প্রেম – অপ্রেম

প্রেম – অপ্রেম

সন্ধিপুরের বাড়িটাই শেষে ভাড়া নিলাম । এখান থেকে সুজাতার স্কুল একঘন্টার পথ আর আমার অফিস মিনিট পনেরো । সেলামি দিতে হল পঞ্চাশ হাজার । তা হোক বাড়িটা বেশ । সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছ । তারপর গেট । দোতলায় বাড়িওয়ালা থাকেন সস্ত্রীক । নীচে আমরা । অর্থাৎ দুজোড়া কপোত আর কপোতী । বাড়ি খোলামেলা । তিনটে রুম । কিচেন আর বাথরুম । কিচেনে চিমনি লাগানো আর বাথরুমে গিজার আছে ।
ম্যাটাডোরে করে জিনিসপত্র আনা হল ।

দালাল প্রেমাংশু বাবু লোক ভাল। দাঁড়িয়ে থেকে সব ব্যবস্থা করে দিলেন ।
বাড়িওয়ালা বৃদ্ধ রাধাকান্ত ঘোষাল। রেলে চাকরি করতেন । এখন অবসর নিয়েছেন । গিন্নির পায়ে বাতের ব্যথা। বেশি নীচে নামতে পারেন না। নীচের তলাটা সাজিয়েছিলেন ছেলের আর বৌমার জন্য । তারা থাকেনি। একটাই ছেলে । বাবার সঙ্গে মুখ দেখাদেখি নেই । ছেলে থাকে অস্ট্রেলিয়া । ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার ।

সুজাতাকে নিয়ে ওপরতলায় গেলাম। ঘোষাল গিন্নি পায়ে বাতের তেল ঘষছিলেন । খুব ফর্সা । লম্বা দোহারা চেহারা । এখনও শরীর বেশ আঁটোসাঁটো । বয়স ষাট তো হবেই । কিন্তু বোঝা যায় না । এককালে যে ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন, সেটা বোঝা যায়।

রাধাকান্ত বললেন , তা তুমি আর বৌমা দুজনেই তো চাকরি কর? সারাদিন তো বাইরে থাকবে ? তবে রাতে কিন্তু তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকবে । আমরা দুজনে শুধু থাকি । এতবড় বাড়ি যেন খাঁ খাঁ করে ।

আমি বললাম , আরে এ আর বলার কি আছে? সুজাতা তো পাঁচটার মধ্যেই ঢুকবে আর আমার হয়ত ফিরতেসাতটা হতে পারে।
তা ভাল। নিজের মত থাকবে । আমি আবার রাত আটকাতেই শুয়ে পড়ি । হার্টের অসুখ । তাই রোজ ঘুমের ওষুধ খাই।

ঘোষাল গিন্নি এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। এবার ব ললেন, আমার আবার ঘুম আসতে চায় না। যতই ঘুমের ওষুধ খাই। ঘুম আসে না। সারারাত প্রায় জাগা।

সুজাতার মুখ করুণ হল , তবে তো মাসিমা আপনার খুব কষ্ট ।

সঙ্গে সঙ্গে ঘোষাল গিন্নির প্রতিবাদ , এই শোনো ওসব মাসিমা টাসিমা বলে ডাকবে না আমাকে । আমার নাম বিবি । আমাকে বিবি ম্যাডাম বলবে ।
সুজাতা চুপ করে গেল ।

রাধাকান্ত বললেন , আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার । ভারতের নানা জায়গায় আমার পোস্টিং ছিল । শেষে সন্ধিপুরটা পছন্দ হল তাই বাড়ি করলাম । আমাদের আদি বাড়ি কিন্তু বরিশাল ।

আমি বললাম , আমাদের ফরিদপুর । বাবা দেশ ভাগের পরে চলে এসেছিলেন এখানে । তারপর বনগাঁতে ছিলেন । এরপর টালিগঞ্জে বাড়ি করেছেন । সেটা অনেক পরে অবশ্য ।

কথাবার্তা চলছিল । ঘোষাল গিন্নি চা খেতেও বললেন না । বরং কিছু পরে রাধাকান্তবাবু উঠে ফ্রিজ খুললেন আর তারপর একটা প্লেটে দুটো মিষ্টি দিয়ে , আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন ।

বললেন , খান । আজ প্রথম দিন এলেন , একটু মিষ্টি মুখ করুন ।

আমি বললাম , আমরা দুজনই আপনার চেয়ে অনেক ছোট । আমাদের তুমি বলবেন ।

॥২॥

নীচে নেমেই সুজাতা দাঁতে দাঁত পিষল, অসভ্য । আনকালচার ।

কে? ওই বিবি ? ওনার কথা ছাড় ।
রাধাকান্তবাবু লোক খারাপ নন ।

ভদ্রলোক বৌকে ভয় পান । লক্ষ্য করেছ ?

কে না পায় ? আমি পাই না ?

ঢং ।

যাইহোক আমরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ।সুজাতা খুব সুন্দর করে ঘর সাজিয়েছে । চিকনের সাদা পর্দা , জয়পুরী বিছানার চাদর । ফুলদানিতে গোলাপ , রজনী গন্ধা রাখে । স্কুল ফেরত বাজার থেকে কিনে আনে । রবিবার একটুবেলা পর্যন্ত স্টিরিওতে চলে , রবীন্দ্রসংগীত ।

বিবি প্রায়ই গাড়ি নিয়ে মার্কেটিং করতে বেরিয়ে যান । ঘোষাল কর্তা একা ঘরে থাকেন ।

সুজাতা বলে , টাকা থাকলেও মি ঘোষালের সংসারটাই কেমন যেন । ছেলেও কাছে থাকে না । আবার বৌও সাজগোজ আর নিজের জগৎ নিয়েই ব্যস্ত ।

মার্চে হোলি ছিল সেদিন । কৃষ্ণচূড়ার নীচে দুজনে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ । লাল ফুলে ঢাকা কৃষ্ণচূড়া আর আমাদের মুখেও লাল আবীর । আমরা ভালবেসেই বিয়ে করেছি । পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে ভালবাসি এখনও । সুজাতা সুন্দরী নয় কিন্তু ও বুদ্ধিমতী । আমি ওর সঙ্গ ভালবাসি , ওর সঙ্গে সব কথা শেয়ার করি । সুজাতাও করে ।
বাড়িতে সেদিন আমার বন্ধুরা এসেছিল সজল , লাল্টু , প্রণব । সুজাতা স্কুলের কাউকে বলেনি । ইচ্ছে করেই বলেনি । একা একজনের পক্ষে , অতজনের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা সহজ নয় , তাই ।

রান্না করতে করতে এক ফাঁকে বলল , উপরে ঘুরে আসি একটু । তুমি এদিকটা সামলাও ।

আমি যাব সঙ্গে ?

দরকার নেই । বিবির যা কথাবার্তার ছিরি ।

সত্যিই ভদ্রমহিলা অদ্ভুত । সব ব্যাপারে তার রাগ । সব ব্যাপারেই তিনি অসন্তুষ্ট । কিছুই যেন তার মনের মত নয় । এমন কি স্বামীও নয় । দুজনের মধ্যে ঝগড়া লেগেই আছে । বাড়িতে কোন ঝি টেঁকে না । সুজাতা আমাদের কাজের মেয়ে লতাকে ,ওপরে দিয়ে এল । এক সপ্তাহ পরেই, বিবির ডাক এল।

বিবির চিৎকার আমিও শুনতে পাচ্ছিলাম , সুজাতা , এ কেমন মেয়ে দিলে ? বাসন মাজছে হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে ? বাড়িতে আমার কর্তা আছে , সে খেয়াল নেই ?

সুজাতা অবাক । বলল , কিন্তু লতা তো মেসোমশাই এর মেয়ের বয়সি ?

তাতে কি ? পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস কি ?

॥৩॥

সুজাতা ওপরে গেল আর একটু পরেই নেমে এল ।
বলল ,এই শুনছ মেসোমশাই মদ খেয়ে বাথরুমে উল্টে পড়ে আছেন ।

বিবি কোথায় ?

উনি বাড়িতে নেই । দোল খেলতে গেছেন ।

আমি ও আমার বন্ধুরা ওপরে ছুটলাম । রাধাকান্তবাবু ভারি শরীরটা তোলা হল । মনে হল পায়ে সামান্য চোট পেয়েছেন ।

প্রণব বলল , একটু তেঁতুল গোলা জল খাওয়াতে হবে । বমি করাতে পারলে শরীরটা ভাল লাগত ।
তারপর ঘন্টা দুয়েক কাটল মানুষটাকে নিয়ে । ডাক্তার এলেন । লাল্টু ওষুধ কিনে নিয়ে এল ।
অনেক রাতে বিবি বাড়ি ফিরলেন ।সুজাতা ওকে সব জানাল ।
বিবি বললেন , এ আর নতুন কি ? মাতাল কি ও আজ হয়েছে ? যাক গে ডাক্তারের খরচটা কত হল জানিও ,পাঠিয়ে দেব ।

দেখতে দেখতে সুখে দুঃখে দুটো বছর কেটে গেল । সুজাতার বাবা মারা গেলেন । আমার চাকরিতে প্রমোশন হল । আরও একটা আনন্দের খবর , বিয়ের সাত বছর পর সুজাতা মা হতে চলেছে । আনন্দে মন ভরে গেছে আমাদের । নাহ্ বাড়িটা পয়া । দু দুবার মিসক্যারেজ হয়েছিল , সুজাতার । আমরা কত ডাক্তার দেখিয়েছি । অবশেষে এতদিন পর আবার ও কনসিভ করল ।
বিবি দেখলাম ,খবরটা শুনে খুশিই হলেন

।বল লেন , এবার একটু সাবধানে রেখ ওকে।স্কুল থেকে ছুটি নিতে বল ।
পরে চাকরকে দিয়ে আচার পাঠিয়ে দিলেন ।

॥৪॥

সুজাতাকে বাপের বাড়ি দিয়ে এলাম । এরপর মাস দুয়েক অফিসের কাজে দিল্লীতে অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলাম । সন্ধিপুরের বাড়ি তালাবন্ধ । আমি আর সুজাতা দুজনেই নেই , কাজেই । দু মাস পরে বাড়ি ফিরে লতাকে ডেকে পাঠালাম , ঘরদোর পরিষ্কার করার জন্য ।
লতা এসেই বলল , দাদাবাবু , ওপরের খবর জানেন না ?

কেন ? কি হয়েছে ?

বাবু , গিন্নিমাকে পুলিশ ধরে নে গেছে ।
আমি শুনে অবাক ।

কেন ? ধরেছে কেন ?

সে অত জানি না । এদিকে বুড়োকর্তার ইসস্টোক । তেনাকে হাসপাতালে দিয়েছে ।

এই কদিনে এত কিছু হয়ে গেছে ? ওপর তো তালা বন্ধ নাকি ?

না দাদাবাবু । বুড়োকর্তার ছেলে এসেছে ।

আমি চুপ করে রইলাম । সেই ছেলে আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত অথচ সব কিছু জানতে আমায় ,তার কাছেই যেতে হবে ।

সন্ধ্যাবেলা ওপরে গেলাম । ড্রয়িংরুমে আলো জ্বলছে । চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছেন তিনি । ঘোষালমশাই এর মতোই মুখ । তবে গায়ের রং আরও পরিষ্কার ।

নমস্কার । আসতে পারি ?
হাতজোড় করলাম ।

আরে আসুন আসুন । বসুন । আমি রতিকান্ত ।আমি শুনেছি , আপনি এসেছেন ।

আপনার সঙ্গে আগে আমার দেখা হয়নি ।কিন্তু মেশোমশাই আপনার কথা , আমাকে বলেছেন । আচ্ছা উনি এখন কেমন আছেন ?
অনেকটাই ভাল । আমি বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই । কিন্তু …

আমি অবাক হয়ে বললাম , কিন্তু কি ?

উনি যেতে চান না । ওনার ওয়াইফকে ছেড়ে কিছুতেই যাবেন না ।

উনি তো আপনার মা ?

না । আমার সৎ মা । আমার নিজের মা অনেকদিন আগেই মারা গেছেন ।

আচ্ছা , আপনার সৎ মা , অ্যারেস্টেড হলেন কেন ?

মেয়ে পাচারে জড়িত বলে । বহুদিন ধরে ই বিবি এই ব্যবসা করে । এছাড়া নেশার জিনিসও পাচার করে । বাবা এসব জানত ।ওকে শুধরাবার অনেক চেষ্টাও করেছে।আমার মায়ের মৃত্যুর পর, বাবা কিছুদিন ওইসব এলাকায় যেত । যেমন হয় আর কি । ওখানেই বিবির সঙ্গে বাবার আলাপ।

আমি বললাম , কিন্তু ও কি আপনার বাবাকে ভালবাসে?

একদমই না । বাবার টাকাকড়ি দিকেই নজর।

তাহলে?

তাহলে আর কি? কে বোঝাবে বাবাকে? লাভ ইজ ব্লাইন্ড। এই বয়সে এসেও।

এটা একটা মোহ । বিবি খুব সুন্দরী ছিলেন একসময় । সেই থেকেই মনে হয় …

না । বাবা অসম্ভব ভালবাসেন ওকে। আমি বাড়ি ছাড়লাম বিবির কারণে । কিন্তু বাবা আমাকে ছাড়লেন , ওকে ছাড়লেন না । কালও হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাঁদছিলেন । বিবির জন্য। ভাবতে পারেন ? আমার হাত ধরে মিনতি করছেন ।

কেন ?

যত টাকা লাগে লাগুক , ভাল উকিল চাই তার ।

কিন্তু বিবির তো বেইল হওয়া খুব কঠিন ।

সেটা ওকে কে বোঝাবে ? আমি এখন কি করব বলুন তো ?

আমি চুপ । কি বলব বুঝতে পারলাম না ।

॥৫॥

বিবি কিন্তু বেইল পেলেন না । নারী ও নেশার বস্তু পাচারের জন্য , আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করল । সাজা হয়ে গেল তার ।

এদিকে আমি দিল্লিতে বদলি হলাম । ছেলেকে নিয়ে সুজাতাও আমার সঙ্গী হল । সুজাতা শেষপর্যন্ত মাস্টারি ছেড়ে দিল । আমাদের দিন এখন কাটে খোকনকে নিয়ে ।কিন্তু ঘোষালমশাইকে আমরা ভুলিনি । ওনার ভালবাসাকে ব্যাখ্যা করা আমাদের সাধ্যের বাইরে ।আমার ছেলের অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণপত্রও পাঠিয়েছিলাম , সন্ধিপুরের ঠিকানায় । কেউ আসেনি ।

হঠাৎ রতিকান্ত ঘোষালের একটা চিঠি পেলাম । চিঠির একপাতায় রাধাকান্ত বাবুর মৃত্যু সংবাদ । অন্যপাতায় লিখেছেন বাড়ি ও সমস্ত স্থাবর সম্পত্তি তার বাবা, বিবিকে গিফট ডিড করে গেছেন । অবশ্য বিবি এখন হাজতে । বেরোলে ভোগদখল করবেন । আর টাকাকড়ি সব রতিকান্তকে দিয়েছেন । আমার ছেলের জন্যও নাকি একটা সামান্য উপহার রয়েছে ।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত