সাজ সাজ রব চলছে; আসলে আজ অফিস থেকে একজন বিদায় নিবে। রিয়াদ সাহেব; অফিসের সেই চিরচেনা প্রিয় হাসি-খুশি মুখটি। তাকে কখনো কেউ গম্ভীর দেখেছে কি না জানা নেই; তবে আজ তিনি অনেকটা গম্ভীর। হয়তো চলে যাবেন তাই।
অন্যদের থেকেও উনার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কটা একটু বেশিই ভাল; আমায় খুব স্নেহ করেন। কিন্তু তার পরেও উনি একটা রহস্য; উনার সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানি না। উনার বাসায় অনেকবার গিয়েছি কিন্তু কয়েকটা কাজের লোক ছাড়া উনার অাপন কাউকে দেখিনি। শুনেছি উনি নাকি প্রচুর ঘুষ খান, কিন্তু এত কাছের হয়েও আমি নিজে কখনো প্রমাণ পায়নি।
এখনো গম্ভীর হয়ে বসে অাছেন; ডাক দিলাম-
-স্যার।
: হু…
-কিছু ভাবছেন?
:ও! তুমি?
-জি, কিছু ভাবছেন?
: না। আচ্ছা তোমার আমার ব্যাপারে এত কৌতূহল কেন? আর কারো তো এত কৌতূহল নাই!!
– আসলে স্যার তেমন কছু না…
: অফিস থেকে সপ্তাহ খানিকের ছুটি নিয়ে নাও; আসা করি ভালই লাগবে ; কিছু কৌতূহল ও মিটবে।।
গাড়িতে রিয়াদ সাহেবের পাশেই বসে অাছি; সামনে ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। শহর থেকে অনেক দূর চলে এসেছি; মাঝে মাঝে কিছু দোকানপাট দেখা যাচ্ছে আর কিছু বাড়িঘর; চারদিকে সবুজের সমারোহ। দুজনই চুপচাপ বসে আছি ; আমিও বাইরের পরিবেশ উপভোগ করছি ; উনিও উপভোগ করছেন। দুজনই চুপচাপ থাকলেও ততটাও খারাপ লাগছে না। রাস্তাঘাট মোটামুটি যানজট বিহীন ; মাঝেমাঝে ছোট-বড় কিছু কিছু গাড়ি যাচ্ছে। রাস্তাঘাট মোটামুটি উন্নত। গাড়ি ছুটে চলছে কিছু গ্রাম আর কিছু শহরের ভেতর দিয়ে।
প্রায় ৮ ঘন্টা পর গন্তব্যে পৌছালাম। বিকাল হয়ে গেছে; পড়ন্ত সূর্যটা মৃদু অালো ছড়াচ্ছে। মোটামুটি অনেকটা বড় এরিয়া নিয়ে কোন বাড়ি ঘর নেই; বেশ কিছুটা দূরে অাবার বাড়ি দেখা যাচ্ছে।
এই এরিয়ার ভেতর একটা একতলা বাড়ি। অনেকটা ক্লান্ত; অামরা বাড়ির ভেতর ঢুকে ফ্রেশ হলাম।
সন্ধা হয়ে গেছে; এখানেও একজন মাঝবয়স্ক লোক ছাড়া কাউকে দেখলাম না।
লোকটার নাম জানলাম; রহিম চাচা। উনি এ বাড়ির দেখাশোনা করেন। রান্নাবান্নাও ইনিই করলেন।
রাতে খেতে বসে তিনজনের অাসর জমলো; রহিম চাচা অনেক মজার একটা মানুষ।
উনি মাঝে মাঝে অনেক মজার মজার ঘটনা বলছেন যেগুলো জীবন থেকে নেওয়া। অনেক ভালো লাগছে।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠালেন রিয়াদ সাহেব:
: চলো হেটে আসি..
– স্যার এত সকালে?
: হুম! সকালে হাটতেই মজা। ও, আর আমাকে আংকেল বলো; আমি আর এখন তোমার অফিসের বস না।
– জি।
বাড়ির অাসপাশ ঘুরে দেখছি; বাড়ি থেকে একটু এসেই প্রথমে দেখলাম মোটামুটি বড় গরুর গোয়াল; গোয়ালটা সাদ দেওয়া আর সাদের উপর কবুতর, তারপর একটা ঘরে অনেক কিছু রাখা; হয়তো পশুপাখির খাবার আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস। এরপর দেখলাম একটা সান-বাধানো বড় পুকুর; পুকুরের মাঝে হাসের খামার আর চারদিকে সবজি লাগানো। এরপর মোটামুটি বড়সড় একটা আম-কাঠালের বাগান; বাগানের ভেতর একটা দু’পার্টের ঘর; ছোট্ট পার্টটাতে কেউ থাকে হয়তো, কিন্ত এখন ফাকা। বড় পার্টটা খুলে দিতে দেখলাম অনেক ছাগল বেরিয়ে আসলো।
এরপর অনেকটা জায়গা নিয়ে খরগোশ, পোষা পাখি রাখা দেখলাম। এরপর কিছুটা জায়গা নিয়ে হরেক রকম ফুলের বাগান করা; বাগানের ভেতর অল্প একটু ছাউনি দিয়ে বসার জায়গা। ঘুরতে ঘুরতে অনেকটা সময় হয়ে গেছে; এর ভেতর অনেকে এসে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কাজ করছে। যাদের সাথেই দেখা হচ্ছে রিয়াদ সাহেব তাদের সাথে হাসি মুখে কথা বলছেন।
সকালের খাওয়া শেষ করে ছোট্ট উঠানে দুজনে বসলাম ; অনেকেই দেখা করতে আসছেন উনার সাথে। কথা বলছেন সবার সাথে সুন্দরভাবে।
দুপুরে গোছলে গেলাম পুকুরে; আমি সাতার জানলেও পুকুরে গোছলের অভিজ্ঞতা খুব কম।
দুপুরে খেয়ে বিশ্রাম নিলাম কিছু সময়। বিকালে রিয়াদ সাহেব আমায় নিয়ে গেলেন ফুল বাগানে; দুজন বসে গল্প করছি। রহিম চাচা চা নিয়ে এসে আমাদের সাথে যোগ দিলেন। চা খেতে খেতে বললাম:
– আপনার গল্প বলেন শুনি..
: আমার গল্প কি শুনবে? আমার তো কোন গল্পই নেই!!
-না আপনার কে কে আছে; তাদের সম্পর্কে….
: এই সকাল থেকে যাদের দেখছো অামি এদের সবার; অামার হয়তো কেউ নেই।
– আপনার আপন কেউ; মানে আত্বিয়-স্বজন?
: হুম আছে; বোনেরা। তারা শ্বশুর বাড়ি; মাঝে মাঝে আসে।
– আপনার স্ত্রী-সন্তান?
: বিয়েই করিনি তো স্ত্রী আসবে কোথা থেকে; তবে সন্তান অাছে অনেকে। তাদের সাথেও হয়তো দেখা হবে তোমার।
– আংকেল একটা কথা জিজ্ঞেস করব যদি কিছু মনে না করেন…
: হু বলো
– আমি শুনেছি আপনি নাকি ঘুস খান; কথাটা কি সত্য?
: হা হা; হাসালে। তবে তোমার কি মনে হয় আমার জীবন-যাত্রার জন্য ঘুসের দরকার?
– না আপনার যেমন জীবন-যাপন তাতে তো মনে হয় না..
: কিন্তু মানুষ টাকা দেয়; আমাকে দেয় না; এই যে সকাল থেকে যত মানুষ দেখছো এদের কাউকে আমার টাকা নেয় না; অন্য মানুষে টাকা দেয়।
আরো দু একদিন থাকো, দেখো; বুঝবে।
– আর একটা প্রশ্ন করি?
: করো..
– আপনি বিয়ে করেন নাই কেনো?
: বিয়ে করলে কি এদের সাথে থাকতে পারতাম? আর আমারও খুব বেশি ইচ্ছা ছিলো না।
– প্রেমে পড়েন নাই কখনো?
রিয়াদ সাহেব কথাটার কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে চলে গেলেন। আমি বসে থাকলাম।
: ভাইজানরে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে কেউ কখনো উত্তর পাইনি। ( রহিম চাচা)
– কেন?
: জানি না।
– আপনি ও কিছু জানেন না?
: অল্প স্বল্প জানি; উনার বোনদের কাছেই শোনা।
– একটু বলুন প্লিজ…
: যৌবনে কাউকে খুব বেশি ভালবাসতো শুনেছি; এর বেশি কিছুই জানি না।
সন্ধার সময় বাগান থেকে উঠলাম; গিয়ে দেখি বাড়িতে প্রায় আমারি সমবয়সী কয়েকজন। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন রিয়াদ সাহেব। সবাই উনাকে চাচা বলে ডাকে। সবার সাথে গল্প জমে উঠলো; সবার সাথে কথা বলে দেখলাম প্রত্যেকে দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে অনেক ভাল অবস্থানে আছেন। রাতে সবাই এক সঙ্গে খেলাম। খাওয়া দাওয়া করে সবাই চলে গেলো। গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়।
সকালে উঠে আবারো রিয়াদ সাহেবের সাথে বের হলাম; এবার গ্রাম দেখতে। গ্রামের মাঠ, বিল দেখতে দেখতে নদীর পাড়ে চলে গেলাম। নদীতে জোয়ার চলছে; নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে দুজনেই বসে থাকলাম কিছু সময়। ফেরার পথে অনেকের সাথে কুশল বিনিময় করলেন।
ফিরতে একটু দেরিই হলো; এসে দেখি একজন যুবক এসেছেন। তার সাথে পরিচিত হলাম; রিয়াদ সাহেবের বোনের ছেলে; উনাকে বড় আব্বা বলে ডাকেন। ছেলেটাকে খুব ভালো লাগলো। খুব সাধারন একটা ছেলে।
পরে অবশ্য রহিম চাচার কাছে শুনলাম উনি এস.আই; দেখে বোঝায় যায় না এই ছেলেটা এস.আই; বয়স আমার থেকে কমই হবে। এ বাড়িতে উনিই থাকেন সাধারনত।
দেখতে দেখতে দিনগুলো কেটে গেলো; এবার আমার বিদায়ের পালা; সকাল সকাল গেলাম রিয়াদ সাহেবের কাছে বিদায় নিতে; দেখলাম আজও তিনি গম্ভীর।
– আংকেল,আমার ছুটি তো শেষ হয়ে অাসলো; আমায় ফিরতে হবে।
: হুম; কেউ তো থাকার জন্য না। ভাল লাগলে অাবার এসো। আমি এখানেই থাকবো।
– হুম, অবস্বই অাসবো। যাওয়ার সময় একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছা হচ্ছে…
: বলো..
– আপনি কি আসলেই সুখি?
: সুখটা আসলে আপেক্ষিক; নিজে সব সময় সুখে থাকার অভিনয় করে অন্যকে সুখি করাটাই হয়তো সুখ।।।।।