মা উচ্চকন্ঠে ডাক দিতেই চমকে উঠি। জানালার কাছে পর্দা সরিয়ে মুখ বাড়িয়ে বৃষ্টির সাথে আমার গান হচ্ছিল, গান আমি গাইতে পারি না। বৃষ্টি দেখলে,শব্দের সাথে আমার সুর কেঁচে ওঠে। বৃষ্টির আগমনী সংকেত থেকেই আমি অধীর হয়ে উঠি। টের পাই, আমার যাতনা জুড়ে রুমরুম কলাপাতার চামর। পায়ের শব্দে অচেনা ধ্বনি।
কোন কোন পাখি গলা বাড়িয়ে তারস্বরে চেচাঁয়,পাশের বাসার আন্টি মোটা শরীর আর এক মন্ত্রণালয় সমান বিরক্তি নিয়ে ছাদে শুকাতে দেয়া কাপড়,আচারের বয়াম সরাতে সরাতে খিটখিটে হয়ে ওঠেন,ছোট মেয়েটাকে জোরে জোরে ডাকেন।
: অমৃতা! এই অমৃতা!
: আদেশ করো মা গুরুজন।
: কি করো পাজি মেয়ে? ডাকি, কথা কানে যায় না?
: মা, শোবার ঘরে ন্যাংটুপুটু ছিলাম, ডাকলেই তো আসা যায় না, রেডি হয়ে এলাম।
আন্টি অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বজ্রপাতের তীব্র বিদারী শব্দেও ভাবান্তর হয় না। এই এক রত্তি মেয়ে। সেদিন পর্যন্ত ভাত না মেখে দিলে খেতে পারত না, কী বলে এসব মেয়ে!
আন্টির হার্টফেল করার ক্ষণ।
: মাইক এনে দেই? দুনিয়া জানান দাও। এতো ডিটেইল শুনতে চেয়েছি আমি?
: মা, তোমাকে সত্যি কারণটা বললাম। তুমি কি চাও আমি মিথ্যা বলব?
আন্টির মুখ লাল হতে থাকে। বুকের ধুকপুক থামে না, আগে থেকেই এই শরীরে ছাদে আসার হাঁপরে হাঁপাচ্ছিলেন, মনে হয় আরো বাড়ছে…
আমি রাজ্যের আনন্দে অমৃতার দিকে তাকিয়ে থাকি। শুকনো মতো বিস্কুট কিউট একটা মেয়ে। কী পড়ো তুমি অমৃতা? ফার্স্ট ইয়ার? সেকেন্ড ইয়ার?
আমি বৃষ্টির ডাকাত ছেনি কুঠারে অমৃতার কাছে জানালা দিয়ে অদৃশ্য বার্তা পাঠাতে থাকি। অমৃতা, তুমহারি অমৃতা, আমার যাযাবর বন্ধু হবে তুমি?
সে যদি নেচে যায়, সে যদি টলটল, সে যদি পাখির পালকের ভেজা কলা পাতা বৃষ্টি মুনমুন করে নামে। আমি মুখ বাড়াতে থাকি। এতো ঝুপ এতো ঝম এতো ভাটিয়ালী এতো টুম্পা এতো রুম্পা এতো ঝুম্পা এতো মগ্ন বৃষ্টির দাপুটে হানা, আমি দেখতে পাই, ভিজতেই থাকি…ভিজে ভিজে একশা..
মা বললেন,
: পুটলী, জানালা থেকে সরে এসো। জ্বর বাঁধাবে আবার। এসো কাবাব ভেজে দিই, খাবে এসো।
আমার এক কান কাবাব ভাজার শব্দে সচকিত হয়, অবয়ব দেখতে থাকি গোল গোল কাবাবগুলো নেচে নেচে প্লেটে তুলকালাম করছে, লাল সস পাশে হিহি করে হাসছে। কাবাব আমার সাথে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলছে।
: আমাকে খাবে তুমি পুটলী?
: খবরদার, আমাকে পুটলী বলবে না। আমি বড় হয়েছি।
কাবাবগুলো ফুটবলারদের গোল করার ভঙ্গিতে আনন্দ করতে থাকে যেন আমাকে পুটলী বলায় জিতে গেছে ওরা।
মা আমার গায়ে একটা বুনো রঙ চাদর দিয়ে দেয়, আমি টের পাই, ন্যাপথালিন ঘ্রাণ চাদর থেকে। এতো দামাল বৃষ্টির ঘ্রাণ জানালা জুড়ে ভেসে থাকে, চোখের পাতায় মিহি ছাটের রেণু কণা যে টের পাই শরীরে প্রতি কোষ বেয়ে ব্যাথা, তীব্র ব্যাথাটা ছড়াচ্ছে। শক্ত করে জানালার কাচ ঠেস দিয়ে থাকি।
বৃষ্টির মতো আমার মুখ জলরঙ হতে থাকে, ফ্যাকাসে হতে থাকে। টের পাই লিউকোমিয়া জিতে যাচ্ছে, বৃষ্টি পরাজিত হতে যাচ্ছে।
ব্যাথায় নীল হতে হতেও টের পাই, বাবার ফোন বাজছে কোথাও।
: মা রে, আর কটা দিন। টেরি ফক্স হাসপাতালে তোর ভর্তি হয়ে যাবে। আমি আসছি। আর ক’টা দিন। মনে আছে সেই কানাডার ছেলেটা? টেরি ফক্স। ক্যানসার নিয়ে মাইলের পর মাইল দৌঁড়াচ্ছে। এক পা নিয়ে…ফান্ড তুলছে… তুষার পড়ছে, পেছনে টিভি ক্যামেরা… কমেন্টেটর বলেই যাচ্ছে
হিয়ার ইজ আওয়ার ব্রেইভ টেরি ফক্স…
মা ওয়েট ওয়েট ওয়েট…
বাবা কি কথা বললেন এতোক্ষণ? এখন কি কানাডায় গভীর রাত? আমি কি স্বপ্ন দৃশ্য দেখছি?
অচানক মনে হলো শহর ডুবে যাচ্ছে অপূর্ব সুন্দর বৃষ্টির নন্দন কাননে। পাশের বাসা, দূর দেখা যায় ধোঁয়া বৃষ্টি যমুনা, আহা আমার মতো রাই কিশোরী।
অমৃতার অস্পস্ট ছায়া দেখা যাচ্ছে কি ছাদের চাতালে? ও কি ভিজছে ঝুপঝুপ? ও কি মুনমুন? ও কি টুনটুন?
আমার হাত ধরো অমৃতা। আমাকে ধরো তো বন্ধুটা। প্লিজ। আমি মরব না তো। ডক্টর বলেছে কানাডায় ভালো হবো আমি ..
এতো গহীন শব্দের তরাস গর্জন, ভাসতে থাকলো আমার চারপাশে সাঁওতাল মেয়েদের মতো খোঁপায় তারার ফুল পরে।
এতো আশ্চর্য সুন্দর করে মা, বাবা আমার দুই হাত ধরে আছে। কী মায়া! কী মায়া!
এই অমৃতা তুমি কি ফার্স্ট ইয়ার? আমার সমান? কাঁদছো কেন?
ডোন্ট ক্রাই ডোন্ট ক্রাই ..
বৃষ্টিতে আঁধারে শোঁ শোঁ শব্দ কান জুড়েই ভাসতে থাকল।