যে কথা বলা হয়নি

যে কথা বলা হয়নি

আমার বাবা খুবই বোকা ধরনের লোক। সারাজীবনই চাকরীসুত্রে বাইরে বাইরে কাটিয়েছেন। দূরত্ব বিবেচনা করলে,মার সাথে আমার দূরত্ব এক ইঞ্চি হলে, বাবার সাথে কয়েক আলোকবর্ষ। বাবা ছিলেন আমাদের দুই ভাইের প্রধানতমশত্রু। ছোটকাল থেকেই আমরা দুই ভাই চূড়ান্তভাবে স্বাধীন। মা আমাদের টাইট দেওয়ার চেষ্টা করতেন অবশ্য। কিন্তু সে চেষ্টায় বিশেষ কোন লাভ হয়নি।

আমাদের টাইট দিতে পারতেন আমাদের বাবা। ছয়ফুট শরীরের বিশালদেহী একজন মানুষ। সাধারণ শিশুরা ছুটি ছাটায় বাবারা বাড়ি এলে, পর্যাপ্ত পরিমানে খুশি হয়। আমরা দুই ভাই অসাধারণ ছিলাম। বাবা বাড়ি এলে আমরা কখনই খুশি হতে পারিনি। বাবা যে কয় দিন বাড়িতে থাকতেন, আমাদের উপর সামরিক আইন চালু করা হতো। হেন অপরাধে চড় খেয়ে আমরা ভূপতিত হতাম। আমি বয়সে একটু বড় ছিলাম বলে, বাবার মৃত্যু কামনা করতে পারিনি। কিন্তু আমার ছোটভাই আমার মত ছিল না। তার শিশুকালের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময় গিয়েছে বাবার মৃত্যু কামনা করে।

২০০১ সালে আমাকে শায়েস্তা করার জন্য ক্যাডেট কলেজে পাঠানো হয়। বলা যায়, আমি বাবার অত্যাচার থেকে বেঁচে গেলাম। কিন্তু আমার ছোটভাই বেচারা একা পড়ে গেল। মাঝে মাঝেই ও আমাকে চিঠি লিখতো। জ্বালাময়ী ভাষায় লেখা বিশাল বিশাল সব প্রতিবাদী চিঠি। চিঠির শেষের দিকটায় কেন জানি প্রতিবারই একই ধরনের লাইন লিখা থাকতো।

“ভাইয়া আরেকটু বড় হয়ে নিই। ওরে(বাবাকে) দেখে নিব। তুই টেনশন নিস না।”

আমাকে খুব একটা টেনশন করতে হয়নি অবশ্য। আমার অত্যাচারী বাবা এর কিছুদিন পড়েই বাড়াবাড়ি রকমের ভাল হয়ে গেলেন। এর পেছনে অবশ্য একটা ঘটনা ছিল।

২০০১ সালের অগাস্টের বারো তারিখে আমার দাদা মারা যান। আমার বাবা তখন চাকুরীসুত্রে রাঙ্গামাটির বরকল নামে এক জায়গায়। বাবাকে খবর পাঠানো হল, যে তাঁর বাবা অসুস্থ। উনি যাতে যতদ্রুত সম্ভব বাড়ি চলে আসেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম তখন খুবই অস্থিতিশীল। আমার বাবা আসতে পারেলন না। উনি আসলেন চার দিন পর।

এসেই ভয়াবহ ধরনের পাগলামি শুরু করলেন। আমার দাদার কবরের পাশে উদ্ভ্রান্তের মত সারাদিন বসে থাকেন। কেউ কাছাকাছি না থাকলে, কবরের খুব কাছাকাছি চলে যান। আমি আর আর আমার ছোটভাই দূর থেকে বাবাকে দেখি। বাবার কাছে যাওয়ার মত সাহস আমদের হয়না। অবস্থা চরমে পৌঁছালে আমরা দুই জন বাবার কাছে গেলাম। তিনদিন পর আমার বাবা কাঁদলেন। আমাদের দুই ভাইকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মত কান্না।

বাবা সে বছরই চাকুরী ছেড়ে দিলেন। আমরা দেখলাম,সীমাহীন দুঃখ চোখে মুখে নিয়ে একজন মানুষ আমাদের চার পাশে ঘোরাফেরা করছেন। তাঁর পায়ের শব্দ আমরা শুনি, কিন্তু তাঁর অস্তিত্ব টের পাই না। আমার সাথে বাবার দূরত্ব সব সময়ই বেশি। সে দূরত্ব আরও বাড়লো। শুধু আমার সাথে না, সবার সাথেই বাবার দূরত্বটা বেড়ে গেল। বাবা সারাদিন চুপচাপ বসে থাকেন। বুক পর্যন্ত লম্বা দাড়ি রাখলেন। একটা কথা বলে রাখা ভাল, বাইপাস সার্জারি করার সময়টুকু বাদে আমার বাবা কখনই নামাজ ক্বাযা করেন নি। চোখের সামনে বাবা সম্পূর্ণ অন্য একটা মানুষে বদলে গেলেন।

আমি কলেজে ফিরে গেলাম। প্রতিবার অভিবাবক দিবস সবার বাবা-মা একসাথে আসেন। আমার আসে একজন। শুধু মা। বাবা আসেন না। ক্যাডেট কলেজের ওই কঠোর শৃঙ্খলিত পরিবেশে আমরা খুব ছোট থেকেই শিখে গিয়েছিলাম,কিভবে বাবা-মা ছাড়া একা একা থাকতে হয়। কান্না আসলে, কিভাবে সে কান্না চেপে রাখতে হয়। আমার বন্ধুরা তবুও মাঝে মাঝে রাত গভীর হলে, কান্না কাটি করতো। আমার ভেতরে মায়া দয়া কম। আমি কখনো কাঁদিনি। তারপরও অভিভাবক দিবসগুলোতে শুধু মাকে আসতে দেখে, কারণ ছাড়াই ঝামেলা করতাম। আমার খুব ভাল মানুষ বাবাকে আমার মা ফিরে গিয়ে কখনো অভিযোগ করতেন কি না, তা আর জানা হয় নি। আর এই সব বলেও বিশেষ কোন লাভ হতো না। আমার বাবা তখন দরবেশগিরিতে ব্যস্ত। পুত্রের এই সব জাগতিক অভিমানের ফাউল গল্প শোনার টাইম তার হাতে নাই। উনি ঘর থেকেই বের হন না।

বাবা কলেজে প্রথম দিন একবার আমাকে রাখতে এসেছিলেন। তারপর আর আসেন নি। আমার বন্ধুরাও জানতো অন্য সবার মত আমারও একজন বাবা আছে। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে উনি আমার কলেজে আসেন না। ক্লাস টেন পর্যন্ত এভাবেই গেল। বাবা আমার কলেজে আসলেন না।

একাদশ শ্রেণীতে উঠে আমি বেশ বড় হয়ে গেলাম। কলেজের চার দেয়ালের সীমানা টেনে দেওয়া জীবন ভাল লাগে না। নতুন নতুন সিনিয়র হয়েছি। নিয়ম ভাঙার ক্ষমতা আর সাহস দুইটা এক সাথে পেলাম। বাবা-মার জন্য মন খারাপ হওয়ার যে ব্যাপারটা ছিল, সেটা কমে গেল। আসলে মন খারাপ হওয়ার মত সময়ই ছিল না। দুনিয়ার তাবৎ বাঁদরামিকে আমরা আমাদের ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা দিয়ে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলাম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিল। রাতে প্রেপ টাইমে আমাদের কখনই ক্লাসে পাওয়া যেতো না। দেখা যেতো, আমরা ফুটবল মাঠের কোনায় অন্ধকার দিকটায় ঘাসের উপরে শুয়ে আছি। চোখ মুখে দুর্দান্ত একটা দার্শনিক ভাব নিয়ে আমরা আকাশের তারা দেখি। পড়াশুনা আগেও যে খুব একটা করতাম এমন না, তবে একাদশ শ্রেণীতে উঠে পুরোপুরি ছেড়ে দিলাম। দিন যায়, দিন আসে কিন্তু আমার বই খাতা চির নতুনই থাকে, পুড়নো আর হয় না।

পরীক্ষার আগে আগে হাজারী আর নাগ সাহেবের রসায়ন আমাদের সাপ হয়ে কামড়াতে আসে। আসুক, সমস্যা কি?? পরীক্ষা পাশের চেয়ে তখন পৃথিবীতে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। আমরা সেই সব কাজে মনোনিবেশ করলাম।আমাদের অত্যাচারে কলেজ প্রশাসন একটা সময়ে নড়ে চড়ে বসে। আমাদের নিয়মিত বিরতিতে ডলা দেওয়ার একটা চেষ্টা অব্যাহত থাকলো। কিন্তু আমাদের চামড়া তখন গণ্ডারের চেয়েও মোটা আর টাকি মাছের চেয়েও পিচ্ছিল। কোন ধরেনের শাস্তিতেই আমাদের কিছু হয় না। শেষে এসে কলেজে প্রশাসন যা করলো, তার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।

দিন ক্ষণ ধার্য করে আমাদের অভিভাবকদের ডাকা হলো। সবারই অল্প বিস্তর মন খারাপ। নিজেরা বাঁদর হতে পারি, নচ্ছার হতে পারি,এটা মেনে নিয়ে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি পেতে আমাদের কোনই সমস্যা নেই। কিন্তু আমাদের সবার বাব-মা ই খুবই ভাল। এটা তাদের দুর্ভাগ্য যে তারা আমাদের মত সন্তান জন্ম দিয়েছেন। আমাদের করা অপরাধের শাস্তি পাবেন তাঁরা। তাঁদের ডেকে নিতান্তই অপমানজনক কিছু কথা বলা হবে। ক্ষেত্রবিশেষে যা না, তাও বলা হবে।

আমার বন্ধুদের সবারই আতংকে দিন কাটছে। তাদের বাবা-মাকে ডেকে এনে ছোট করা হবে। আমিও যে খুব সুখে আছি, এমনটা না। তবে ওদের চেয়ে আমার টেনশন একটু কম। আমার বাবা কলেজে আসেন না। আমার আসেন মা। মা’রা সব কিছু খুব তারাতারি ভুলে যান। আমার মা ও ভুলে যাবেন।

নির্ধারিত দিনে আমরা প্রিন্সিপালের রুমের দাড়িয়ে আছি। ইতিমধ্যেই কারও কারও বাব-মা চলে এসেছে। যাদের বাবা-মা চলে এসেছেন, তারা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। আমার এই বন্ধুরা খুব একটা লজ্জা পাওয়ার ভাব ধরেছে। ক্যাডেট আর যাই পাক, লজ্জা পায় না। লজ্জা জিনিসটা আমরা কলেজে প্রবেশের পূর্বেই যে মেডিকেল চেক আপ হয়, সেখানে বিসর্জন দিয়ে এসেছি। তবুও পরিস্থিতি বলে কথা। আজকে আমাদের লজ্জা পাওয়ার ভাব ধরতে হবে। আমি অপেক্ষা করছি। কখন আমার মা আসবে, আর আমি লজ্জা পাওয়ার অভিনয়টুকু শুরু করবো।

সৃষ্টিকর্তা সেদিন আমার জন্য বিশাল একটা সারপ্রাইজ রেখেছিলেন। উনি সেদিন আমার মা কে অসুস্থ বানালেন। দীর্ঘ চার বছর পর আমার বাবা আমার কলেজে আসলেন। শুরুতে আমার বিশ্বাস হয় নি। দূর থেকে দেখছিলাম বুক পর্যন্ত লম্বা দাড়িওয়ালা এক লোক ধীর পায়ে এই দিকে আসছে। দুনিয়াতে দারিওয়ালা হুজুরের অভাব নেই। খুব চাইছিলাম যাতে এই লোকটা আমার বাবা না হয়। আমার চাওয়াটা আমার মত হয় নি। কাছে এসে বাবা খুব শান্ত ভাবে আমার চোখে চোখ রাখলেন। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। আসলে চোখ না নামিয়ে উপায় ছিল না। পৃথিবীতে খুব শর্ট লিস্টেড কিছু হতভাগা আছে, যাদের জন্য তাদের বাবা-মা রা অপমানিত হয়। আমি সেই শর্ট লিস্টেড কুলাঙ্গারদের এক জন।

এর পরের সময় টুকু জীবনে ভুলতে পারি নি। বোধহয় পারবোও না কোন দিন। আমার সামনে বাবা কে যা বলা হল,তাতে আমার কেমন অনুভূতি হলো জানিনা। আমি শুধু দেখলাম আমার বিশালদেহী বাবা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাচ্ছেন। এক পর্যায়ে বলা হলো, আমাকে কলেজে রাখা হবে না। বাবা চাইলে আমাকে তার সাথে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন।আমি খুব ভাল করে জানি, এই সব তুচ্ছ কারণে বহিষ্কারের ক্ষমতা জনাব অধ্যক্ষ রাখেন না। উনার বড় অংকের একটা জরিমানা করার পরিকল্পনা। সে জন্য নাটক সাজাচ্ছেন। ব্যাপারটা আমি বুঝলাম, আমার সহজ সরল বাবা বুঝলেন না। চোখের সামনে তাকে ভেঙে পড়তে দেখলাম। অধ্যক্ষ সাহেব বুঝলেন তার গুটির চাল জায়গামত পড়েছে। উনি এমন একটা ভাব নিলেন যে, এবারের মত ক্ষমা করে দেওয়া হলো। কিন্তু ফ্রিতে না। উনার ক্ষমারও একটা অর্থমূল্য আছে। জরিমানার টাকার অংকটা বাবাকে জানিয়ে দেওয়া হলো।

বাবা প্রিন্সিপালের রুম থেকে বের হয়ে সোজা হাঁটা দিলেন। ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটুকুও উনি আমাকে দিলেন না। অবশ্য উনি যে আমাকে সুযোগ দেবেন, এটাও বা আমি আশা করি কিভাবে? কুলাঙ্গার সন্তানদের আবার কিসের ক্ষমা? সেদিনের জন্য বাবার কাছে পড়েও আর কোনদিন ক্ষমা চাওয়া হয়নি। বাবা’রা বোধহয় সন্তনাদের চির অপরাধী করে রাখতে ভালবাসেন। সেদিনের পর বাবা আর কোনদিনই আমার কলেজে আসলেন না।

বাবাকে নিয়ে এই লেখাটার ইতি টেনে দিচ্ছি। কেন জানি এই লেখাটাকে আর দীর্ঘ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শেষ করার আগে কিছু কথা বলা দরকার। আমার বাবার কোন ইচ্ছাই আমি পূরণ করতে পারিনি। বাবা খুব চাইতেন, তাঁর ছেলে ভাল ছবি আঁকবে। দুঃখজনকভাবে আমার চিত্রাঙ্কন প্রতিভা আজীবনই ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ আর বৃত্ত আঁকানোর মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। বাবা চাইতেন, তাঁর বড় ছেলে তাঁর কাছে থাকুক। তাঁর সে ইচ্ছাও পূরণ করা হয়নি।

দেশ ছাড়ার আগে আমাকে বিদায় জানাতে সবাই এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত এলো। বাবা এলেন না। উনি আমাকে বিদায় দিলেন এয়ারপোর্টের বাইরে থেকে। আমার বোকা বাবা,হয়তো খেয়াল করলেন না। কিন্তু আমি ঠিকই খেয়াল করলাম। এয়ারপোর্টের বাইরে খুব অভিমানী একজন মানুষ কোনভাবেই তাঁর কান্না থামাতে পারছেন না। এয়ারপোর্টর মোটা কাঁচের এপার থেকেও এই লোকের কান্না আমাকে বড়সর একটা ধাক্কা দিল। আমি এলোমেলো হয়ে গেলাম।

খুব ইচ্ছা করলো, বাবার পাশে দাড়িয়ে তাঁর হাতটা ধরে বলি, “বাবা মানুষ হিসেবে আমার ক্ষুদ্রতা খুবই বেশি। আমি অনেক বড় হতে চাই। তুমি আমাকে দোয়া করে দাও। আমি তোমার মত একজন বাবা হব।”

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত