তিতাসের দিদি

তিতাসের দিদি

কয়েকদিন ধরে মন ভালো নেই তিতাসের, খুব দিদির কথা মনে পড়ছে। দুই বোন তারা যেন এক আত্মা এক প্রাণ ছিলো একসময়ে। কিন্তু দিদি যে নিজেকে এতোটা বদলে ফেলেছে সেটা জানতে অনেক দেরী করে ফেলেছিলো সে। বাবার আ্যক্সিডেন্ট যেন বাবার সাথে সাথে পুরো পরিবার টাকে পঙ্গু করে ফেলেছিলো। চাকরি খুইয়ে যখন দিকভ্রান্ত পুরো পরিবার তখন মায়ের কিছু গয়না ও দিদির টিউশনির কটা টাকার উপর নির্ভরশীল ছিলো পুরো সংসার। তারা পুরোনো পাড়া ছেড়ে বারাসতের দিকে একটা সস্তা পাড়ায় উঠে এসেছিলো।

তখন তিতাস ক্লাস সেভেন ও তিতির উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে সবে। দিদি পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলো। কলেজে ভর্তি হতে ছোট মামা সাহায্য করেছিলো তখন। মাকে বলেছিলো ওরা পড়াশোনা করুক সবটা না পারলেও কিছুটা দিয়ে সাহায্য করবো। আমার সংসারের হাল তো তুই জানিস! মায়ের কিছু বলার ছিলোনা, নীরবে চোখের জল ফেলেছিল।

কয়েক মাস পর মামা নিজের সংসারের চাপে আর টাকা দিতে পারেনি। কুন্ঠায় আর দেখা করতে ও আসেনি।
তিতির তখন আরো টিউশনি করতে শুরু করলো সাথে মা রাতে প্রায় দেড়শ রুটি তৈরী করে ঘর থেকে বিক্রি শুরু করে। যাই হোক পড়াশোনা চলছিলো দুজনেরই। মাধ্যমিকে ভালোই রেজাল্ট হোলো তিতাসের, তার দিদি ততোদিনে গ্র্যাজুয়েসেন কমপ্লিট।

তিতাস তখন নিজে কয়েকটা টিউশনি করে, একদিন সেখান থেকে ফেরার সময় দেখে দিদি একটা ছেলের সাথে কথা বলছে, ওকে দেখে দিদি একটু চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিলো।
রাতে শুতে এসে তিতাস বললো, ছেলেটা কে রে!

“অত কথার তোর কি দরকার, ঘুমো চুপ করে” বলে দিদি একটা মিষ্টি ধমক দিলো। তিতাস কোনো কথা না বাড়িয়ে দিদিকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

বাবা নিজের এক পা হারিয়ে কেমন যেন নিজেকে সংসারের বোঝা মনে করে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন একদিন রাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যাওয়াতে তিতাস শুনতে পেলো বাবা মা কে বলছেন, আমাকে কেনো বাঁচিয়ে রেখেছো তুমি? মেরে ফেলো আমায়, সংসারে বোঝা হয়ে থাকার চেয়ে মরা অনেক ভালো। সেদিন বাবার সাথে ওর মা ভীষণ কেঁদেছিলো। দিদির দিকে তাকিয়ে দিদির চোখেও জল দেখে ছিলো তিতাস। সে রাতে কেউ ঘুমোতে পারেনি। বাবা মা একটু শান্ত হতেই দু বোনে চুপিসারে চলে গিয়ে ছিলো ছাদে। অনেক দিন পরে তারা একসাথে আবার রাতের আকাশ দেখেছিলো।

মনে পড়ে গেছিলো বহু পুরোনো স্মৃতি, যেবারে তারা সবাই একসাথে পুরী বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রের ঢেউ গুনতে গুনতে ভবিষ্যতে সে প্লেন চালাতে চায়, সবাইকে বলেছিলো তখন বাবা বলেছিলেন আমার দুই মেয়ে যা পড়তে চায় তাই পড়বে। দরকারে আমি চব্বিশ ঘন্টা পরিশ্রম করবো। আজ সেই বাবা নিজেকে বোঝা ভেবে মরে যেতে চাইছে।
তিতাস ভয়ে ভয়ে দিদিকে বলে বাবা যদি আত্মহত্যা করে তখন কি হবে রে দিদি??

দিদি তিতাসকে অভয় দিয়ে বলেছিলো কিচ্ছু হবে না পাগলী, আমি তো আছি, ভয় পাস না তো। সেদিন দিদি কে মা দুর্গা মনেহচ্ছিল তার।

সকালে উঠে স্বাভাবিক ভাবেই দিন শুরু হলো। তিতির প্রাইভেটে এম. এর প্রস্তুতি শুরু করেছে, তিতাস কলেজে ।সন্ধের একটু আগেই তিতির একগোছা কাগজের বান্ডিল এনে বাবা কে দিয়ে বললো বাবা এই লেখাগুলো চেক করে ফ্রেশ করে লিখে দিও তো।

বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন আমি পারবো ?ঠিক তখনি তিতাস বাড়ি ফিরে বললো এগুলো কি রে দিদি, তিতির বললো আমি যেখানে পড়াতে যাই, মানে ঐ সোহম, তুই চিনিস তো, ওর এক কাকা লেখক। তিনি আমায় বললেন তুমি আমার লেখাগুলো আবার ফ্রেশ করে লিখে দিতে পারবে? না বলতে গিয়ে বাবার কথা মনে পড়ে গেল। কি সুন্দর হাতের লেখা, বাবা বেশ সময় করে সুন্দর করে লিখে দিতে পারবে।

বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে চোখের কোণায় জল চিক চিক করছে। তিতির বললো এর জন্য তুমি টাকা ও পাবে বাবা, তবে সব সময় এগুলো নিয়ে বসে থাকলে হবে না, সকালে জল খাবার খেয়ে দুঘন্টা আর সন্ধের পর একঘন্টা করে বসলেই হবে।

রাতে খেতে বসে বাবা মা কে বললো কত তাড়াতাড়ি মেয়েরা বড় হয়েগেলো তাইনা, আমি সুস্থ থাকলে কখনো এতো তাড়াতাড়ি ওদের বড় হতে দিতাম না। দিদি বাবার দিকে তাকিয়ে বললো বাবা সামনের মাসে আমার পঁচিশ বছর হয়ে যাবে, এখনো বলছো তাড়াতাড়ি বড় হলাম। ওর বলার ভঙ্গি দেখে সবাই হেসে উঠলো।

সবাইকে অনেক দিন পরে হাসতে দেখে তিতাস ঠাকুরকে প্রণাম করলো মনে মনে।

কয়েকদিন পর কলেজ থেকে ফেরার পথে বুবাই দা তিতাস কে ডেকে বললো, একটু সময় হবে তোমার, একটু কথা ছিল।

বুবাই তিতিরের সাথে পড়তো তাই তিতাসের সাথে মুখ চেনা ছিলো তবে কখনো কথা হয়নি।
বলুন কি বলবেন,

নাহ অন্য কিছু ভেবোনা, তিতির মানে, তোমার দিদি যে ছেলেটার সাথে মেলামেশা করছে, সে খুব খারাপ, মস্তানি, মারপিট, আরো আরো অনেক কিছু করে বেড়ায়, প্লিজ তুমি একমাত্র পারো তোমার দিদি কে তার হাত থেকে বাঁচাতে।

বাড়ি ফিরে দেখলো তিতির ফেরেনি, মাকে জিগ্যেস করলো দিদি কখন বেরিয়েছে মা, কখন ফিরবো কিছু বলেছে?
মা কিছু বলার আগেই বাবা বললেন, সে কি আর ঘুরে বেড়ায়? সারাদিন কি পরিশ্রমই করে মেয়েটা। ঠিকই বলেছ নিজেদের সংসার বাঁচাতে মেয়েটার বিয়ের কথা ও ভাবতে পারি না, মায়ের গলায় আক্ষেপের সুর।

বেশ রাত করেই ফিরেছিলো সেদিন তিতির, কেউ তাকে পৌঁছে দিয়ে গেছিলো তা তিতাসের নজর পড়েছিলো।
রাতে শুতে এসে সে দিদি কে বললো তোকে একটা কথা বলবো দিদি! তিতির ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো কি বলবি? দেরী না করে তিতাস বলে তুই ঐ ছেলেটার সাথে মিশিস না, ও মোটেই ভাল না।
রেগে বললো তুই কি আজকাল গোয়েন্দাগিরি করছিস নাকি? কতটুকু চিনিস তাকে?
তাকে থামিয়ে তিতাস বললো আস্তে মা শুনতে পাবে যে,

গলা নামিয়ে বললো আমি শুধু তোদের সবার কথাই ভাববো, আর নিজের কথা কবে ভাববো তবে? কতটাকা জমানো আছে আমাদের বিয়ে থা র জন্য। অনেক ভেবে দেখলাম, তুই নিজে টিউশনি করে তোর পড়ার খরচের সাথে মায়ের হাতে কিছু দিস। বাবা কিছু রোজগার করছে এখন, আমি অল্প কিছু দিলে তোরা ভালোই চলতে পারবি।
কি বলছিস দিদি তুই?

ভুল বুঝিস না আমায় বোন, আমি ও কে খুব ভালোবাসি রে। আমার পাশে ও না থাকলে আমি এতোটা করতে পারতাম না, সবসময় তাকে আমার পাশে পেয়েছি, যখন দরকার তার কাছে হাত পেতেছি। সে সবার কাছে খারাপ হলেও আমার কাছে অনেক ভালো। আমি তাকেই বিয়ে করবো।

কখন যে মা ঘরের দোরে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছিলো তারা কেউ খেয়ালই করে নি। মা কে দেখে তারা থেমে যায়।
মা ঘরে এসে বললো মেয়ের রোজগার খাওয়ার চেয়ে আমাদের মরণ অনেক ভালো। সোমত্ত মেয়েকে বিয়ে দিতে পারি না সে কি আমাদের লজ্জা নয়, ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো মা, তিতাস মাকে শান্ত করিয়ে অনেক রাতে বিছানায় এলো।

তখনো তিতির ঘুমাই নি। সে বললো তুই মা বাবা কে একটু বোঝা, আমি ও কে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।

তিতাসের কষ্ট হচ্ছিলো দিদির জন্য, সে বোঝানো ছাড়া আর কি বা করতে পারে,
সকাল থেকে বাড়িতে অশান্তি ,মনোমালিন্য ,বাবা খুব উত্তেজিত। দিদি কিছু না খেয়ে বেরিয়ে গেলো। তিতাসের কলেজ যাওয়া হলো না সেদিন।

বাড়ির পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক, রাতে দিদি বাড়ি ফিরে বললো মা আজ জমিয়ে রান্না কর তো, মাংস আর ফ্রাইড রাইস ।এই দুটো আমার ফেভারিট, আমি সব নিয়ে এসেছি।

সেদিন একসাথে খেয়ে ওঠার পর বাবার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করলো দিদি, খুব খুশি ছিল সে।
রাতে শুতে এসে তিতাস কে বললো কাল আমি বিয়ে করছি, তুই একটু সবাইকে সামলে নিস, আমি এই শহরেই থাকবো, যখন যে ভাবে পারবো সাহায্য করবো।

সকালে সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগে তিতির চলে গেছিলো। কিছু টাকা রেখে গেছে টেবিলের ওপর।
খুব কষ্ট হচ্ছিলো তিতাসের দিদি বিয়ে করেছে বলে নয়, ঐ ছেলেটাকে বিয়ে করেছে জন্য।
বুবাই দার কাছ থেকে অনেক কিছু জেনে ছিলো তিতাস।

শুভম দার বাবা মা ছোটতেই মারা গেছে আ্যক্সিডেন্টে। পিসি তাকে বড় করেছে, একটু বড় হতে একবার গন্ডগোল করে কিছুদিনের জন্য কোথায় চলে গেছিলো পরে ফিরে আসাতে ওকে আর ঘরে ঢুকে দেয়নি পিশেমশাই। তারপর থেকে সে একাই থাকে একটা বাড়ি ভাড়া করে।
রাজনীতি করে, টুকটাক প্রোমটিং ও।

খুব কষ্ট হতো দিদিকে ছেড়ে থাকতে তিতাসের। পাছে মা বাবা কষ্ট পায় তাই কাঁদতেও পারতো না তিতাস।
একদিন মা তিতাসকে ডেকে বললো মেয়েটা সেই যে চলে গেলো, কেমন আছে দেখে আসবি একবার, খুব কষ্ট হয় রে মেয়েটার জন্য। যা না একবার দেখে আয়। দেখিস বাবা যেন না জানতে পারে।

মা বলাতে দিদির কাছে গেছিলো তিতাস, যাওয়ার সময় একটা পাতলা চেন মা দিয়ে বললেন এটা দিদিকে দিস, বলিস মা আশীর্বাদী পাঠিয়েছে। যাওয়ার সময় দিদির প্রিয় মিষ্টি কিনে নিয়ে গেছিলো সে।

দিদির ঠিকাণা পেতে অসুবিধা হয়নি, শুভম দার নাম বলতেই দেখিয়ে দিয়ে একজন বলেছিলো ঐ যে সবুজ রঙের গেট দেওয়া বাড়িটায় শুভম মস্তান থাকে।

দরজা ঠেলতেই দরজা খুলেছিলো তিতির,ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলো তিতাস কে দেখে। তিতাস তিতির কে জড়িয়ে ধরে বললো মা পাঠিয়েছে রে দিদি, কতদিন তোর আশার পথ চেয়ে বাবা বসে আছে, বাড়ি যাবিনা দিদি!

আয় আয় ভেতরে আয়, বাবা কেমন আছেন রে, আমায় কি ক্ষমা করেছেন? তিতিরের চোখটা ছল ছল করছিলো।
তিতাস বললো বাবা রাগ না রে দিদি তোর উপর অভিমান করে বসে আছে, বাড়ি চল দিদি, দেখ মা তোর জন্য এই চেনটা দিয়েছে।

এটা তুই কেন নিয়ে এলি বোন, এটুকু ছাড়া মায়ের কাছে তো আর কিছু নেই ।হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো তিতির।
কার সাথে কথা বলছো গো তুমি,, বলতে বলতে এগিয়ে এলো শুভম দা, তিতাস কে দেখে বললো এসো শ্যালিকা ,তোমার দিদির বাড়িতে এসো।

বেশ কাটলো দিদির বাড়িতে, শুভম দা বললো, আমি খুব খারাপ ছেলে ছিলাম। কোনো বাবা মা নিজের মেয়ে কে এমন ছেলের হাতে তুলে দেবে বলো তো? তাই তো তোমার দিদি বাড়ি ছেড়ে ছিলো আমার জন্য।
আর একটু সময় দাও আমায়, তোমার দিদির উপযুক্ত করে নিজেকে তৈরি করি, তারপর নিজেই তোমার দিদি কে ওবাড়ি তে নিয়ে যাবো।

মন ভালো হয়ে গেল শুভম দার কথা শুনে, দিদির জন্য যে নিজেকে বদলাচ্ছে সে নিশ্চয় দিদি কে ভালো রাখবে।
সে বাড়ি ফেরার জন্য উঠতেই তারা দুজনে বলে উঠলো আর একটু থেকে যাও,

তাদের দিকে তাকিয়ে তিতাস বললো আজ আসি আমি,পরে একদিন মা বাবাকে নিয়ে আসবো।
শুভম দা বললো তোমায় কথা দিলাম তিতাস, তোমার দিদি কে আমি সুখে রাখবো।
খুশী মনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানায় তিতাস।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত