আষাঢ় মাসের দুপুর। কিছুক্ষণ আগেই ভারী এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখনও আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়াও দিচ্ছে বেশ জোরে।
গঙ্গাধর হাই স্কুলের বন্ধ গেটের সামনের ফুটপাথে ব্যাজার মুখে গালে হাত দিয়ে বসেছিল লোটন। মনে মনে ভাবছিল, গরমকালটা বিদায় নিল মানেই তার সুখের দিন গেল। এই তো, একটু আগে ইস্কুলের টিফিন পিরিয়ড শেষ হল। ছেলেরাও রোজকার মতনই হই হই করে গরাদ দেওয়া উঁচু গেটটার ওদিকে এসে জড়ো হয়েছিল। কিন্তু গেটের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে ক’জন তার কাছে থেকে আইসক্রিম কিনল? মাত্র পাঁচজন।
অথচ মাত্র দিন পনেরো আগে, যখন কাঠফাটা রোদ্দুরে পৃথিবী ঝলসে যাচ্ছিল, তখন লোটন এই গঙ্গাধর ইস্কুলের গেটে দাঁড়িয়েই একেকদিন টিফিন-টাইমে তিরিশ-চল্লিশটা আইসক্রিম বিক্রি করেছে। তারপরেও স্কুল ছুটির সময়ে আরও কুড়ি-তিরিশটা। সবশেষে বাড়ি ফেরার পথে কিছুক্ষণ লেবুতলা পার্কের সামনে দাঁড়াত লোটন। সেখানেও কিছু বিক্রিবাটা হত। কিন্তু যেই না গ্রীষ্ম গিয়ে বর্ষা নেমেছে, ব্যস, সেল এক্কেবারে ডাউন। এখন সবাই আইসক্রিম ছেড়ে ফুচকা আর আলুকাবলিই বেশি খাচ্ছে।
হতাশ লোটন আইসক্রিমের কাঠের বাক্সটার ডালাটা বন্ধ করে সেটার গায়েই হেলান দিয়ে ফুটপাথের ওপর পা ছড়িয়ে বসল। এখনও ইস্কুল ছুটি হতে আরও দু’ঘন্টা দেরি। ততক্ষণ তো অপেক্ষা করতেই হবে। দেখতে হবে বাড়ি ফেরার সময় যদি স্কুলের ছাত্ররা কিছু কেনাকাটা করে। না হলে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে চাল কেনার পয়সাটাও তো সে তুলে দিতে পারবে না। তার ওপরে আবার ছোটবোন ছুটকির স্কুলের জামাটা এক্কেবারে ছিঁড়ে গেছে। একটা জামা না কিনে দিলে ছুটকির স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। কোত্থেকে সে পাবে এত টাকা, যদি আইসক্রিমই না বিক্রি হয়?
লোটনের পাশেই বসেছিল হজমিওলা সুখলাল। সুখলাল লোটনের থেকে বয়সে অনেকটাই বড়ো। লোটনের বয়স তেরো, আর সুখলালের বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ। তবু গত দু’বছর ধরে একই সময়ে, একই স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে খাবার বিক্রি করতে করতে দু’জনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সুখলাল খুব ঘুমকাতুরে। ও এক্ষুণি স্কুলের পাঁচিলে হেলান দিয়ে বসে ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকাতে শুরু করবে। সেটা জানে বলেই আর দেরি না করে লোটন সুখলালের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল। বলল, “দাও দেখি, আজ কী বই এনেছ।”
রোজই এক কথা শোনে সুখলাল। তবুও রোজই হেসে ফেলে। আজকেও হাসতে হাসতে বলল, “তোর বড়ো আজব শখ লোটন। কী করবি বই পড়ে? তোকে কি পরীক্ষা দিতে হবে?”
লোটন বলল, “না, সুখলালদা। পরীক্ষা আমাকে আর দিতে হবে না। ক্লাস ফাইভের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ফার্স্ট হলাম, আর তারপরেই বাবা মারা গেল। ব্যস, আমাকেও স্কুল ছেড়ে দিতে হল। তবু এখনও বই পড়তে এত ভালো লাগে, তোমাকে কী বলব। এত আশ্চর্য সব জায়গা আছে, এমন অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে এই পৃথিবীতে! সেইসব কথা বইয়ের পাতা থেকে পড়তে পড়তে মনে হয় অন্য কোথাও চলে গেছি।”
সুখলাল আর কথা না বাড়িয়ে তার বিলিতি আমড়া, হজমিগুলি, শেঁয়াকুল আর আচার রাখার ঝুড়িটার একপাশ থেকে একটা ছেঁড়া বই বার করে লোটনের হাতে গুঁজে দিল। এরকম একটা করে বই সে রোজ পুরনো বইখাতাওলার কাছ থেকে কিনে নিয়ে আসে। বইয়ের একটা করে পাতা ছিঁড়ে তাতে হজমিগুলি, আচার, আমড়া এইসব মুড়ে ছেলেদের হাতে ধরিয়ে দেয়। লোটনের খুব কষ্ট হয় সুখলালকে এইভাবে বই ছিঁড়তে দেখলে। কিন্তু সুখলালই বা কী করবে? ছেঁড়া পাতা ছাড়া আর কীসে করেই বা সে জিনিস দেবে?
তবে লোটন রোজই টিফিন-টাইমের পর থেকে ছুটি অবধি দু’ঘন্টা সময়ের মধ্যে সুখলালের বইটা উলটে পালটে দেখে নেয়। বেশিরভাগ দিনই কোনও না কোনও গল্পের বই থাকে। ভূগোল, ইতিহাস, বাংলা থাকলেও যথাসাধ্য সেগুলোকে বোঝবার চেষ্টা করে লোটন। শুধু ইংরিজি আর অঙ্কের বই হলেই সে মুশকিলে পড়ে যায়। ওইগুলো তো মাস্টারমশাই বুঝিয়ে না দিলে বোঝা যায় না।
অনেক সময় হয় কী, একটা গল্পের শেষদিকে এসে লোটন দ্যাখে, শেষ কয়েকটা পাতা ইতিমধ্যেই ঠোঙা হয়ে ছেলেদের হাতে চলে গেছে। তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোটন গল্পের বাকিটা নিজের মনের মধ্যে বানাতে শুরু করে। এইভাবে সময় কেটে যায়। ছুটির ঘন্টা বেজে ওঠে – ঢং, ঢং, ঢং। সুখলাল চোখ কচলে উঠে বসে। লোটনও আইসক্রিমের বাক্স বুকে ঝুলিয়ে স্কুলের গেটের দিকে এগিয়ে যায়।
আজ অবশ্য কোনও গল্পের বই নয়, একটা একেবারে অন্যরকম বই হাতে পেয়ে গেল লোটন। বইটা পাখিদের পরিযানের ওপরে লেখা। এক দেশের পাখিরা যখন দল বেঁধে অন্য দেশে উড়ে যায় তাদের সেই যাত্রাকে বলা হয় পরিযান। উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি যেসব পাখিরা থাকে তারা শীতকালে পৃথিবীর মাঝামাঝি কোনও গরম দেশে পালিয়ে যায়। ওদের নিজেদের দেশে তখন সমস্ত জলা, জঙ্গল, মাঠঘাট বরফে ঢাকা পড়ে যায় কিনা, তাই। সেই বরফে ঢাকা দেশে পাখিরা খাবে কী?
আবার যখন বসন্তকালে বরফের চাদর সরিয়ে নীল হ্রদ আর সবুজ মাঠ বেরিয়ে আসে, তখন সেই পাখিরা গরম দেশ ছেড়ে শীতের দেশে, মানে নিজেদের দেশে ফিরে যায়। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পরিযায়ী পাখিরা এইভাবে বছরের দুটো সময় দুটো দেশে কাটিয়ে আসছে।
বইটা পড়তে পড়তে একটা চিন্তা হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতন লোটনের মাথায় খেলা করে গেল। তাই তো! পাখিরা যদি পারে, সেই-ই বা কেন পারবে না? সেও তো পারে পরিযায়ী হতে। গ্রীষ্মকালকে অনুসরণ করে সেও-ও তো চলে যেতে পারে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। যেখানে গ্রীষ্ম সেখানেই তার আইসক্রিমের বাক্স গলায় ঝুলিয়ে হাজির থাকবে আইসক্রিমওলা লোটনচন্দ্র দাস।
লোটন মনে মনে ভাবে, আচ্ছা, কয়েকদিন আগেই যে গরম হাওয়ার হলকা বওয়া দুপুরগুলো এই কলকাতায় ছিল, সেই দুপুরগুলো এখন ঠিক কোথায়? ধানবাদে? নাকি রাজস্থানে? নাকি আরও দূরে কোথাও চলে গেছে তারা? যেখানেই যাক, সেখানকার বাচ্চাগুলো নিশ্চয় গরমে হাঁসফাঁস করছে। একটা আইসক্রিমের জন্যে নিশ্চয় তারা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ওহ্, সেই জায়গায় পৌঁছে যেতে পারলে কতগুলো আইসক্রিম এক্ষুণি বিক্রি হয়ে যেত? ভাবতেই পারে না লোটন। একশোটা? দুশোটা? নাকি আরও বেশি?
দেরি করে লাভ কী? লোটন আইসক্রিমের বাক্সটা পিঠের দিকে ঝুলিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
সুখলাল যথারীতি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ওদিকে ফুচকাওলা রামশরণ মন দিয়ে আলুসেদ্ধর মধ্যে মশলা চটকিয়ে ফুচকার পুর বানিয়ে রাখছে। আলুকাবলিওলা বিধুদা আর স্কুলের দারোয়ান মথুরাকাকা ফিস ফিস করে নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে যেন কথা বলছে। ওরা কেউ খেয়ালই করল না লোটনের চলে যাওয়া। শুধু ফুটপাথের নেড়ি কুকুর তিনু ল্যাজ নাড়িয়ে দু’বার ভুক ভুক করে ডাক ছাড়ল। যেন লোটনকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আবার এই অসময়ে কোথায় চললে? লোটন রোজ তিনুকে লেড়ো বিস্কুট খাওয়ায়, গলা চুলকে দেয়। তাই ও লোটনের ভীষণ ভক্ত।
দুই
প্রথমটায় যেরকম গটমট করে রওনা হয়েছিল, কিছুদূর যাবার পরেই লোটনের সেই তেজী ভাবটা মিইয়ে গেল। হঠাৎই তার মনে পড়ে গেল, এই যাহ্, আমার তো ডানা নেই। পরিযান করব কেমন করে? তাছাড়া বইতে পড়েছি পাখিদের মাথার মধ্যে নাকি জন্ম থেকেই দূরদেশের মানচিত্র আঁকা থাকে। তাই তারা যেখানে পৌঁছবার ঠিকঠাক পৌঁছে যায়। কিন্তু আমি তো গরম দেশের হদিশ কিছুই জানি না!
ঠিক তখনই কোত্থেকে যেন একটা গরম হাওয়ার হলকা তার গায়ে এসে লাগল। এই গা শিরশির বর্ষার দিনে গ্রীষ্মকালের মতন বাতাস ছোটে কোত্থেকে? অবাক হয়ে ভাবল লোটন। অবশ্য একটু এদিক ওদিক চাইতেই সে বুঝতে পারল কোথায় সেই গরম হলকার উৎস।
লোটন যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকে একটু দূরেই মেট্রো রেলের কাজ চলছিল। মাটির নীচে মস্ত বড়ো বড়ো সুড়ঙ্গ বানানো হচ্ছে। সেরকমই একটা সুড়ঙ্গের মুখ থেকে গরম হাওয়ার ভাপ বেরিয়ে এসে ধাক্কা মারছে লোটনের গায়ে। এটাই তাহলে পথ? লোটন পায়ে পায়ে সুড়ঙ্গটার দিকে এগোল।
লোটন ভয় পাচ্ছিল, সুড়ঙ্গের মুখে নিশ্চয় পাহারাদার থাকবে। লোটনকে দেখলেই তারা লাঠি নিয়ে তেড়ে আসবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। জনহীন সুড়ঙ্গের মধ্যে বিনা বাধায় ঢুকে পড়ল লোটন।
সুড়ঙ্গটার চেহারা কিছুদূর অবধি যেমন থাকার ঠিক তেমনি ছিল। চারদিকে খড়খড়ে কংক্রিটের দেয়াল। দেয়ালের গায়ে জলের পাইপ, ইলেক্ট্রিকের তার, ন্যাড়া বাল্ব আরও কত কী ঝুলছে – যেকোনও মেট্রো রেলের টানেলে যেমন ঝোলে। কিন্তু সেই পথ ধরে লোটন যতই এগোতে লাগল, ততই সুড়ঙ্গের চেহারাটা বদলাতে লাগল। এখন আর সিমেন্ট নয়, বড়ো বড়ো চৌকোনা পাথরের চাঁই দিয়ে দেয়াল গাঁথা। সেই দেয়ালে নির্দিষ্ট দূরত্বে একটা করে মশাল জ্বলছে। মশাল জিনিসটা এখনও তাহলে ব্যবহার করা হয়! অবাক হল লোটন। সে তো ভাবত ওসব জিনিস কবেই হারিয়ে গেছে।
মশালের আলোয় লোটন দেখতে পেল দেয়াল থেকে কখন যেন জলের পাইপ, ইলেক্ট্রিকের তার, ন্যাড়া বাল্ব সমস্ত কিছু উধাও হয়ে গেছে। তার বদলে দেখা দিয়েছে আশ্চর্য এক জিনিস, ছবি। উজ্জ্বল লাল, নীল, হলুদরঙে আঁকা অজস্র ছবি। হয়তো দেবতাদেরই ছবি, কারণ তাদের পুজো করছে অনেক নরনারী। কিন্তু সেই দেবতাদের কারুর মুখ শেয়ালের মতন, কারুর মুখ বেড়ালের। বহু মানুষ সারি দিয়ে পুজোর থালা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেবতাদের দিকে। ছবির মানুষদের খালি গা, কাঁধ অবধি লুটিয়ে পড়া বাবরি চুল। কোমরে ধুতির মতন কাপড় জড়ানো। খুব চেনা চেনা লাগছিল লোটনের ওই ছবিগুলোকে। কোনও বইতে কি সে ওরকম ছবি দেখেছে? ঠিক মনে করতে পারছিল না লোটন।
হাঁটতে হাঁটতে একসময় সুড়ঙ্গের অন্য মুখটা দেখতে পেল লোটন। অন্ধকারের মধ্যে একটা আলোর বৃত্তের মতন জ্বল জ্বল করছে। ওই মুখটা দিয়েই গরম হাওয়ার হলকাটা আসছে।
একটা জিনিস বেশ বুঝতে পারল লোটন। সেটা হচ্ছে, পৃথিবীর গন্ধটা বদলে গেছে। জন্ম থেকে সে যে বাতাসে শ্বাস নিয়েছে তাতে গাড়ির ধোঁয়ার গন্ধ, কারখানার রাসায়নিকের গন্ধ, পোড়া প্লাস্টিকের নাক জ্বালানো গন্ধ মিশে থাকত। তাতেই লোটনের অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। তাই কোনওদিন আলাদা করে সেইসব গন্ধের কথা খেয়ালই করেনি। কিন্তু আজকে সুড়ঙ্গের ওই খোলা মুখ দিয়ে যে হাওয়া বয়ে আসছে, সে যেন এক অন্য পৃথিবীর হাওয়া। নির্মল, তাজা, শুধু নানানরকম লতাপাতা আর ফুলের গন্ধ মিশে আছে সেই বাতাসে।
আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই লোটন সুড়ঙ্গের খোলা মুখে পৌঁছে গেল এবং সেখানে দাঁড়িয়ে সে যা দেখল তাতে তো তার চক্ষু চড়কগাছ। লোটন দেখল, বাইরে চড়া রোদ্দুরে ঝমঝম করছে ঢেউ খেলানো ধু ধু বালিয়াড়ি। এখানে ওখানে বিরাট উঁচু উঁচু ফণীমনসার মতন কাঁটাগাছ। কয়েকটা উট লম্বা গলা বাড়িয়ে সেই কাঁটাগাছের পাতা চিবোচ্ছে।
সুড়ঙ্গ ছেড়ে বেরিয়ে এল লোটন। রোদের তেজে প্রথমটায় তার চোখে ধাঁধা লেগে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ বাদে চোখটা সয়ে এলে সে আরও দুটো আশ্চর্য জিনিস দেখতে পেল।
এক, দূরে বালিয়াড়ির মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বিরাট এক নদী। এতদূর থেকেও সেই নদীর বুকে ভেসে যাওয়া নৌকার পাল দেখা যাচ্ছে।
আর দুই, লোটন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে মাইলখানেক পশ্চিমে একটা আকাশছোঁয়া ইমারত তৈরি হচ্ছে। সেই ইমারতের আকৃতিটা অদ্ভুত। চওড়া থেকে ক্রমশ সরু হয়ে একটা দানবিক পেন্সিলের শিসের মতন সেটা দাঁড়িয়ে আছে। লোটনের হতভম্ব মুখ থেকে আপনা থেকেই দুটো শব্দ বেরিয়ে এল, নীলনদ! পিরামিড!
মুহূর্তের মধ্যে তার মাথার মধ্যে সুড়ঙ্গের ছবিগুলোর মানেও পরিষ্কার হয়ে গেল। সে তাহলে এতক্ষণ কোনও প্রাচীন মিশরীয় মন্দিরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসছিল! কিন্তু কলকাতার মেট্রো রেলের টানেলে যে সুড়ঙ্গের একটা মুখ, সেই সুড়ঙ্গেরই অন্য মুখটা কেমন করে যে নীলনদের ধারে গিয়ে মিশল সে কথা কিছুতেই মাথায় ঢুকছিল না। হয়তো সে মনেপ্রাণে দেশান্তরী হতে চেয়েছিল বলেই এমনটা ঘটল। ঠাকুরদেবতা তো আর মিথ্যে নয়। তাদের দয়ায় অনেক কিছুই হয়।
লোটন বুঝতে পারল, সে পরিযায়ী হতে চেয়েছিল, তাই হয়েছে। তবে সে শুধু দূরত্বই অতিক্রম করেনি। কেমন করে যেন সময়কেও অতিক্রম করে বহু হাজার বছর পেছনে চলে এসেছে লোটন।
কিন্তু এবার সে কী করবে? সুড়ঙ্গপথ ধরে আবার পেছনে ফিরে যাবে?
নাহ্। সেখানে তো সেই আবার গঙ্গাধর হাই স্কুলের বন্ধ গেটের সামনে গালে হাত দিয়ে বসে থাকার দিন। তার চেয়ে এখানকার অবস্থাটাই একবার দেখা যাক না। এই ভেবে লোটন পায়ে পায়ে সেই নির্মীয়মান পিরামিডটার দিকে এগিয়ে গেল।
তিন
পিরামিডের কাছাকাছি পৌঁছিয়ে লোটন দেখল, সেখানে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। বোঝাই যাচ্ছে ওরা সবাই শ্রমিক। পিরামিড তৈরির কাজে ঘাম ঝরাচ্ছে। না, সবাই অবশ্য শ্রমিক নয়। কয়েকজন দামি পোশাক পরা লোক হাতে চাবুক নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে আর কোনও শ্রমিকের কাজে সামান্য শৈথিল্য দেখতে পেলেই তাদের পিঠে সেই চাবুক দিয়ে সজোরে আঘাত করছে। ওরা নিশ্চয় একটু উঁচু পদের কর্মচারী। আর শ্রমিকরা আসলে ক্রীতদাস।
লোটন চারদিকে তাকিয়ে দেখল, ক্রীতদাসের দল নীলনদের বুকে ভেসে আসা ভেলা থেকে বিরাট বিরাট চৌকোনা পাথরের চাঁই দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। পিরামিডের সামনে ঢালু পথ তৈরি করা হয়েছে। সেই পথ দিয়ে ওই ভারী পাথরগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে তুলছে আরও কয়েকশো লোক। আরও বহু ক্রীতদাস মিলে সেই পাথরগুলোকে ছেনির আঘাতে মাপমতন কেটে একটার সঙ্গে আরেকটাকে গেঁথে পিরামিডের উচ্চতাকে বাড়িয়ে তুলছে। পরিশ্রমে তাদের সবারই গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ছে। কিন্তু কারুরই থামবার উপায় নেই। থামলেই পিঠের ওপর আছড়ে পড়ছে দলপতির চাবুক। এইসব দেখতে দেখতেই কোথায় যেন খুব জোরে ভেরী বেজে উঠল। শ্রমিকদের মধ্যে একটা আনন্দের সাড়া পড়ে গেল। ছুটি… ছুটি… ছুটি!
গত দু’বছর ধরে ‘ছুটি’ এই শব্দটা লোটনকে আপনা থেকেই চনমনে করে তোলে। ছুটির সময় মানেই আইসক্রিম বিক্রির সময়। লোটন কাঠের বাক্স গলায় ঝুলিয়ে পায়ে পায়ে সেই পথটার দিকে এগিয়ে গেল, যে পথ ধরে পিল পিল করে স্রোতের মতন মিশরীয় শ্রমিকেরা বেরিয়ে আসছে। তাদের প্রত্যেকেরই আদুল গা, ন্যাড়া মাথা, ঘন কালো ভুরু আর লম্বা চোখের পাতা। পিরামিডের পাঁচিল পেরিয়ে বাইরে এসে প্রথমেই তারা দৌড়ে গেল যেখানে বিশাল বিশাল তামার জালা থেকে লম্বা হাতায় করে পানীয় জল বিতরণ করা হচ্ছে, সেইখানে। আঁজলা পেতে একে একে তারা জল খেল; শুকিয়ে যাওয়া গলাগুলো ভিজিয়ে নিল। কিন্তু তাদের মুখ দেখেই লোটন বুঝতে পারছিল, তাদের মন ভরেনি। কারণটাও লোটন বুঝতে পারছিল। তামার পাত্রে রাখা পানীয় জল অনেকক্ষণ রোদ্দুরে পড়ে থাকার ফলে বেশ গরম হয়ে গেছে। ও জল খেয়ে শরীর জুড়োয় না।
লোটন তার বাক্স থেকে একে একে লাল, কমলা, হলদে, সবুজ, চার রঙের চারটে কাঠি-আইসক্রিম বার করে আঙুলের ফাঁকে সেগুলোকে ধরে মাথার ওপর তুলে ধরল। বর্ণহীন মরুভূমির মাঝখানে সেই উজ্জ্বল রঙের রেখা চারটে সঙ্গে সঙ্গেই অনেকের নজর কেড়ে নিল। পায়ে পায়ে বেশ কয়েকজন শ্রমিক লোটনের দিকে এগিয়ে এল। সবচেয়ে সামনে যে চারজন ছিল, লোটন তাদের হাতে চারটে আইসক্রিম তুলে দিল।
লোকগুলো অবাক হয়ে আইসক্রিমগুলোকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। লোটন পরিষ্কার বুঝতে পারছিল, বরফ জিনিসটাই তারা আগে কখনও দ্যাখেনি, আইসক্রিম তো অনেক পরের কথা। প্রথমে তারা আইসক্রিমগুলোকে চোখের সামনে তুলে ধরল। বরফের মধ্যে থেকে ধোঁয়ার মতন বাষ্প বেরিয়ে আসছিল। তাই দেখে প্রথমে তারা ভাবল, এগুলো বুঝি খুব গরম। তাই হাতটা চট করে শরীর থেকে দূরে সরিয়ে নিল। কিন্তু যখন দেখল একই সঙ্গে জিনিসগুলো থেকে জলের ফোঁটাও গড়িয়ে পড়ছে, তখন ভয়ের বদলে তাদের মুখে ফুটে উঠল অবাক ভাব। আর তারপর লোটনের ইশারা মেনে যখন তারা আইসক্রিমের বরফগুলোকে ছুঁয়ে দেখল, তখন তাদের আনন্দ আর ধরে না। পাগলের মতন একবার কপালে ছোঁয়ায়, একবার গালে ছোঁয়ায়। তাদের সঙ্গী-সাথীরাও ততক্ষণে তাদের হাত থেকে আইসক্রিমগুলোকে নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে।
লোটন ইশারায় তাদের থামতে বলে আরও কয়েকটা আইসক্রিম বার করে তাদের হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর নিজে একটা আইসক্রিম হাতে নিয়ে আরাম করে সেটা চুষতে লাগল। লোটনের কান্ড দেখে এতক্ষণে মিশরীয় লোকগুলো বুঝতে পারল, ও বাবা! এগুলো তাহলে খাবার জিনিস? তারাও লাল, সবুজ বরফের টুকরো মুখে পুরে চুষতে লাগল। আরামে তাদের চোখ বুজে এল, ঠিক যেমন ক্যাকটাসের পাতা চিবোবার সময় উটের চোখ বুজে আসে।
আরও একশোটা হাত এগিয়ে এল লোটনের দিকে। ভাষা না বুঝলেও তারা কী বলছে বুঝতে একটুও আসুবিধে হল না লোটনের। আমাকে দাও, আমাকে দাও, আমাকে দাও।
কিন্তু এমনি এমনি কেন আইসক্রিম বিলোবে লোটন? সে তো ওগুলো বিক্রি করবার জন্যেই এসেছে, নাকি? লোটন হাতের আঙুলগুলোকে গোল করে ধরে ইশারায় পয়সা দ্যাখাল। কিন্তু তখনই গোল বাঁধল। লোকগুলোর হাবভাব দেখে লোটন পরিষ্কার বুঝতে পারল, টাকাপয়সা জিনিসটা যে কী, তা ওরা জানে না। লোটন কিছুদিন আগেই সুখলালের ঝুড়ি থেকে মিশরের ওপর একটা চমৎকার বই পেয়েছিল। ওর মনে পড়ে গেল, সেই বইতে লেখা ছিল প্রাচীন মিশরে টাকাপয়সার প্রচলন ছিল না। সেই যুগে ওরা একটা জিনিসের বদলে অন্য আরেকটা জিনিস কিনত। এই যেমন, চারটে ছাগলের বদলে একটা গাধা।
তবে লোটন যে ওই চমৎকার খাদ্যগুলোর বদলে কিছু চাইছে, এটা কিছুক্ষণের মধ্যেই মিশরীয়রা বুঝতে পারল। আর তারা সকলেই সৎ এবং পরিশ্রমী লোক। একটা বাচ্চাকে ঠকাবেই বা কেন? তাই দেখতে না দেখতে নানারকমের জিনিস হাতের মুঠোয় পুরে তারা লোটনের দিকে এগিয়ে ধরল। কেউ দিল একমুঠো খেজুর, কেউ একটা রঙিন পাথরের মালা, কেউ বা আবার শুধুই ক’টা মরুভূমির বুকে ফুটে থাকা কেয়াফুল।
লোটনের প্রথমে খুব রাগ হল। এইজন্যেই কি সে পরিযায়ী হতে চেয়েছিল? সারাদিন আইসক্রিম বিক্রি করার পরে সে বাড়ি ফিরে যদি মায়ের হাতে এইসব পাথর আর ফুল তুলে দেয়, তাহলে মা কী করবে? কিন্তু পরক্ষণেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রীতদাসদের সরল মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে লোটনের বুকটা মায়ায় ভরে গেল। আহা, ওরাই বা কী করবে? ওদের কাছে যা আছে তাই তো ওরা দেবে। তার বেশি পাবে কোথায়? লোটন মুখে হাসি ফুটিয়ে যে যা দিচ্ছে তাই নিয়ে নিল। তার বদলে ওদের হাতে একটা একটা করে আইসক্রিম ধরিয়ে দিতে লাগল। শুধু একজন একটা সবুজ রঙের জ্যান্ত সাপ দিতে চাইছিল। সেটা লোটন নিতে রাজি হল না। সেই লোকটাকে সে এমনি এমনিই একটা আইসক্রিম দিয়ে দিল।
একটা ব্যাপার দেখে লোটন খুব অবাক হল। ইতিমধ্যেই সে বোধহয় দুশো লোককে আইসক্রিম দিয়ে দিয়েছে। তবু তার বাক্সে এখনও অনেক আইসক্রিম। ব্যাপারটা কী যে হচ্ছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছিল না। আজকে কি ভুল করে কারখানা থেকে তার বাক্সে অনেক বেশি আইসক্রিম দিয়ে ফেলেছিল?
চার
একটু পরেই মরুভূমির আকাশকে লাল রঙে রাঙিয়ে সূর্যাস্ত হল। এরকম বিশাল আর রঙিন সূর্যাস্ত আগে কখনও দ্যাখেনি লোটন। আইসক্রিম খাওয়া শেষ করে, ক্রীতদাসেরা সারি বেঁধে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে দূরে নীলনদের দিকে ফিরে গেল। ওদিকেই নিশ্চয় ওদের থাকার আস্তানা। পেছন পেছন ঘোড়া আর উটের পিঠে চড়ে দলপতি আর রাজপুরুষেরাও চলে গেল, হয়তো কোনও বড়ো শহরের উদ্দেশ্যে। হঠাৎই লোক গমগম জায়গাটা ভীষণ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। লোটন যে সেখানে একা দাঁড়িয়ে রইল, সে কথা কেউ খেয়ালই করল না। করবেই বা কেন? পিরামিডের নির্মাণস্থলে সারাদিন লোটনের মতন কত ফেরিওলা, কত বাজিকর, কত গায়ক, নর্তকী ভিড় করে। তারা হরেক মাল বিক্রি করে। নিজেদের কলাকৌশল দেখিয়ে সবার কাছ থেকে মজুরি আদায় করে। লোটনকেও সবাই সেরকমই একজন স্থানীয় ফেরিওলা ভেবেছে নিশ্চয়। তারা আর কেমন করে জানবে, যে লোটন কয়েক হাজার মাইল দূরের এবং কয়েক হাজার বছর পরের এক শহর থেকে হঠাৎই এখানে এসে পড়েছে। কেমন করে বুঝবে যে, তার এখানে কিচ্ছু চেনা নেই, থাকার কোনও জায়গা নেই তার।
লোটন কী করবে কিছু বুঝতে না পেরে নির্মীয়মান পিরামিডের দিকেই পা বাড়াল। তার মনে ক্ষীণ আশা ছিল, হয়তো ওখানে কোনও সরাইখানা দেখতে পাবে, যেখানে সে আজ রাতটার মতন আশ্রয় নিতে পারবে। কাল সকালে না হয় একবার দূরের ওই শহরে পৌঁছনোর চেষ্টা করা যাবে।
গভীর বালির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে গিয়ে লোটন কেবলই হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। তাছাড়া আশ্রয়ের খোঁজে গোটা পিরামিডটাকে বেড় দিয়ে আসতেও কম সময় লাগল না। এইভাবে অনেকটা সময় বৃথা নষ্ট হল। রাত নামল। মরুভূমির আকাশে অজস্র তারা ফুটে উঠল। সেরকম উজ্জ্বল তারাও আগে কখনও দ্যাখেনি লোটন। সারাদিন যেমন গরম ছিল, রাত্রি নামার সঙ্গে সঙ্গে সেরকম কনকনে ঠান্ডা হয়ে উঠল আবহাওয়া। নীলনদের দিক থেকে হু হু করে হাওয়া বইতে থাকল আর সেই হাওয়ায় ভেসে এল নাম না জানা কোনও এক পশুর গর্জন। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে লোটন দৌড় লাগাল সেই সুড়ঙ্গটার দিকে, যেটার মধ্যে দিয়ে সে এখানে এসে পৌঁছেছিল।
কিন্তু সুড়ঙ্গে ঢোকার মুখেই অন্ধকারে ঢাকা দেয়ালের গা থেকে যেন জমাট অন্ধকারের একটা স্তূপ হঠাৎ আলগা হয়ে বেরিয়ে এসে লোটনের হাত চেপে ধরল। লোটনের গলা দিয়ে ভয়ার্ত চীৎকার বেরিয়ে এল।
“ভয় নেই, ভয় নেই।” ছায়া মূর্তি ফিসফিস করে বলে উঠল।
গলা শুনেই লোটন বুঝতে পারল, সে আসলে এক কম বয়সী মেয়ে এবং কোনও কারণে সে যেন লোটনের চেয়েও বেশি ভয় পেয়ে রয়েছে। লোটন গলা নামিয়ে প্রশ্ন করল, “আপনি কে? আমার ভাষা জানলেন কেমন করে?”
করুণ হেসে মেয়েটি বলল, “তুমি আমাকে মালতিদিদি বলে ডাকতে পার। আজ থেকে বারো বছর আগে দাস-ব্যবসায়ীরা তোমার দেশ, মানে বাংলাদেশ থেকেই আমাকে এই মিশরে ধরে নিয়ে এসেছিল। মাতৃভাষা কি কেউ ভোলে? আমিও ভুলিনি। আর শোন, আমাকে আপনি বলতে হবে না। তুমিই বোলো।”
বারো বছর আগে বাংলাদেশে দাস-ব্যবসায়ের কথা শুনে লোটন প্রথমটায় ভিরমি খাচ্ছিল। তারপর তার মনে পড়ল, মহিলা বলছেন আসলে একহাজার বারো বছর আগের কথা। সে মালতিদিদিকে বলল, “তুমি এত রাতে এই নির্জন মরুভূমির মধ্যে এসেছ কেন?”
“বলছি। তার আগে চল, আমরা ওই সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকে বসি। জাদুকর সামাদিনের পোষা কালপ্যাঁচারা সারারাত গীজার আকাশে চক্কর মেরে বেড়ায়। অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই তারা সামাদিনকে গিয়ে খবর দেবে।”
লোটন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করল, “সামাদিন কে?”
কিন্তু মালতিদিদি সেই সুড়ঙ্গের ভেতরে একটা লুকোনো কোণায় পৌঁছনোর আগে আর কোনও কথাই বলল না। সেখানে পৌঁছে মালতিদিদি নিজে একটা পাথরের বেদির ওপর বসল। তারপর লোটনের হাত ধরে তাকেও মুখোমুখি একটা পাথরের বেদির ওপরে বসাল। তারপর বলল, “সবকথাই খুলে বলছি, শোন। বারো বছর আগে আমাকে দাস-ব্যবসায়ীরা যখন জাহাজে চাপিয়ে এখানে নিয়ে এল, তখন তো আমি ভয়ে আর দুঃখে আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কপাল ভালো, আমাকে দাস-ব্যবসায়ীদের থেকে কিনে নিলেন স্বয়ং মিশরের রানি লিয়ানা। তখন আমার বয়েস মাত্র পাঁচ। রানির একমাত্র ছেলে মানে রাজকুমারের বয়সও ছিল আমারই মতন। হয়তো দু’এক বছরের ছোটো। রানি আমাকে তার খেলার সঙ্গী করে দিলেন।
“রাজকুমারের নাম আফরিন। আমি তাকে ফড়িং বলে ডাকি। এরা তো আর ফড়িং কথাটার মানে জানে না। জানলে হয়তো গর্দান নিত।
“যাই হোক, আমি আর ফড়িং তো একসঙ্গেই বড়ো হলাম। সারাক্ষণ রানি লিয়ানার কাছে কাছেই থাকতাম, তাই রানিমাও আমাকে খুব ভালোবেসে ফেললেন। রাজা, যাকে এরা ‘ফ্যারাও’ বলে ডাকে, তিনিও আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আর আফরিন তো আমাকে দিদি দিদি করে অস্থির। রাজা, রানি আর আফরিনের আদরে আমার ঘর ছেড়ে আসার দুঃখ আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে এল। আমার নিজেকে দাসী মনে হত না। মনে হত আমিও ফ্যারাওয়ের পরিবারেরই একজন। এমনিতেই দেশে আমার নিজের মা, বাবা, ভাই, বোন কেউ ছিল না। থাকবার মধ্যে ছিল এক খুব রাগি কাকা। কাজেই গত বারোটা বছর খুব সুখেই কাটিয়ে দিলাম।
“শুধু সমস্ত সুখের মধ্যে কাঁটা হয়ে বিঁধে ছিল জাদুকর সামাদিন। লোকটা মিশরের রাজসভার প্রধান পুরোহিত। জান তো, এখানে রাজার যত ক্ষমতা, পুরোহিতের ক্ষমতাও তার চেয়ে খুব একটা কম নয়। কারণ, এখানকার মানুষজন মনে করে দু’জনকেই দেবতারা নির্বাচিত করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, তাদের শাসন করার জন্যে। সামাদিন লোকটার কিন্তু অত ক্ষমতা পেয়েও শান্তি ছিল না। সে মনে মনে চাইত ফ্যারাও হতে।
“সেই সুযোগ এল মাত্র একসপ্তাহ আগে, যখন ফ্যারাও এক যুদ্ধে মারা গেলেন। ওই যে দেখছ জোরকদমে পিরামিড শেষ করার তোড়জোড় চলছে, সে ওই আগের ফ্যারাওকে সমাধিস্থ করার জন্যেই। অবশ্য আমি খবর পেয়েছি ফ্যারাওকে তার শত্রুরা হত্যা করেনি, করেছে সামাদিনের গুপ্তঘাতকেরাই।
“কিন্তু আগের ফ্যারাও মারা গেলেই তো আর সামাদিন নতুন ফ্যারাও হতে পারবে না। রানিমা আছেন। এখানে মেয়েরাও রাজ্যশাসন করতে পারে। রানি হাটসেপসুট তো একজন ফ্যারাও ছিলেন।
“কিন্তু অবাক কান্ড, রাজার মৃত্যুর ঠিক দু’দিন পরে রানিও মারা গেলেন! মারা গেলেন এক অদ্ভুত অসুখে। সেরকম অসুখ কেউ দ্যাখেনি। কী জ্বর, কী জ্বর! গায়ে হাত দিয়ে দেখতাম, রানিমার দেহ থেকে যেন আগুন ছুটছে। হাজার ওষুধেও কোনও কাজ হল না।
“ঠিক আছে, রাজা মারা গেলেন। রানিমাও মারা গেলেন। কিন্তু রাজপুত্র আফরিন তো রয়েছে। নিয়মমতন এবার তারই ফ্যারাও হবার কথা। কিন্তু…” মালতিদিদি দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
“কী হল?” জিজ্ঞেস করল লোটন।
“পরশু থেকে সেই একই জ্বর ফড়িংকেও ধরেছে।” কান্না থামিয়ে বলল মালতিদিদি। “আমি নিশ্চিত এ কোনও অসুখ নয়। ওই জাদুকর সামাদিন কোনওভাবে রানিমা আর রাজকুমার দু’জনের শরীরেই বিষ ঢুকিয়েছে। ফড়িং আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছে। কত ওষুধ খাওয়াচ্ছি, মাথায় কত জলপটি দিচ্ছি। ওর জ্বর আর নামছে না।
“আজ থেকে ঠিক সাতদিন পরে আগের ফ্যারাও আর রানিমাকে একসঙ্গে পিরামিডের ভেতর সমাধি দেওয়া হবে। হয়তো ফড়িংকেও তার বাবা-মার পাশে সমাধি দিতে হবে। তারপর সামাদিনের ফ্যারাও হবার পথ আর কেউ আটকাতে পারবে না।” আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল মালতিদিদি।
না দেখা সেই রাজপুত্রের দুঃখে লোটনের বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। সে মালতিদিদির হাতের ওপর হাত রেখে বলল, “আমার কাছে কেন এসেছ বললে না তো?”
“আমাদের প্রাসাদের এক বৃদ্ধ ক্রীতদাস আজ এখানে কাজ করতে এসেছিলেন। তিনি খুব জ্ঞানী আর আমাকে খুব ভালোবাসেন। তিনিই আমাকে বললেন, কিলিমাঞ্জারো পর্বতের চূড়া যে হিমঠান্ডা আস্তরণে সারাবছর ঢাকা থাকে, আজ দেখলাম একটা বাচ্চা ছেলে সেই জিনিস নিয়েই পিরামিডের কাছে ফেরি করছে। একবার গিয়ে দ্যাখো না, যদি ওই স্বর্গীয় হিম একটু যোগাড় করতে পার তাহলে হয়তো রাজকুমারের জ্বর নামানো যেতে পারে।”
মালতিদিদি নিজের গলা থেকে লাল পাথরের একটা মালা খুলে লোটনের হাতে দিয়ে বলল, “দেবে ভাই? তোমার ওই আশ্চর্য শীতল জিনিসের একটুখানি আমাকে দেবে? ফড়িংকে যদি বাঁচাতে পারি।”
লোটন তাড়াতাড়ি মালাটা মালতিদিদির হাতে ফেরত দিয়ে বলল, “দাম লাগবে না। আমি এমনিই তোমাকে আমার এই আইসক্রিমের বাক্সটা দিয়ে দিচ্ছি। আমাদের জ্বর হলে মা আমাদের কপালেও বরফ ঘষে। তুমিও তাই কোরো। দেখবে রাজকুমারের গা একেবারে ঠান্ডা হয়ে যাবে। রাজকুমারও নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবেন।”
“ভালো থাকো ভাই। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।”
লোটনের কপালে একটা চুম খেয়ে উঠে দাঁড়াল মালতিদিদি। তারপর আর দেরি না করে আইসক্রিমের বাক্সটা নিয়ে সুড়ঙ্গের বাইরে পা বাড়াল।
কিন্তু ঠিক সেই সময়েই বাইরে একটা বিরাট হইচইয়ের আওয়াজে চমকে উঠল লোটন। তাহলে কি মালতিদিদি জাদুকর সামাদিনের লোকজনের হাতে ধরা পড়ে গেল? সে কি রাজকুমার আফরিনকে আর বাঁচাতে পারবে না? লোটন চীৎকার করে উঠল, “মালতিদিদি! মালতিদিদি! কী হল তোমার, মালতিদিদি?”
হইচইটা বাড়তে বাড়তে একসময়ে লোটনের একদম কাছে পৌঁছিয়ে গেল। সে চোখ খুলে দেখল গঙ্গাধর হাই স্কুলের ছুটির ঘন্টা বেজে গেছে। ছেলেরা হইহই করতে গেট থেকে বেরিয়ে আসছে। আইসক্রিমের বাক্সটা বুকে ঝুলিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল লোটন।
আশ্চর্য স্বপ্নের রেশটা তখনও লোটনের মাথার মধ্যে পাক খাচ্ছিল। তাই সে ভাবল, উঁচু ক্লাসের কোনও ছেলেকে জিগ্যেস করবে, আচ্ছা দাদা, বলতে পার, মিশরের ইতিহাসে আফরিন বলে কেউ কোনওদিন ফ্যারাও হয়েছিলেন কি না?
যদি দাদা বলে হ্যাঁ, তাহলে সে বুঝবে মালতিদিদির চেষ্টা সার্থক হয়েছিল।