বাংলা অনার্সে প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হই। যত বড়ো হতে থাকি মামনির ব‍্যাপারে কৌতুহল বাড়তে থাকে, কিন্তু জিজ্ঞাসা যে করব সে সাহস হয় না, একদিন মামনি স্কুলে গেছে তখন মামনির আলমারি খুললাম, অনেক খুঁজে পুরনো একটা অ‍্যালবাম পাই। সেখানে কিছু পুরোনো ছবি পাই, যার গঠন চেহারার গড়ন আমার ছেলেবেলায় দেখা মামনির মতো কিন্তু মুখশ্রী অসম্ভব সুন্দর, ছবিগুলো যার তার বয়স বছর ২০-২২। মেলে একটা ডায়েরিও মামনির হাতের লেখা। আমি কিছুটা পড়ি সে ডায়েরি, কিন্তু একটা তারিখের পর তাতে আর কিছুই লেখা নেই। সেই ডায়েরিতে মামনির বাড়ি মা-বাবার সাথে আরও একজনের উল্লেখ পাই রাতুল বলে। তার পাঠানো কিছু চিঠিও পাই, বুঝতে পারি রাতুল আর মামনির মধ্যে বেশ একটা খুনশুটির, বন্ধুত্বের মিষ্টি সম্পর্ক ছিল।

ডায়েরি পড়তে পড়তে খেয়াল করিনি কখন মামনি ঘরে ঢুকে এসেছে। এই প্রথম মামনিকে রাগতে দেখি। মামনি প্রচণ্ড রেগে এই প্রথম আমার গালে চড় মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর দুদিন কথা হয় না দুজনের। দুদিন পর মামনি এসে বলে,”ওই ছবিগুলো আমার, আমার যে চেহারা দেখে ভয় পেয়েছিলি তুই, সে চেহারা আমার আগে ছিল না।” আমি কোনো কথা বলিনি মামনি এই প্রথম আমার কাছে নিজের কথা বলতে থাকে। আর আমি চুপ করে শুনতে থাকি মানুষটার মনে জমা ব‍্যথাগুলো সারাতে তো পারবো না আমি, কিন্তু শুনতে তো পারি। মামনি বলতে থাকে, “আমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান, বাবা যখন মারা যান তখন অনেক ছোটো আমি। মাই অনেক আদর যত্নে মানুষ করে আমায়। গ্র‍্যাজুয়েশন করতে স্কটিশ কলেজে ভর্তি হই, সেখানে আলাপ হয় রাতুলের সাথে, বন্ধুত্ব , বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা, কাছাকাছি আসা। রাতুলের আর আমার চাকরিটাও হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু এত সুখ সইল না রে। একদিন বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে, বাইকে আসা দুটো ছেলে হঠাৎ কিছু একটা ছুড়ে মারল আমার মুখে। যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকলাম,অসহ‍্য অসহ্য যন্ত্রণা, ভাষায় যা প্রকাশ করা যায় না। জ্ঞান ফিরতে জানতে পারলাম প্রায় একমাস হাসপাতালে আমি। যেদিন উঠে দাঁড়ালাম, আয়নায় নিজের মুখ দেখে নিজেই আতকে উঠি।

কী ভয়ানক মানসিক, শারীরিক যন্ত্রণা বলে বোঝাতে পারবো না। পুলিশ আসে, তদন্ত হয়। জানা যায়,অন‍্য একটি মেয়েকে টার্গেট করেছিল ওরা,আমি ভুলবশত ওদের শিকার হই।” আমি তার মাঝে মামনিকে জিজ্ঞাসা করি,”মামনি তোমার সেই বন্ধু রাতুল?” “রাতুল এসেছিল আমায় দেখতে,আতকে উঠেছিল ও। যেমন তুই আতকে উঠেছিলি সেদিন,ঠিক তেমন। আমি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার দিন কয়েকের মধ্যেই আমার মা মারা যান। মা এই আঘাত নিতে পারলেন না। বাস্তব দুনিয়া যে কত কঠিন টের পাই সেদিন। কিন্তু হার মানার মানসিকতা আমার নয়। ঠিক করি যাই হোক লড়ব। বেথুন স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পাই, আমি জানতাম এক্ষেত্রে রূপ নয় গুণের কদর আমি পাব,পাইও। রাতুল ইতিমধ্যে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, কিন্তু আমার নিজের মধ্যেই এত দ্বন্দ যে কথা বলার সাহস পাই না। ঠিকানা পাল্টে চলে যাই অন‍্য জায়গায়। রাতুল আর খুব বেশি চেষ্টা করেনি। তারপর পাই তোকে। তুই আমার একাকীত্ব ঘেরা জীবনে একঝাঁক দমকা হাওয়া হয়ে আসিস। ব‍্যাস এই হল তোর মামনি। জানি এতদিন অনেক কৌতুহল চেপে রেখেছিলি। আজ জানলি তো?চল এবার খাবি চল।” তাকিয়ে দেখি মামনির চোখে জল, আমারও।

ঈশান কথা বলে এতক্ষণে,”বুঝলাম, এতদিন পর আজ হঠাৎ কী হলো যে বলছিস এসব আর by the way আমরা যাচ্ছি কোথায়??” মোহর বলে,আমার কথা কিছু বাকি আছে ঈশান। সব বলব। ঈশান বলে,”বেশ বেশ বল মা।” আমি আর মামনি খুব আনন্দে কাটাতে থাকি,কিন্তু সেই আনন্দও ক্ষণস্থায়ী হয়। একদিন সকালে দরজা খুলে একটা খুব সুন্দর কার্ড আর গোলাপ পাই আমি। কিন্তু বুঝতে পারি না কার পাঠানো। এরপর প্রতি সাতদিনে একটা করে কার্ড আসতে থাকে, কখনো রাস্তায় কখনো কলেজে। বোঝার চেষ্টা করি কে হতে পারে, কিন্তু কোনো নাম মাথায় আসে না।। মামনিকে প্রথমে কিছু। কিন্তু একদিন এক প্রস্তাব পাই, চিঠির বয়ান অনুযায়ী ছেলেটি আমায় ভালোবাসে এবং একটি নির্দিষ্ট জায়গায় দেখা করে সেই প্রস্তাবে সম্মতি জানাতে বলে, জানতে পারি পাড়ার কাউন্সিলরের একমাত্র ছেলে সে,চিনতেও পারি। ছেলেটার নাম কুন্তল। ছেলেটা প্রচণ্ড রাগি, বদমেজাজি, মদ,গাঁজা কিছুই বাদ ছিল না তার। এমন মানুষ আমার জীবনসঙ্গী কখনোই হতে পারে না। কী করব কিছু ভেবে পাই না, মামনিকে জানাই, মামনি পুলিশে খবর দেন, পুলিশ ছেলেটাকে ডেকে হুমকিও দেয়, কিন্তু ওই পর্যন্তই, উল্টে সেই পুলিশের ওপর নিজের বাবার ক্ষমতা জাহির করে হম্বিতম্বি করে চলে আসে।

কিছুদিন সব বন্ধ থাকে। একদিন আমি আর মামনি রাস্তা দিয়ে বাজার করে ফিরছি, এমন সময় হঠাৎ চার-পাঁচটা বাইক এসে ঘিরে ধরে আমাদের, একজন আমার কাছাকাছি এসে বলে,”বেশি উড়িস না, নইলে তোর মা’র মতো চেহারা তোরও হবে, পুলিশ কিস‍্যু করতে পারবে না, বিয়ে তো করতে বলিনি তোকে, থাক কদিন,ঘুরব,ফিরব,তারপর তুই তোর মতো আমি আমার মতো, এক সপ্তাহ টাইম দিলাম।” ভয়ে,রাগে সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে আমার। বাইকগুলো চলে যাওয়ার সময় পাশের ময়লা ফেলার ভ‍্যাটে কাঁচের শিশিতে কিছু একটা ছুড়ে ফেলে, হালকা ধোঁয়া বেরোতে থাকে। মামনি আতংকে চিৎকার করে ওঠে,”কাছে যাবি না মোহর,অ‍্যাসিড,অ‍্যাসিড ওটা”। সেই সপ্তাহ আমি আর ঘর থেকে বেরোইনি, মামনি বেরোতো আর জানিনা ওই ঘটনার পর মামনি বড্ড বেশি কিছু ভাবত, এই প্রথম আমি মামনিকে এত অন‍্যমনষ্ক দেখেছিলাম। তখন বুঝিনি কী চলছে মামনির মধ‍্যে। বুঝতে পারি এক সপ্তাহ পর, সেদিন সোমবার আমার ঘুম ভাঙে ল‍্যান্ড ফোনে আসা একটা ফোনে, ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে একটা কন্ঠ ভেসে আসে,”হ‍্যালো মানিকতলা থানা থেকে বলছি, আপনাকে একটু আসতে হবে”। আমি কী হয়েছে জানতে চাইলে তারা বলেন যে থানায় গেলে তারা সব জানাবেন। আমি মামনির ঘরে গিয়ে দেখি মামনি নেই, সদর দরজাটা লক, আমি ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে সাথে সাথে রওনা হই মানিকতলা থানার উদ্দেশ্যে।

থানায় গিয়ে দেখি সেখানে মামনি। পুলিশ জানায়, মামনি নাকি সারেন্ডার করেছে। এত অবদি বলে গলাটা ধরে আসে মোহরের। চোখের জল গাল বেয়ে নেমে আসে। ঈশান মোহরের কাঁধে হাত দিয়ে আলতো একটু চাপ দিয়ে বলে,”জল খাবি একটু? একটু জল খা”। মোহরের গলা আরও ধরে আসে,” আমার মামনি আমার চেহারা তার মতো হতে দেয়নি, যে এই হুমকি আমায় দিয়েছিল,তাকে উচিত শাস্তি দিয়ে নিজে সারেন্ডার করেছিল। কুন্তলের খুনের শাস্তিতে মামনির সাত বছরের জেল হয়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোহর। তারপর চোখের জল মুছে হাসি মুখে বলে আজ মামনির মুক্তি। আমরা মামনিকে আনতে যাচ্ছি আজ ঈশান। ঈশান বলে,

” এবার তাহলে আমার দীর্ঘ অপেক্ষার সমাপ্তি, এটাই তো কারণ ছিল তোর এত টালবাহানার। এবার মামনির আশীর্বাদ নিয়ে আমার ঘরে আনব তোকে। কী জানিস তো আমার মতে সম্পর্কের ভিত্তি হল পারস্পরিক বোঝাপড়া আর সম্মান, রূপ বা অতীত নয়। নে চল, পৌঁছে গেছি আমরা। দাঁড়ান দাদা, একটু সাইড করে দিন “।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত