তখন অন্ধকার ধীরে ধীরে পুব আকাশে আস্তানা গাড়ছিল। পশ্চিম আকাশে সূর্যদেব টুপ করে খসে পড়বার অপেক্ষায়। আকাশের রক্তিম আলোয় উড়ছিল বিহানের ঘুড়ি। বিহানের ঘুড়ির রঙ সবুজ আর লালে মেশানো, তাতে আবার দুটো চোখ আঁকা। ঘুড়িটা আকারে বেশ বড়ো আর অদ্ভুত দেখতে। চোখদুটোর দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারছিল না বিহান। মনে হচ্ছিল যেন বিহানের বুকের ভেতর জমে থাকা সবকথাই ঘুড়িটা পড়ে ফেলছে। বাবা দশটা ঘুড়ি কিনে দিলেও এই ঘুড়িটা ছিল সবদিক থেকে আলাদা। তাই ন’টা ঘুড়ি একে একে ভো-কাট্টা হয়ে যাওয়ার পর বিহান ওকে আকাশে ওড়ায়। হাতের লাটাইটার থেকে সুতো ছাড়তে ঘুড়িটা যেন অস্তগামী সূর্যের দিকে ধেয়ে গেল। লাল হয়ে সূর্য ঢলে পড়ছে। ঘুড়িটা যেন তার পেছন পেছন ধাওয়া করে চলেছে।
এমন সময় পশ্চিমদিক থেকে ঝড়ো হাওয়া উঠল। বিহানের হাতের লাটাই বনবন করে ঘুরে সুতো ছাড়তে লাগল। এত জোরে ঘুড়িটা আকাশে উড়তে উড়তে দূরে চলে যাচ্ছে, যে লাটাইটা ধরে রাখা দায়। সুতো শেষ হয়ে গেলে ঘুড়িটা লাটাই সমেত বিহানকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। প্রথমে বিহানের পাদুটো ছাতের উপর থেকে শূন্যে উঠে যেতেই বিহানের বুক কেঁপে উঠল। ছাতের রেলিং ছাড়িয়ে পটলাদের তিনতলা বাড়ির চিলেকোঠার মাথার উপর দিয়ে লাটাই সমেত বিহানকে উড়িয়ে নিয়ে গেল ঘুড়িটা।
নিচে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আকাশে তখনও আলো। ছাড়িয়ে গেল ফুটবল খেলার মাঠ, বিহানদের স্কুল অনন্ত শিক্ষায়তন, মনসাতলা, রেল ব্রিজ, বিপিনবাবুর বাজার। নিচে তাকিয়ে দেখতে দেখতে বিহানের পড়ে যাবার ভয় হতে ও লাটাইটা শক্ত করে চেপে ধরল। লাটাইটাও যেন ওর হাতদুটোকে চেপে ধরে আছে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল, মাধ্যাকর্ষণের জন্য মাটির দিকে শরীরে কোনও টান অনুভব করছে না বিহান। বরং সারা শরীর হালকা লাগছে।
বিহান দেখল, রেললাইন দেখা যাচ্ছে অনেকদূর পর্যন্ত। সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলেছে রেললাইন। প্লাস্টিকের বাক্সের মতো পড়ে আছে রেলস্টেশন। বিপিনবাবুর বাজারে সন্ধেবেলায় পিঁপড়ের মতো মানুষ, ঠ্যালা রিক্সা, উপচে পড়া দোকান। রুপোলি ফিতের মতো নিচে বয়ে চলেছে গঙ্গা। চোখে পড়ল গঙ্গার পারে লঞ্চ ঘাট। থেমে থাকা লঞ্চ। গঙ্গার বুকে বেয়ে চলা নৌকো, ভেতরে টিমটিম করছে লন্ঠনের আলো।
দুপ করে যেন আলো নিভে গেল পৃথিবীর বুকে। নিচে চাপ চাপ অন্ধকার। আকাশ তখনও হালকা নীল আলোর পোশাক পরে। বাতাস ক্রমশ ঠাণ্ডা হচ্ছে। বিহানের শরীর ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কেউ যেন কানের পাশে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, “কী, শীত করছে নাকি?”
চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখে ঘুড়ি থেকে বেরিয়ে ঘুড়ির বুড়ো তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। বুড়োর চোখদুটোর গভীর দৃষ্টিতে বিহানের বুক ছ্যাঁত করে ওঠে। ওর জিভ আটকে যায়। কথা অস্ফুট থেকে যায়। সে দৃষ্টিতে গভীর মায়া, ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার ছোঁয়া বিহানের বুকের ভেতর অনেক বেহালার ছড়ের টানে অপরূপ সঙ্গীত ভেসে আসে। বিহানের শরীরের নিচে নরম গদির স্পর্শ। বিহান অবাক হয়ে দেখল, সে একটা নীল রঙের সুন্দর গদি মোড়া ভেলায় বসে ভেসে চলেছে।
ঘুড়িবুড়ো চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ভালো লাগছে? এবার দেখবে তোমার আর শীত করবে না। ঘুম এসে যাবে। তোমার খিদে পায়নি?”
বিহান এবার সাহস পেয়ে বলে, “তুমি কে? কোথায় নিয়ে চলেছ আমাকে?”
ঘুড়িবুড়ো হেসে ফেলে। তাঁর সোনা দিয়ে বাঁধানো দাঁত ঝিলিক দিয়ে ওঠে। বলে, “আমি চায়না বাজারের ঘুড়িওয়ালা। ওই যে ঘুড়িটা তুমি উড়াচ্ছিলে, আমি সেই ঘুড়ির ভেতর বসেছিলাম। অনেক অনেক বছর আগে আমি চায়না বাজারে ৩৩ নম্বর দোকানের মালিক ছিলাম। আমি বুড়ো হয়ে যেতে ছেলেরা দোকান বেচে দিল। দোকান ছেড়ে যেতে পারিনি। তাই আজ এ-ঘুড়ি কাল ও-ঘুড়িতে চেপে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়াই।”
বিহানের মুখ দিয়ে আপনা আপনিই বেরিয়ে আসে, “তুমি ভূত? ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ?”
“না, ভূত কেন হতে যাব? আমি বর্তমান। এই তো আমি তোমার সাথে দিব্বি কথা বলছি। এক সাথে চলেছি বেড়াতে। ভূতেরা কি বেড়াতে যায় নাকি? আমি তোমাদের সাথে বেঁচে আছি।”
“তাহলে তুমি যে বললে, যখন বেঁচে ছিলাম…”
“এখনও বেঁচে আছি। তখন মানুষ হয়ে বেঁচে ছিলাম। এখন ঘুড়ি হয়ে। আচ্ছা, কী খাবে বললে না তো!”
বিহানের খিদে পায়। যেই না তার সাধ হয়েছে লুচি-মাংস খাওয়ার, অমনি সে দেখে তার সামনে সুন্দর থালায় খান দশেক ফুলকো লুচি আর একবাটি সুগন্ধি মশলাযুক্ত পাঁঠার মাংস। থালার এককোণে চারটে ইয়া বড়ো বড়ো রাজভোগ। খেতে খেতে একবারের জন্য মায়ের কথা মনে পড়ল ঠিকই, কিন্তু খাবার সাথে সাথে চোখ জুড়ে নেবে এল ঘুম। বিহান নরম বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়তেই আকাশ দেখতে পেল। নির্মল আকাশে চাঁদের আকার অনেক বড়ো মনে হচ্ছে। চাঁদ যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বিহান কোনওদিন এত উজ্জ্বল চাঁদ দেখেনি। পৃথিবীর বায়ুস্তরে যত রাজ্যের ধুলোময়লার জন্য চাঁদ মলিন দেখায়। আকাশের তারারা আরও আকারে বড়ো বলে মনে হচ্ছে, আরও ঝকঝকে। সপ্তর্ষিমণ্ডল পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। লুব্ধক তারাটাকে সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে শিকারি কুকুর। চোখের পাতায় ঘুমের আবেশ জড়িয়ে আসতে বিহান দেখল ঘুড়িওয়ালা বুড়ো আবার ঘুড়ির মধ্যে সেঁধিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
ভেলার উপর বিহানের ঘুম ভাঙল প্রভাতী সূর্যের আলোয়। পুব আকাশ রাঙা হয়ে উঠছে। হালকা বেগুনি আর নীল রঙে মেশা আকাশটা যেন বিশাল ফুটবল খেলার মাঠ। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ বিহানের ভেলার নিচে ভেসে যাচ্ছে। ঘুড়িবুড়ো হাসিমুখে ঘুড়ি থেকে নেবে এসে ভেলার পাশে এসে দাঁড়াল।
“এবার আমরা এসে গেছি। নিচে তাকিয়ে দেখ।”
ঘুড়িটা গোঁত্তা খেয়ে নিচে নেবে যেতে লাগল। ঘুড়ির টানে ভেলাও ভেসে চলেছে নিচে। নাবার তীব্র গতির জন্য বিহানের তলপেটে কেমন কেমন করতে লাগল। কোথায় যেন শুনেছিল প্লেন নিচে নাবার সময় এমনটাই হয়ে থাকে। বিহান কোনওদিন প্লেনে চড়েনি। অবশ্য অভিজ্ঞতা একেবারে যে নেই তা নয়। চড়কতলার মাঠে একবার কালীপুজোর সময় বিরাট আকারের জায়েন্ট হুইল চড়ার কথা বেশ মনে আছে। সেই জায়েন্ট হুইল যখন পাক খেয়ে নিচে নেবে আসছিল, পাশে বসে থাকা বাবার হাতটা চেপে ধরেছিল ছোট্ট বিহান। পেটের নিচের দিকে এমনই অনুভূতি হয়েছিল সেদিন।
বিহানের চারদিকে ভিড় করে এল বরফে ঢাকা সাদা পাহাড়। এত সাদা, তার থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। দার্জিলিংয়ে বেড়াতে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছে বিহান। কিন্তু সে অনেক দূর থেকে। এখন পাহাড়ের গা ছুঁয়ে যাওয়া। হাত বাড়ালেই পাহাড়ের থেকে খানিকটা বরফ তুলে মুখে দিতে ইচ্ছা করল। কিন্তু ভেলার গতি বড়ো বেশি। সে-ঝুঁকি নিতে সাহস হল না। নির্জন গভীর গিরিখাত দেখে গা ছমছম করে উঠল। কোথাও বরফ ফাটিয়ে নীল ঝর্ণা উদ্দাম গতিতে শরীর ভাসিয়ে দিয়েছে। অনেক নিচে আছড়ে পড়ে ঝর্ণার জলের কুচি ধোঁয়ার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
এখানে বড়ো শীত। কিন্তু নাকের ডগা ছাড়া আর কোথাও শীত অনুভব হল না। কারণ, মাঝরাতেই ঘুড়িবুড়োর দৌলতে বিহানের গায়ে পুরু চামড়ার পোশাক উঠে এসেছে কখন কে জানে! মেঘের স্তর ভেদ করে ভেলা আরও নিচে নাবে। এখানে মেঘের রং ধুসর। বিহান জানে, এ-জাতীয় মেঘে জল ভরা থাকে, বৃষ্টি হয়। আর একটু নিচে নাবতে না নাবতেই সব পরিষ্কার। প্রকৃতির এই রূপে বিভোর হয়ে কখন যে ওরা মাটির কাছাকাছি নেবে এসেছে, বিহান লক্ষই করেনি।
সাঁ করে নিচে নাবতে গিয়ে দু’পাক খেল ঘুড়ি। সাথে বিহানকে নিয়ে ভেলাও। বিহানের মনে হল ও নাগরদোলায় চেপেছে। পাইন আর দেবদারুগাছের মাথার উপর দিয়ে দোল খেতে খেতে ভেলা নাবছে। বিহান শক্ত করে ভেলার দু’দিক চেপে ধরে। এখানে জমি কিছুটা রুক্ষ। চারপাশে ঘন জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ের বুক ঘেঁষে থালার মতো সমতল ভূমি। সরু ফিতের মতো নীল রঙের এক নদী পাহাড় থেকে বেরিয়ে এসে পাহাড়ের আড়ালে বিলীন হয়ে গেছে। নদীর উপর দিয়ে ভেসে এসে বিহানের ভেলা এবড়োখেবড়ো কাঁচা রাস্তা বরাবর উড়তে থাকে। রাস্তা থেমে গেছে একটা দোতলা কাঠের বাড়ির উঠোনে। উঠোনের উপর ভেলা সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায়। বিহান নিজের ঘাড়ে ঘুড়িবুড়োর স্পর্শ পায়। বুড়ো হেসে জিজ্ঞেস করে, “কেমন লাগছে? ভালো না জায়গাটা?”
বিহানের মুখ দিয়ে কথা সরে না। সে দু’চোখ ভরে নয়নাভিরাম মুক্ত প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকে। ঠাণ্ডা মিষ্টি বাতাস বিহানের কানে, মুখে, হাতের পাতায় সুড়সুড়ি দেয়। সে বুড়োর দিকে তাকিয়ে শুধু হাসে।
“আমরা কোথায় এখন?” শুধায় বিহান।
“কাশ্মীর। আর এই গ্রামের নাম গুরেজ।”
বিহান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বিহানদের ভূগোল বইতে লেখা আছে, কাশ্মীরকে ভূ-স্বর্গ বলা হয়। এখন বোঝা যাচ্ছে, সত্যি সত্যি স্বর্গের খুব কাছে এসে পড়েছে বিহান। কাঠের বাড়িটার উঠোনে খেলা করে বেড়াচ্ছে তিন-চারটে সাদা লোমে ঢাকা ভেড়া। বিহানরা হেঁটে চলে বাড়িটার দিকে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে বিহানের বয়সী একটা ছেলে। তার নাকটা খুব উঁচু আর গায়ের রং ফরসা। মাথায় বিহানের চাইতে কিছুটা উঁচুই হবে।
দুর্বোধ্য ভাষায় বিহানকে সে কিছু বলে। বিহান একবর্ণ বুঝতে পারে না। পেছন ফিরে দেখে বুড়ো উধাও। কী করবে বুঝতে না পেরে যখন সে ভাবছে পেছন ফিরে দৌড় লাগাবে কি না, তখনই কাঠের বাড়ির আর একটা দরজা খুলে গেল। এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বিহানের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর হাতের ইশারায় বিহানকে ডেকে ঘরে এসে বসতে বললেন। বিহানের বেজায় রাগ হচ্ছে। তাকে ফেলে ঘুড়িবুড়ো গেল কোথায়?
ধীর পায়ে বাড়িতে ঢোকে বিহান। কাঠের মেঝেতে পায়ের শব্দ ওঠে ঠক ঠক করে। ঘরটা অনেক বড়ো। সেখানে বিরাট এক ফায়ার-প্লেস। ঢিমে আঁচে কাঠ জ্বলে ঘরটাকে গরম করে রেখেছে। ফায়ার-প্লেসে পেছন ফিরে এক বুড়ো কাঠ গুঁজে দিচ্ছে আগুনে। আরে, কী আশ্চর্য, ঘুড়িবুড়ো যে! হাসিমুখে সেদিকে এগিয়ে যেতে মিষ্টি হাসে বুড়ো। ঘরে শুধু বিহান আর ঘুড়িবুড়ো।
“কী, ভাষা বুঝতে পারছ না? এরা ডোগরি ভাষায় কথা বলে। কাছে এস, তোমার কপালে আমি আঙুল ছুঁয়ে দিচ্ছি। তাহলে তুমিও ওদের ভাষা বুঝতে পারবে।”
ছেলেটি আর তার মা ঘরে আসে। মায়ের হাতে ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম, সাথে লম্বা বিস্কুট। এবার ছেলেটি বিহানকে জিজ্ঞেস করে, “কি নাম তোমার?”
ঘুড়িবুড়ো বিহানের কপালে আঙুল ছুঁইয়ে দিয়েছে। তাই পরিষ্কার ওদের কথা বুঝতে পারে বিহান। বিহানের নাম শুনে ছেলেটি আর তার মা দু’জনেই বিড়বিড় করে বিহানের নামটা দু’তিন বার উচ্চারণ করে। ছেলেটির নাম আফরোজ। আফরোজ বিহানের দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দেয়। কালো রঙের চা দেখতে তেমন জুতসই না হলেও খেতে ভীষণ ভালো। মিষ্টি হেসে আফরোজের মা বিহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। হঠাৎ বিহানের নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে। এতক্ষণে মা তাকে না দেখতে না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। চা খেতে খেতে খিদে পায়। আফরোজের মা একটা প্লেটে একগোছা মোটা পরোটা আর আচার এনে সামনের টেবিলে রাখে। সুস্বাদু পরোটা খেতে খেতে আফরোজের সাথে গল্প করে বিহান। শুধু গুরেজে কী করে এসে পড়েছে, সেই কাহিনি ইচ্ছে করে বলে না। খেতে খেতে দেখে ফায়ার-প্লেসের ধোঁয়া চিমনি দিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে।
আফরোজ বিহানকে তাদের দেশ দেখাতে নিয়ে গেল। আফরোজদের উঠোন ছাড়িয়ে পাহাড়ি রাস্তা উঁচু হয়ে গিয়ে মিশেছে সুবিশাল পাহাড়ের গায়ে। চিনার আর দেবদারুগাছে মোড়া পাহাড়ের অন্ধকার ঘন জঙ্গলের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না বিহান। পাহাড় ছাড়িয়ে আর একটা পাহাড়। তার মাথা বরফে সাদা। সেখান থেকে সকালের সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে। আফরোজের সাথে অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে এসে একটা জায়গা থেকে হঠাৎ ঢালু রাস্তা। নিচে নদী বয়ে চলেছে। চারদিক এত নিস্তব্ধ যে, নদীতে জল বয়ে যাওয়ার শব্দ অনেকটা দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে। আফরোজ নদীর নাম বলল কিষান গঙ্গা। এই নদীকে নীলম নদীও বলা হয়। কাশ্মীরের শোনমার্গ থেকে এর উৎপত্তি হলেও মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার ভারতে বয়ে চলার পর পাকিস্তানে ঢুকে পড়েছে। সেখানে প্রায় দুশো কিলোমিটার দাপিয়ে বয়ে গিয়ে মিশে গেছে ঝিলম নদীতে।
আফরোজের কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে শুনতে কখন যে নদীর ধারে চলে এসেছে, লক্ষই করেনি বিহান। একটা ছোটো পাতার তৈরি ঝুপড়িমতো ঘরের সামনে এসে আফরোজ হাঁক পাড়তে বেরিয়ে আসে লম্বা এক মানুষ। গায়ে তার মোটা পশমের তৈরি পোশাক। কাশ্মীরিরা একে বলে ফিরন। লোকটা খুব ফরসা আর ধারালো চেহারার। শরীরও খুব মজবুত ধরনের। একটু দূরে দাঁড়িয়ে মানুষটার সাথে আফরোজের কী কথাবার্তা হচ্ছে শোনা গেল না। মানুষটা পাতার ঘর থেকে লম্বা রড নিয়ে বেরিয়ে এল। রডের অপর প্রান্তে লোহার সরু সরু ধারালো পেরেকের মতো ফলা। বিহান চিনতে পারে যন্ত্রটাকে। এটাকে বলে কোঁচ। জলের মধ্যে খেলে বেড়ানো মাছের ঝাঁক লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিয়ে মাছ ধরা যায়।
এবার ওরা নদীর ধারে এল। বাপ রে, জলে পা পড়তেই বিহানের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। অসম্ভব ঠাণ্ডা জল। বিহান লাফ দিয়ে পিছিয়ে আসতেই আফরোজ আর লোকটা জোরে জোরে হেসে উঠল। বিহান লজ্জা পেল। লোকটা কোনও কথা বলছে না। শুধু হাসছে। আফরোজ বিহানের মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, “এই মানুষটা বোবা। কথা বলতে পারে না। মাছ মারতে ওর মতো ওস্তাদ আর কেউ নেই।”
আফরোজের কথা শেষ হতে না হতেই বলতে না বলতে লোকটা জলের মধ্যে কোঁচটা ছুঁড়ে মারল। তারপর দৌড়ে গিয়ে রডের হাতল ধরে জল থেকে তুলে আনতেই দেখা গেল ফলার মাথায় একহাত লম্বা একটা মাছ বিঁধে ধড়ফড় করছে। আফরোজ জানাল, এই মাছের নাম ট্রাউট। কাশ্মীরের অতি সুস্বাদু মাছ। বিহান কোঁচটা হাতে নিয়ে দেখল বেশ ভারী। ওর কম্ম নয় এটা ছুঁড়ে মাছ ধরা। আফরোজের গায়ে বেশ জোর। সে চার-পাঁচ বারের চেষ্টায় আরও দুটো মাছ ধরল। বোবা লোকটাকে একটা দিয়ে নিজে দুটো মাছ নিয়ে ফিরে আসছে। তখন বিহান ঘাড়ে স্পর্শ পেল কারও হাতের।
মাথা ঘুরিয়ে দেখে ঘুড়িবুড়ো। ভাঙাচোরা মুখে নিষ্পাপ হাসি। আফরোজের কাঁধে আর একটা হাত রেখে ওদের সাথে নদীতট থেকে উঠে আসতে আসতে নরম গলায় বলল, “এবার যে ফেরার সময় হয়েছে, বিহানবাবু।”
বিহান চমকে উঠল। সত্যিই তো, গতকাল সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে এতদূর চলে এসেছে। ফিরতেও অনেক সময় লাগার কথা। আরে, কী আশ্চর্য! ঘুড়িবুড়ো আফরোজকেও চেনে! ওর সাথে দিব্বি গল্প করতে করতে হেঁটে চলেছে।
বুড়ো যেন অন্তর্যামী। হেসে বলে উঠল, “আফরোজ আমার পুরনো বন্ধু। আর তুমি এখন থেকে আমার বন্ধু হলে।” বলেই বুড়ো হনহন করে সামনে হেঁটে যেতে যেতে বলল, “আফরোজ, জলদি নিয়ে এস বন্ধুকে। অনেক দূর যেতে হবে যে!”
আফরোজের পাশে হাঁটতে হাঁটতে মনখারাপ হয়ে এল বিহানের। বাড়ি ফিরতে হবে। চলে যেতে হবে এই মায়া মাখানো সুন্দর প্রকৃতি ছেড়ে। আফরোজ সে-কথা বোধহয় বুঝতে পারল। বিহানের কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বলল, “দুঃখ করো না। আবার দেখা হবে আমাদের। এবার লিং-খুড়ো আমাকে নিয়ে যাবে তোমাদের দেশে, দেখো।”
“ওনার নাম লিং বুঝি?” বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল বিহান।
“হ্যাঁ। ওনার বয়স কত জানো? প্রায় দেড়শো বছর।”
হাঁটা থামিয়ে বিহানকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে আফরোজ ওর হাত ধরে টান দিয়ে বলল, “সত্যি বলছি। চল এখুনি। নইলে খুড়ো বেজায় রেগে যাবে। ওর রাগীরূপ তো দেখনি!”
“দেড়শো বছর কেউ বেঁচে থাকে নাকি?” প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় বিহান।
“সত্যি উনি বেঁচে। তাহলে বলি, শোন। লিং-খুড়ো বরাবরই বাচ্চাদের খুব ভালোবাসতেন। রকমারি ঘুড়ি বানিয়ে রাস্তার বাচ্চাদের বিলিয়ে দিতেন। ওনার দোকানে একসময় ঘুড়ি বানাবার সাথে সাথে চিনদেশ থেকে খেলনা আনিয়ে বিক্রি করতেন। সেই খেলনা বাচ্চাদের বিলিয়ে দিতেন। একবার বিচিত্র এক খেলনা আসে চিন থেকে। তার গায়ে চিনে ভাষায় নয়, হিব্রু ভাষায় লেখা লিপি দেখতে পান। ভাষাটা যে হিব্রু সেটা জানতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের কাছ থেকে। খেলনার নিচেটা দেখতে ছিল অনেকটা ভেলার মতো। রং ছিল সবুজ। রাতের অন্ধকারেও তার থেকে বিচিত্র আলো বেরোত। লিং-খুড়োর সেই আলো দেখে ভয় হয়। তিনি খেলনাটা কারও কাছে বিক্রি করেননি। কাউকে হাত দিতেও দিতেন না। একদিন তার দোকানের সামনে একটা বাচ্চা ছেলেকে বসে বসে কাঁদতে দেখে লিং-খুড়ো তাকে দোকানের ভেতরে নিয়ে এসে মিষ্টি আর জল দিয়ে তাকে হাসানোর চেষ্টা করেন। ভিনদেশ থেকে এসেছিল সেই ছেলে। কলকাতার রাস্তায় হারিয়ে গিয়েছিল। লিং-খুড়ো অনেক খোঁজখবর করে তার বাবা-মায়ের কাছে তাকে ফেরত দিয়ে আসেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই খেলনা থেকে বেরনো নীল আলোয় সেদিন মাঝরাতে খুড়োর ঘুম ভেঙে যায়। তিনি কানের কাছে শুনতে পান, ‘তুমি যতদিন চাইবে বেঁচে থাকবে। তোমার স্বাভাবিক মৃত্যু হবে, কিন্তু তুমি মরবে না। জাদুশক্তির বলে তুমি শরীর ছাড়াই বেঁচে থেকে বাচ্চাদের আনন্দ দেবে, তাদের সঙ্গ দেবে। বাচ্চারা আঠারো বছর বয়স পেরোলে আর তোমাকে পাবে না। তুমি পৃথিবীর যেকোনও জায়গায় এই ভেলায় চড়ে তাদের নিয়ে দেশবিদেশ দেখাতে পারবে।’ এই বলে দৈববাণী শেষ হয়।
“এই যে ভেলাটা, এটা আর কিছুই নয়, একটা টাইম মেশিন। এই টাইম মেশিনে চড়ে আমি মিশর ঘুরে এসেছি। সেখানে আমার এক বন্ধু হয়েছে, যার নাম আবদুল। তুমি যে ভাবছ, তুমি দু’দিন বাড়ি ছাড়া, তা কিন্তু নয়। তুমি এখন তোমার হিসাবের গতকালে ঘুরে বেড়াচ্ছ। ওই দেখ আমাদের উঠোনে ভেলা নিয়ে লিং-খুড়ো দাঁড়িয়ে। যাও বন্ধু। আবার দেখা হবে।”
বিহান নীল ভেলায় চড়ে বসতেই লিং-খুড়ো তার কপালে হাত ছুঁইয়ে দেয়। বিহান ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভেঙে উঠে দেখে তাদের ছাতে বিহান শুয়ে। হাতের লাটাইটা পাশে পড়ে আছে। নিচ থেকে মায়ের গলা শুনে সিঁড়ি বেয়ে নেবে আসে বিহান। কাল স্কুল যেতে হবে। অনেক হোম-ওয়ার্ক জমে আছে।